অধিকার সনদের ২৫ বছরে কেমন আছে শিশুরা?

এমন হাসি-খুশি আনন্দময় শৈশব হওয়ার কথা সব শিশুর। কিন্তু সব সময় তা হয় না। নানা নেতিবাচক ঘটনায় মলিন হয়ে যায় বহু শিশুর হাসিমাখা মুখ। ফাইল ছবি
এমন হাসি-খুশি আনন্দময় শৈশব হওয়ার কথা সব শিশুর। কিন্তু সব সময় তা হয় না। নানা নেতিবাচক ঘটনায় মলিন হয়ে যায় বহু শিশুর হাসিমাখা মুখ। ফাইল ছবি

জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদের (সিআরসি) দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা থেকে সরকার এখন পর্যন্ত আপত্তি তুলে নেয়নি। গার্ডিয়ান অ্যান্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ আইনের কথা বলে দত্তক ব্যবস্থার বিষয়টি সরকার অনুমোদন করেনি। শিশুদের চিন্তা, বিবেক ও ধর্মের স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়েও সরকার নিশ্চুপ।
এমন বাস্তবতার মধ্য দিয়েই দেশে আজ বৃহস্পতিবার শিশু অধিকার সনদের ২৫ বছর পূর্তি উদযাপন করা হচ্ছে। ১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে সিআরসি গৃহীত হয়। ১৯৯০ সালে প্রথম যে ২২টি দেশ শিশু অধিকার সনদ অনুসমর্থন করেছিল, বাংলাদেশ তার অন্যতম। তাই ২৫ বছর পূর্তির আনুষ্ঠানিকতায় ঘুরে-ফিরেই আসছে, দেশের শিশুরা কেমন আছে?
জাতিসংঘের সিআরসি কমিটি এই দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলে নেওয়ার জন্য সরকারকে বারবার তাগিদ দিচ্ছে। প্রতিবারই কমিটির কাছে জবাবদিহির সময় সরকার বলছে, আপত্তি তুলে নেওয়া হবে।
এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকার এই দুটি ধারা থেকে আপত্তি তুলে নিতে এখন পর্যন্ত সেভাবে চিন্তাভাবনা করেনি। দেশের বাস্তবতায় শিশুদের ধর্মের স্বাধীনতা দেওয়ার বিষয়টি কতটুকু ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা ভাবা হচ্ছে। এ ছাড়া দত্তক পদ্ধতি না থাকলেও শিশুর অভিভাবকত্ব নেওয়ার বিধান আছে দেশে।

এবার শিশুদের মুখেই শোনা যাক, তারা কেমন আছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের সহায়তায় ‘ইচ্ছে শিশু মিডিয়া দল’ নামক একটি সংগঠনের সদস্যরা সুবিধাবঞ্চিত শিশু। ২০০৬ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত মিডিয়াভিত্তিক শিশুবিষয়ক তথ্য দিয়ে ‘এই আমাদের জীবন’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই শিশুরা বলেছে, প্রতিদিন অনেক খবর আসে কাগজের পাতা ভরে, শিশুদের অনেক কথাই রয়ে যায় সবার অগোচরে।

শিশুদের পাশাপাশি বড়রা যেসব প্রতিবেদন করেছে তাতেও দেখা যায়, শিশুরা খুব একটা ভালো নেই। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ছয়টি জাতীয় দৈনিকের প্রকাশিত সংবাদ পর্যালোচনা করে ‘বাংলাদেশ শিশু পরিস্থিতি ২০১৩’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলেছে, বছরটিতে শিশুদের নিয়ে নেতিবাচক খবর প্রকাশিত হয়েছে দুই হাজার ৮৯৫টি। অন্যান্য সহিংসতার খবরের পাশাপাশি ২৩৭টি প্রকাশিত খবরে বলা হয়, দেশের ২৬ লাখ ৩৭ হাজার ৯৯ জন শিশু মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বছরটিতে। তবে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের বাইরে কত শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, সে হিসাব সরকারের কাছেও নেই।

দেশে শিশু অধিকার বাস্তবায়ন পরিস্থিতির অগ্রগতি নিয়ে সরকারকে সিআরসি কমিটির কাছে জবাবদিহি করতে হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে সরকার সিআরসি বাস্তবায়ন নিয়ে কমিটির কাছে প্রথম প্রতিবেদন পাঠায়। ২০০৩ সালে দ্বিতীয়, ২০০৭ সালে সরকার একসঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রতিবেদন পাঠায়। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর পাঠায় পঞ্চম প্রতিবেদন। সর্বশেষ এই প্রতিবেদনে সরকার বেশ কিছু আইন ও নীতি প্রণয়নের কথা উল্লেখ করেছে। তবে আইন ও নীতির বাস্তবায়ন চিত্র তুলে ধরতে পারেনি সরকার। এতে সরকার শিশুর পরিসংখ্যান উল্লেখ না করে বলেছে, দেশের অনেক শিশু এখনো অপুষ্টি, রোগ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। দেশে বাল্যবিয়ে ও শিশুশ্রম বাড়ছে। সরকারের পাশাপাশি দেশের ৫৪টি বেসরকারি সংগঠনও কমিটির কাছে শিশু অধিকার বাস্তবায়ন পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিকল্প প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।

জাতিসংঘের সিআরসি কমিটি সরকারের পাঠানো পঞ্চম প্রতিবেদনটি এখন পর্যন্ত পর্যালোচনা করেনি। তবে তৃতীয় ও চতুর্থ প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে ২০০৯ সালে কমিটি কিছু সমাপনী পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ দেয়। তারা বলে, বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের বড় অংশ আসে দাতাগোষ্ঠী ও বিদেশি উৎস থেকে। ফলে বাজেটের অর্থনৈতিক ভিত্তি স্থিতিশীল না। এই পরিস্থিতি বাজেটে শিশু খাতে বরাদ্দকে প্রভাবিত করে। এ ছাড়া শিশুদের জন্য ন্যায়পাল নিয়োগ না করা, খেলার মাঠ ও খেলাধুলার সুযোগ-সুবিধার অভাব, শিশুর জন্য সীমিত অবসর, বিনোদন ও সাংস্কৃতিক সুবিধা না থাকার বিষয়েও কমিটি উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। শিশু অধিকার সনদকে দেশীয় প্রেক্ষাপটে ব্যবহারের জন্য কোনো সমন্বিত আইন না থাকা, জাতীয় আইনে শিশুর সর্বোত্তম স্বার্থের মূলনীতি স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত না হওয়ায় কমিটি অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। মেয়েশিশু, নগরের পথশিশু, শরণার্থী, প্রতিবন্ধী, বস্তি, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর শিশুসহ কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর শিশুরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। শিশুর নির্ভরযোগ্য পৃথক তথ্যের অভাব, বিচারব্যবস্থা এবং প্রশাসনিক কাজে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে শিশুর কতটুকু অধিকার আছে, সে বিষয়ে তথ্যের স্বল্পতা নিয়েও কমিটি উদ্বিগ্ন।

এই পর্যবেক্ষণ ও উদ্বেগ সিআরসি কমিটি প্রতিটি প্রতিবেদনের মূল্যায়ন শেষেই করেছে। তবে বাস্তবতা একই থেকে গেছে, কোনো পরিবর্তন আসেনি।

এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব তারিক-উল ইসলাম বলেন, শিশুদের অবস্থা পরিবর্তনে সরকার বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে সেসব কার্যক্রমকে পর্যাপ্ত বলা যাবে না। সরকারের সম্পদেরও সীমাবদ্ধতা আছে। তিনি বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংগঠনকে শিশুদের উন্নয়নে আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।