অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ভাস্করের মরদেহে শ্রদ্ধা

ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মরদেহ গতকাল তাঁর অমর সৃষ্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলা’র সামনে আনা হয়। এ সময় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ সংস্কৃতিকর্মীরা সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন l ছবি: প্রথম আলো
ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের মরদেহ গতকাল তাঁর অমর সৃষ্টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলা’র সামনে আনা হয়। এ সময় সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরসহ সংস্কৃতিকর্মীরা সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন l ছবি: প্রথম আলো

জ্যৈষ্ঠের খররোদের মধ্যদিনে ফুলে সাজানো শববাহী গাড়িটি ধীরে ধীরে এসে থামল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত ভাস্কর্য অপরাজেয় বাংলার সামনে। আগে থেকেই পাশের বটগাছের ছায়াতলে এবং চত্বরের স্থানে স্থানে দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজন আর ছাত্রছাত্রীরা এসে অপেক্ষা করছিলেন। নেমে এসেছিল মৌনতা।

শববাহী গাড়িটি এলে সবাই এগিয়ে গেলেন ফুলের স্তবক নিয়ে দেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক ওই ভাস্কর্যটির শিল্পী ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদকে শেষশ্রদ্ধা নিবেদন করতে। গত শনিবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে তিনি রাজধানীর বারডেম হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর আবদুল্লাহ খালিদের মৃত্যুতে গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করে পৃথক বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তাঁরা বলেছেন, ভবিষ্যতের ভাস্কররা তাঁর কাজে অনুপ্রাণিত হবেন। জনগণ তাঁকে স্মরণে রাখবে।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ
সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ

গতকাল সকালে দেশের এই স্বনামধন্য ভাস্করের মরদেহ তাঁর গ্রিন রোডের বাসভবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিনে আনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। এখানে অনুষদের ভারপ্রাপ্ত ডিন শিল্পী শেখ আফজালের নেতৃত্বে বিশিষ্ট শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, চারুকলার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রফিকুন নবী, শিল্পী সৈয়দ জাহাঙ্গীর, সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী, নাট্যজন ম. হামিদসহ অনেকে।

রফিকুন নবীর প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। স্মৃতিচারণা করে রফিকুন নবী বলেন, ‘অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটির প্রথম লে-আউট করে আমাকে দেখাতে এনেছিল। আমি এতগুলো অবয়বের পক্ষে ছিলাম না। তবে ও করে দেখিয়ে দিল। এটি এখন দেশের মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।’ দুপুর ১২টার কিছু পরে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য মরদেহ আনা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে। এখানে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, ‘তাঁর মৃত্যু বড়ই অপ্রত্যাশিত। এই ভাস্কর্যটি আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে আছে।’ শ্রদ্ধা নিবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আবদুল্লাহ খালিদ তাঁর এই ভাস্কর্যের ভেতর দিয়ে অমর হয়ে থাকবেন।

এখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী, জাতীয় কবিতা পরিষদ, চারুশিল্পী সংসদসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শিল্পী মনিরুজ্জামান, হামিদুজ্জামান খান, শহীদ কবির, সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর, কবি মুহাম্মদ সামাদ, কামাল পাশা চৌধুরীসহ অনেকে। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় এই শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বে আবদুল্লাহ খালিদের স্ত্রী উম্মে কুলসুম ভাস্কর্যটির পাদদেশে একটি নামফলক সংযোজনের আহ্বান জানান।

আবদুল্লাহ খালিদ সম্পর্কে শিল্পী মনিরুজ্জামান বলেন, খালিদ স্পষ্ট কথা বলতে পছন্দ করতেন। এ কারণে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তবে এটি ছিল তাঁর বিশেষ গুণ। শেষ দিকে এসে প্রচুর ফুলের ছবি এঁকেছেন। একসময় এমন শক্তপোক্ত মাধ্যম নিয়ে যিনি কাজ করেছেন, তাঁর এমন কোমল বিষয়ে ফিরে আসা বিশেষ বৈশিষ্ট্যময়। ভাস্কর হামিদুজ্জামান বলেন, ‘স্তরে স্তরে ঢালাই করে তারপর ছেনি দিয়ে কেটে কেটে অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা। এই ভাস্কর্যের ভেতর দিয়ে খালিদ আমাদের দেশের অবয়বধর্মী ভাস্কর্যের একটি নতুন ধারা সংযোজন করেছিল। আমাদের দেশে ভাস্কর্যের চর্চা খুব সীমিত। নভেরা আহমেদের শূন্যস্থান পূরণ হয়নি। খালিদ আরও একটি শূন্যতা তৈরি করে গেল।’ শিল্পসমালোচক সৈয়দ আজিজুল হক বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ভেতরে একটি জাতির স্বাধীনতার যে বিপুল আকাঙ্ক্ষা ও শক্তির সম্মিলন ঘটেছিল, তার অসাধারণ প্রকাশ ঘটেছে খালিদের এই অপরাজেয় বাংলায়।

সমাপনী বক্তব্য দেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ। এরপর শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। শ্রদ্ধা নিবেদনের পরে বাদ জোহর বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে তাঁর জানাজা সম্পন্ন হয়। এরপরে মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়। পরে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শুক্রবার বাদ আসর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে আবদুল্লাহ খালিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।

সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদের জন্ম সিলেটে। ১৯৬৯ সালে তিনি তৎকালীন ইস্ট পাকিস্তান কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) থেকে অঙ্কন ও চিত্রায়ণ বিভাগ থেকে স্নাতক ও ১৯৭৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যায় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রসংসদ কলাভবনের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য তাঁকে কমিশন করে। তবে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর কাজ বন্ধ হয়ে যায়। পরে শাসকদের পক্ষ থেকে ভাস্কর্যটি বন্ধ করার চক্রান্ত চলে। ছাত্রদের তীব্র প্রতিবাদের মুখে আবার এর কাজ শুরু হয় ১৯৭৯ সালে। ওই বছরই মহান বিজয় দিবসে অপরাজেয় বাংলার নির্মাণকাজ শেষ করেন ভাস্কর সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। তাঁর আরও কয়েকটি বিখ্যাত ভাস্কর্যের মধ্যে রয়েছে ‘অঙ্কুর’, ‘অঙ্গীকার’, ‘ডলফিন’, ‘মা ও শিশু’। এ ছাড়া বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবনের সামনে ‘আবহমান’ নামের একটি ম্যুরাল ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের সামনে একটি বড় আকারের টেরাকোটার কাজ রয়েছে। তিনি ২০১৪ সালে শিল্পকলা পদক এবং এ বছরই রাষ্ট্রীয় একুশে পদকে ভূষিত হন।