অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখা যাবে না
সাংবাদিকতার জন্য অশনিসংকেত, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মেরুদণ্ড ভাঙার চেষ্টা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হুমকির মুখে—গত কয়েক দিনে দেশজুড়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের বিক্ষোভ সমাবেশ ও মানববন্ধন থেকে ঘুরেফিরে এসব কথাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে প্রথম আলো কথা বলেছে জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি ফরিদা ইয়াসমিনের সঙ্গে।
প্রথম আলো: তথ্য প্রকাশে নানা প্রতিবন্ধকতার অভিযোগ আছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের পর অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের প্রয়োগ দেখা গেল। এর মধ্য দিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে, এমন ধারণা তৈরি হচ্ছে কি না।
ফরিদা ইয়াসমিন: সাংবাদিকদের সব সময় বিভিন্ন ঝুঁকি ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেই কাজ করতে হয়। হামলা-মামলা নতুন কিছু নয়। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেকে খুনও হয়েছেন। সারা বিশ্বেই বৈরী পরিবেশে কাজ করতে হচ্ছে সাংবাদিকদের। দেশে সাংবাদিকদের কাজে বাধা দিতে নানা আইন আছে। কিন্তু সাংবাদিকদের সুরক্ষায় সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছে। আর তথ্য অধিকার আইনের সঙ্গে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট সাংঘর্ষিক। এ আইনও বাতিল করতে হবে। তবে এসব কিছু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখতে পারবে না। বাধা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সাংবাদিকদের অনুসন্ধানী মনোভাবই সত্যকে বের করে আনে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে দমিয়ে রাখা আগেও যায়নি, এখনো যাবে না।
প্রথম আলো: সাংবাদিকের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টাকে নানা অপবাদ দেওয়া হচ্ছে। এটি সাংবাদিকতা পেশার প্রতি ক্ষমতা প্রদর্শনের মানসিকতা কি না।
ফরিদা ইয়াসমিন: যে তথ্য মানুষ জানে না, সেই তথ্যই গণমাধ্যম প্রকাশ করে। নানা কৌশল, উপায় ও মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করেন সাংবাদিকেরা। সচিবালয়ে সাংবাদিকেরা যখন বিভিন্ন দপ্তরে যান, তখন কিন্তু মন্ত্রী-আমলারা জানেন তথ্য সংগ্রহ করতেই এসেছেন তাঁরা। মন্ত্রী-আমলার যদি কখনো কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করেনও, সে ক্ষেত্রে তাঁদের সুরক্ষার জন্য আইন রয়েছে। একইভাবে সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্যও আইন থাকা জরুরি। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, তাঁরা সব সময়ই তথ্য লুকাতে চান। অনিয়ম-দুর্নীতি প্রকাশ হলে তাঁদের সমস্যা হবে, সে কারণে তাঁরা কখনোই সহযোগিতামূলক মনোভাব পোষণ করেন না।
প্রথম আলো: একজন সাংবাদিককে প্রায় ছয় ঘণ্টা প্রশাসনের কেন্দ্র সচিবালয়ে আটকে রেখে নির্যাতন করার পর সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ বা নিরাপত্তা বলে আর কিছু থাকে কি না?
ফরিদা ইয়াসমিন: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে রোজিনা ইসলামকে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতনের ঘটনা খুবই অন্যায়। ঘটনাটি উদ্বেগের এবং দুঃখজনক। কতিপয় কর্মকর্তা তাঁর সঙ্গে যে আচরণ করেছেন, সেটি ইচ্ছাকৃতভাবেই করা হয়েছে বলে মনে করি। এর কারণ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে তিনি বেশ কিছু প্রতিবেদন করেছেন। যে কারণে অনেকে তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ থাকবেন। তবে এ ঘটনাকে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলেই ভাবতে চাই। সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশে এ ঘটনা প্রভাব ফেলুক, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
প্রথম আলো: রোজিনা ইসলামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ভিডিও, ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ ও ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি এবং ন্যায়বিচারকে প্রভাবিত করার অপকৌশল কাজ করছে বলে মনে করেন কি?
ফরিদা ইয়াসমিন: রোজিনাকে আটকে রেখে নির্যাতন করে এবং কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে তাঁর কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে, এর পুরোটা আমরা এখনো কেউ জানি না। খণ্ডিত বা এডিট করা কিছু ভিডিও প্রচার করে বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করা যায় না। আইনের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আছে। আমার বিশ্বাস, আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন রোজিনা।
প্রথম আলো: ক্ষমতাসীন দলের নেতা এবং মন্ত্রীরা এ ঘটনায় পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন, এর কারণ কী হতে পারে বলে মনে করেন?
ফরিদা ইয়াসমিন: দেশে গত বছর করোনা মহামারি শুরুর পর আমরা দেখেছি একেক মন্ত্রী একেক রকমের বক্তব্য দিচ্ছেন। এতে মানুষের মধ্যে বিভিন্ন সময় বিভ্রান্তি দেখা দেয়। সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবও দেখা গেছে। সংক্রমণ পরিস্থিতি, টিকা নিয়ে বেশি কথা বললে সমস্যাও তৈরি হয়। রোজিনার ক্ষেত্রেও বেশি কথা না বলে বিষয়টির নিষ্পত্তির দিকে নজর দেওয়া দরকার। গণমাধ্যম ও সরকারকে মুখোমুখি করা কারও কাম্য হতে পারে না। পুরো ঘটনার সঠিক, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার।
প্রথম আলো: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেই হয়রানি–নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে। আবার তাঁদের দিয়েই তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এটি প্রত্যাখ্যান করেছে সাংবাদিক সমাজ। এরপরও মন্ত্রণালয় তার অবস্থান থেকে সরেনি। কী বলবেন?
ফরিদা ইয়াসমিন: যারা ঘটনায় জড়িত, তাদের দিয়ে তদন্ত কমিটি হতে পারে না। এটি ঘটনার শুরু থেকেই আমরা বলে আসছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে আইন বা অন্য কোনো মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে তদন্ত কমিটি হতে হবে। যে কমিটিতে সাংবাদিক সমাজের প্রতিনিধি থাকবে, অন্য পেশার প্রতিনিধিরাও থাকতে পারে। যাতে পুরো বিষয়টি সঠিকভাবে অনুসন্ধান করা যায়। আর রোজিনাকে নির্যাতনের ঘটনায় জড়িত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।