অনন্য এক আয়শার গল্প

প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়শা সিদ্দিকা। শোনালেন তাঁর জীবনের গল্প। ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়শা সিদ্দিকা। শোনালেন তাঁর জীবনের গল্প। ছবি: জাহিদুল করিম

আলো থেকে অন্ধকারে পড়েছিলেন আয়শা। সুন্দর স্বাভাবিক জীবন তো হারিয়েই গিয়েছিল। হাবুডুবু খাচ্ছিলেন হতাশার অথৈ সাগরে। এরই মধ্যে জেগে ওঠে তাঁর ভেতরের সুপ্ত শিল্পের ভেলা। সে ভেলায় ভেসে নতুন জীবনের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। লেখা ও আঁকা মিলিয়ে এ এক অনন্য আয়শা।
লেখাগুলো বই আকারে কোনো দিন প্রকাশিত হবে, তা স্বপ্নেও ছিল না। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় মনের কথাগুলোই লিখতেন। কখনো তা গল্প, আবার কখনো কবিতা হতো। ওই লেখা ও নিজের মনের ভাবনাগুলো নিয়ে আঁকা ছবি দিয়েই ৮০ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশিত হয়। লেখিকা বাংলাদেশি, তবে তাঁর বইটি প্রকাশিত হয় ভারতের কেরালার কালিকাটের মালায়ালাম ভাষায়। ছবি দিয়ে সেখানকার ললিতকলা একাডেমি আর্ট গ্যালারিতে প্রদর্শনীও হয়। পুরস্কার হিসেবে একটি ক্রেস্ট পেয়েছেন। বই আর ছবি বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ৮৫ হাজার রুপি।
এই লেখিকা ও ছবি আঁকিয়ে বইয়ে নিজের নাম ব্যবহার করতে পারেননি। ছায়া নামটি ব্যবহার করেন। তবে এই নারী এখন দেশে ফিরে নিজেই নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাচ্ছেন। তিনি যশোরের রাজারহাটের আয়শা সিদ্দিকা। তিনি সবাইকে বলতে চান, ভারতে গিয়ে পাচারকারীদের হাতে পড়া এবং তাদের হাত থেকে পালিয়ে বাঁচার ঘটনাটি ছিল শুধুই একটি ‘দুর্ঘটনা’।
কৌশলে পাচারকারীদের হাত থেকে পালানো, পুলিশ কেস, আদালত, সরকারি মহিলা মন্দিরাম ও বেসরকারি নির্ভয়া আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ছয় মাস থাকার পর কেরালার কালেক্টরের সহায়তায় তিনি দেশে ফেরেন গত বছরের ডিসেম্বরে। এর আগেই কেরালার বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘ছায়া’ নামের বাংলাদেশি নারীর খবর তোলপাড় তুলেছে। কেননা প্রথমবারের মতো পাচারের শিকার হতে যাওয়া কোনো নারীর লেখা বই প্রকাশ হয়েছে। ঘটা করে ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। বই ও ছবি বিক্রি হয়েছে। বইয়ের কভারসহ বইতে স্থান পাওয়া ২৪টি ছবিই আয়শার নিজের আঁকা। বইয়ের নীল রঙের কভারে মালায়ালাম ভাষার পাশাপাশি বাংলায় ‘আহত আমি’ এবং ছায়া নামটি লেখা। বইটি আয়শা তাঁর তিন মেয়ে হিরা, অনু, নূনকে বাংলায় লিখে উৎসর্গ করেছেন। ১৮টি কবিতা ও একটি ছোটগল্প আছে বইটিতে। আয়শা নির্ভয়া আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় বইটি প্রকাশ করে স্থানীয় এনজিও আর্ম অফ জয়। এই এনজিওর ম্যানেজিং ট্রাস্টি জি অনুপ এতে সার্বিকভাবে সহায়তা করেন। বাংলা পাণ্ডুলিপি থেকে ইংরেজি ও মালায়ালাম ভাষায় প্রকাশ হয়। 

আয়শা সিদ্দিকা দেশে ফিরে আসার পর তাঁর পরিবার তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করেছে। তবে সামাজিকভাবে তাঁর পুরো পরিবারকে প্রতিনিয়ত কথা শুনতে হচ্ছে। আয়শা নিজেই পাচারকারী, অপরাধী, ভারতে জেলখানায় ছিলেন ইত্যাদি বলছে সবাই। তবে আয়শা সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চান। মালায়ালাম ভাষায় প্রকাশিত বইটি বাংলা ভাষায় প্রকাশ করতে চান। মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করতে চান। পাচার প্রতিরোধে যশোরের এনজিও রাইটস যশোরসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি তাঁর পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাসও দিয়েছে।
একটি সংগঠনের কাছ থেকে সম্মাননা নেওয়ার জন্য আয়শা ঢাকায় এসেছিলেন। তারই এক ফাঁকে গতকাল বুধবার তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেন। প্রথম আলোর প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময়ই ভারতের পত্রিকার এক সাংবাদিক তাঁকে ফোন করে সাক্ষাৎকার নেন। টেলিভিশনে ভারতীয় সিরিয়াল ও কেরালায় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় হিন্দি ভাষাটি মোটামুটি রপ্ত করেছেন। ফোনে হিন্দি, টুকটাক ইংরেজি বলে সাক্ষাৎকার শেষ করেন আয়শা। বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমেও তাঁর সাক্ষাৎকার ছাপা হচ্ছে। ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যাওয়ার কারণে খুব বেশি দূর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননি। তবে বই পড়া থেমে থাকেনি তাঁর।
আয়শা জানান, তাঁর লেখালেখির অভ্যাস আগে থেকেই ছিল। ভারতে যাওয়ার আগেই যশোর ইনস্টিটিউট পাবলিক লাইব্রেরি থেকে ‘দুর্বা’ নামের একটি বইও বের করেন। আর ছবি আঁকা প্রসঙ্গে আয়শা বলেন, ‘কেরালায় বইতে ছবি প্রকাশের জন্য একটি ক্যানভাসে তুলি দিয়ে ছবি আঁকতে বলে। কিন্তু আমি কোনো দিন তুলি দিয়ে ছবি আঁকি নাই। পরে হাতের আঙুলের নখে রং লাগিয়ে ক্যানভাসে ছবি আঁকি। ছবিগুলো তাঁরা খুব পছন্দ করেন।’
কথার একপর্যায়ে তিনি তাঁর ‘দুর্ঘটনা’র কথা বলতে শুরু করেন। চিকিৎসার জন্য স্বামী-স্ত্রীর একসঙ্গেই ভারতে যাওয়ার কথা ছিল। পরে অনেকটা অভিমান এবং স্বামী শরাফত হোসেনের সঙ্গে ঝগড়া করে আয়শা একাই রওনা দিয়েছিলেন ভারতের পথে। পাসপোর্ট ভিসা নিয়ে বৈধ পথেই গিয়েছিলেন তিনি। তবে বর্ডার পার হওয়ার পরই বাংলাদেশে ফেলে যাওয়া স্বামী ও তিন মেয়ে, এমনকি নিজের সেলাই মেশিনটার জন্যও মন খারাপ করতে থাকে। কিন্তু তখন আর ফিরে আসার পথ পাচ্ছিলেন না। রাস্তায় বসেই কান্নাকাটি করছিলেন। এক সময় একজন লোক এসে আন্তরিকভাবে কথা বলেন। ভালো কাজ, চিকিৎসা, বেড়ানোসহ সব ধরনের ব্যবস্থা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন।
আয়শা বলেন, ‘ওই মুহূর্তে লোকটিকে খারাপ মনে হয়নি। বনগাঁ রেলস্টেশনে যাওয়ার পর ওই লোকের এক বন্ধুর সঙ্গে ট্রেনে উঠি। লোকটি আমার পাশেই বসে। ট্রেনে বসে চারপাশে কী হচ্ছে, তা খেয়াল করতে পারি নাই। এক সময় লোকটি সিগারেট ধরাল। নাকে গ্যাসের গন্ধ পাই। তারপর আর কিছু মনে নেই। যখন হুঁশ হয়, তখন নিজেকে একটি বাথরুমে আবিষ্কার করি। তিন দিনের মধ্যে কেউ আসেনি। শুধু টেপের পানি খেয়ে ছিলাম।’

প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়শা সিদ্দিকা। শোনালেন তাঁর জীবনের গল্প। ছবি: জাহিদুল করিম
প্রথম আলো কার্যালয়ে আয়শা সিদ্দিকা। শোনালেন তাঁর জীবনের গল্প। ছবি: জাহিদুল করিম

আয়শা জানান, তারপর একজন নারী ও একজন পুরুষ এসে বাথরুম থেকে বের করে একটি ঘরে নিয়ে আসেন। তাঁকে বিক্রি করে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছিল। একদিন ভোরের দিকে সেখান থেকে পালিয়ে বাইরে চলে আসেন। হাসপাতালের একজন নার্সের সহায়তায় পুলিশ কেস এবং অন্যান্য ঘটনা ঘটতে থাকে। আশ্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে আয়শার স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আদালত আয়শা স্বামীর সঙ্গে দেশে ফিরতে পারবেন বলে রায় দেন। স্বামী সেখানে যানও। তবে স্ত্রীকে ফেলে রেখেই বাংলাদেশে চলে আসেন। তখনই আয়শা অভিমানে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেন।
আয়শা এক সময় নিজেকে মানসিক রোগী ভাবতেন। কেরালায় হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছিলেন এ কারণে। কেরালায় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকার সময় একবার আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিলেন আয়শা। তবে এখন এ নিয়ে ভাবলে তাঁর আফসোস হয়। তিনি বলেন, ভারত এবং বাংলাদেশে তিনি তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। সামনের দিনগুলো চোখের সামনে ঝিলিক দিচ্ছে। আত্মহত্যা করলে তিনি তা দেখতে পেতেন না।