অনেক প্রশ্ন রেখে গেলেন লিটন

রফিকুল ইসলাম লিটন
রফিকুল ইসলাম লিটন

‘কল্যাণীয়াষু, প্রীতি কিংবা ভালোবাসা জানাবার মতো হৃদয়ের ঐশ্বর্য আমার নেই। সেই অর্থে অতীত কিংবা বর্তমানের কোনো বিষয় নয়...প্রকৃতিপ্রদত্ত আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই। চিঠি লেখার প্রতি আশৈশব একটা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও লিখতে পারিনি, লিখতে জানিও না। তবু লিখতে হচ্ছে...’
চল্লিশ পেরিয়েছিলেন মো. রফিকুল ইসলাম লিটন৷ বিয়ে করা হয়নি৷ কার উদ্দেশে লিখেছিলেন চিঠিটি তা স্বজনেরা জানেন না৷ সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো মিলবে না আর কখনোই। স্বজনদের ভাষ্য, জীবনভর নিজের আবেগ-অনুভূতিকে চাপা দিয়ে এসেছেন লিটন৷
‘কল্যাণীয়াষুর’ হাতে চিঠিটি লিটন সত্যিই পৌঁছাতে চেয়েছিলেন কি না, সে-ও এক রহস্য। চিঠিটি খামে ভরেননি৷ ডায়েরির একটি পাতায় মৃত্যুর কদিন আগে শুধু লিখে রেখে গেছেন। বইয়ের তাকের এক কোনায় রাখা ছিল ডায়েরিটি। ঠিক এক পৃষ্ঠা পরেই লিটন নানা হিসাব-নিকাশের বিবরণ লিখে রেখেছেন। তারপর সব পাতা সাদা৷ যেন আগের পাতাতেই মিলিয়েছেন ‘জীবনের সব লেনদেন’৷
গত ২৭ এপ্রিল মামলায় হাজিরা দেওয়ার পথে অন্য ছয়জনের সঙ্গে লিটনও অপহৃত হন৷ তিন দিন পর ছয়টি লাশ ভেসে উঠলেও, তিনি তখনো নিখোঁজ ছিলেন। একা থাকতে ভালোবাসতেন লিটন। পরদিন একাই ভেসে ওঠেন শীতলক্ষ্যায়...। জীবনভর শোক করার জন্য রেখে যান প্রায় অন্ধ বাবা মনির হোসেন মিয়াজি আর ছয়টি ভাইবোনকে।
গত সোমবার সানারপাড়ে লিটনদের বসার ঘরে যখন ভাইবোনেরা এ প্রতিবেদকের সঙ্গে স্মৃতিচারণা করছেন, তখন এককোণে বসে বিড়বিড় করছিলেন বাবা মনির হোসেন৷ কান পাতলে শোনা গেল, বলছেন: ‘কোনো দিন না বইলা বাইর হয় নাই গো মা। ওই একদিনই। আর ফিরে নাই।’ ডুকরে কেঁদে ওঠেন তিনি। ছেলেমেয়েরা বাবার গায়ে-মাথায় হাত বোলায়। কয়েক মুহূর্তের জন্য থামেন। কিন্তু চোখের কোণে জমে ওঠে পানি।
লিটনের বড় ভাই মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ২২ ডিসেম্বর তাঁর ছেলে কামরুল ইসলামের শরীরের ৪৫ ভাগ পুড়ে যায়। প্রায় সাড়ে তিন মাস ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে গোটা পরিবারের সঙ্গে ব্যস্ত ছিলেন লিটন। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ভীষণ ধাক্কা খেয়েছিলেন লিটন। নিজেকে আরও গুটিয়ে নিয়েছিলেন।
ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মনে করেন, লিটনের একমাত্র দোষ প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের সঙ্গে থাকা। তিনি বলেন, নজরুল লিটনের কলেজজীবনের বন্ধু। নজরুলের ছেলেমেয়েরা লিটনকে ছোট বাবা বলে ডাকত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী হলেও ছাত্রলীগ, যুবলীগ কিংবা আওয়ামী লীগের কোনো কমিটিতে নাম ছিল না লিটনের। পরিবারের ভাষ্যমতে, প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামের বন্ধু হলেও লিটন সব সময় তাঁর গাড়ি এড়িয়েই চলতেন। সেদিন কেন নজরুলের গাড়িতে উঠতে গেলেন, সে প্রশ্ন এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে তাদের মাথায়।
১৯৮৯ সালে মা কে হারিয়েছিলেন লিটন। বড় দুই ভাই তখন পেশাগত কারণে দূরে থাকায় মায়ের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বাবাকেও আগলে রাখতেন সন্তানের মতো। সেই বাবা-ভাইবোনেরা তাঁর অনুপস্থিতিতে আজ দিশেহারা৷
প্রিয়জনদের মনে হাজারো প্রশ্নের জন্ম দিয়ে কোনো উত্তর না রেখে অসীমে মিলিয়ে গেলেন লিটন। ‘কল্যাণীয়াষুকে’ নিজেকে মেলে ধরতে না পারার অক্ষমতার কথাও লিখেছিলেন ওই চিঠিতে, ‘এক সীমাবদ্ধ জগতের মানুষ আমি। যেখানে নিজস্ব কিছু ভাবনা ছিল, বই ছিল, জলছবি আর প্রকৃতি ছিল।
ঘূর্ণায়মান সময়ের আবর্তে অনেক কিছুই মুছে যায়। কিছু কিছু থেকেও যায় অজান্তে, অবচেতনে, অস্পষ্ট বিমূর্ত ছায়ার মতো। মানুষের জীবনে হাজারো উত্তরবিহীন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মতো, আমার মনস্তাপের কোনো কারণ নেই, কোনো প্রশ্ন নেই-নেই উত্তরও।’
হয়তো এ চিঠির অনামা প্রাপক অপেক্ষা করে ছিলেন৷ তাঁর সে প্রতীক্ষার আর অবসান হবে না কোনো দিন।