‘অপ্রকাশযোগ্য নথি’র কথা জব্দতালিকাতে নেই

জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের ভাষ্য, যেসব ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগ এনেছে, সেগুলোর সঙ্গে এজাহারের বর্ণনায় বড় অসংগতি রয়েছে।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি কক্ষে আটকে রেখে নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ও তাঁর দ্রুত মুক্তির দাবিতে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে সমাবেশ। এতে অংশ নেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সাংবাদিকেরা। গতকাল সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায়।
ছবি: হাসান রাজা

মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের কাছে ‘অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির’ নথিপত্র পাওয়া গেছে। অথচ এ মামলায় পুলিশের করা জব্দতালিকায় অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির নথিপত্রের বিষয়টিই নেই। আবার জব্দতালিকায় উল্লেখ করা রয়েছে, নথিপত্রগুলো জব্দ করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেছা বেগমের ‘উপস্থাপন মতে’।

এজাহার ও জব্দতালিকার বিষয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা বলছেন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং দণ্ডবিধির যেসব ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অভিযোগ এনেছে, সেগুলোর সঙ্গে মামলার এজাহারের বর্ণনায় বড় অসংগতি রয়েছে। এই মামলার সত্যতা ও ভিত্তি নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানীর করা মামলার এজাহারে রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হতে পারে—এমন নথি সরানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ‘বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সাথে বাংলাদেশের ভ্যাকসিন ক্রয়/সংগ্রহ সংক্রান্ত নেগোসিয়েশন (আলোচনা) চলমান রয়েছে এবং খসড়া সমঝোতা স্মারক ও নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট (অ-প্রকাশ্য চুক্তি) প্রণয়ন কাজ চলমান রয়েছে। সমঝোতা স্মারক নিয়ে পক্ষদ্বয়ের মাঝে প্রতিনিয়ত পত্র এবং ই-মেইলের মাধ্যমে যোগাযোগ হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সন্নিবেশিত রয়েছে। উক্ত নারী (রোজিনা ইসলাম) যেসকল নথিপত্রের ছবি তুলেছিলেন তার মধ্যে উল্লিখিত গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্রও ছিল।’

আইনজীবীরা বলছেন, মামলার জব্দতালিকায় যে চারটি নথির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, ‘জেনেভাস্থ বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনের অ্যাম্বাসেডর কর্তৃক প্রেরিত ডিও (২ পাতা)।’ দ্বিতীয়টি ‘কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যবহৃত চিকিৎসা সামগ্রী ও সরঞ্জামাদি ক্রয়ের প্রস্তাব অনুমোদনের পক্ষে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে প্রেরণের জন পরিচালক সিএমএসডি কর্তৃক প্রেরিত পত্র (৫৬ পাতা)।’ তৃতীয়টি ‘সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির জন্য সার সংক্ষেপ (২ পৃষ্ঠা)।’ চতুর্থ নথি হিসেবে আছে, ‘করোনাভাইরাস প্রতিরোধী টিকা সংগ্রহ ও বিতরণ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় পরামর্শক কমিটির অনুমোদন সংক্রান্ত অনুমোদিত সামারীর ফটোকপি (২ পাতা)।’

মামলার এজাহারে চুরি হওয়া নথির যে কথা বলা হচ্ছে, তা জব্দতালিকায় নেই। আগামীকাল রোববার রোজিনা ইসলামের জামিনের বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য রেখেছেন আদালত।

মামলার জব্দতালিকায় বলা হয়েছে, রোজিনা ইসলামকে তল্লাশি করে ওই ডকুমেন্টস (নথিপত্র) উদ্ধার করেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী জেবুন্নেসা। এ ছাড়া তাঁর উপস্থাপনমতে এসব ডকুমেন্ট সাক্ষীদের উপস্থিতিতে জব্দ করা হয়।

আইনজীবীরা বলছেন, যেসব নথিপত্রকে গোপনীয় বলা হচ্ছে, এর কোনোটিই গোপনীয় নয় এবং মানুষের এসব বিষয়ে জানার পূর্ণ অধিকার রয়েছে। দেশের সংবিধানও জনগণের তথ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা দিয়েছে।

এ বিষয়ে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, বড়জোর ওই সব ডকুমেন্ট ওষুধ ক্রয়সংক্রান্ত বাণিজ্যিক চুক্তি হতে পারে। এসব চুক্তির ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষ যদি তা প্রকাশ করে দেয়ও, তার দায়ভার কখনো রাষ্ট্রের ওপর পড়ে না। তাই এখানে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তার কোনো বিষয় আসতে পারে না।

রোজিনা ইসলাম

উল্লেখ্য, পেশাগত দায়িত্ব পালনে ১৭ মে সচিবালয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়ার পর সেখানে একটি কক্ষে প্রায় ছয় ঘণ্টা আটকে রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামকে। একপর্যায়ে অসুস্থ হয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেও তাঁর তাৎক্ষণিক চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়নি। সেদিন রাত সাড়ে আটটার পর তাঁকে নেওয়া হয় শাহবাগ থানায়। সেখানে প্রায় ১১ ঘণ্টা পুলিশি হেফাজতে ছিলেন তিনি। এর মধ্যেই থানায় তাঁর বিরুদ্ধে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ নম্বর ও ৫ নম্বর ধারা এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় মামলা করা হয়।

১৮ মে সকালে তাঁকে আদালতে হাজির করা হয়। সেখানে হাজতখানায় ছিলেন প্রায় তিন ঘণ্টা। আদালতে শুনানি শেষে প্রিজন ভ্যানে করে তাঁকে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে নেওয়া পর্যন্ত প্রায় ২৩ ঘণ্টা সময় লাগে। ২০ মে তাঁর জামিনের বিষয়ে শুনানি হয়। আদালত ২৩ মে (আগামীকাল রোববার) এ বিষয়ে আদেশের দিন ধার্য রেখেছেন। তিনি এখন গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগারে আছেন।

মামলাটি নথিভুক্ত হয়েছিল শাহবাগ থানায়। এজাহার ও জব্দতালিকার অসংগতির বিষয়ে এই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করে মামলার ধারা সংযুক্ত করা হয়েছে। গোপন নথির কথা এজাহারে থাকলেও জব্দতালিকায় নেই, এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, কোনো ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকলে তা তদন্তে বেরিয়ে আসবে এবং পরবর্তীকালে তা আদালতের অনুমতি নিয়ে সংশোধনের সুযোগ রয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারায় তখনই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা যাবে, যখন নিরাপত্তার স্বার্থে নিষিদ্ধঘোষিত কোনো এলাকা থেকে নথি সরানোর অভিযোগ ওঠে। রোজিনার কাছ থেকে নথি জব্দের স্থান উল্লেখ করা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের একান্ত সচিবের দপ্তর। এই স্থান নিষিদ্ধঘোষিত কোনো এলাকা নয়। সিক্রেটস অ্যাক্টের ৫ নম্বর ধারা উল্লেখ করা যাবে তখনই, যখন নথি শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগ উঠবে। রোজিনার বিরুদ্ধে করা মামলার এজাহারের কোথাও নথি শত্রুপক্ষের হাতে তুলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা নেই।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দণ্ডবিধির ৩৭৯ নম্বর ধারায় চুরির শাস্তি এবং ৪১১ নম্বর ধারায় চুরি হওয়া কোনো বস্তু কারও জিম্মা থেকে উদ্ধার করা হলে তার শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযোগের বিস্তারিত কোনো বর্ণনা মামলার এজাহারে নেই। তাই এই দুই ধারার সংযুক্তি প্রশ্নের মুখে পড়ে।

রোজিনা ইসলামের আইনজীবী এহসানুল হক সমাজী প্রথম আলোকে বলেন, মামলার এজাহারে চুরি হওয়া নথির যে কথা বলা হচ্ছে, তা জব্দতালিকায় নেই। আবার জব্দতালিকায় যে নথির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার বর্ণনা এজাহারে নেই। বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এই মামলায় নানা অসংগতি রয়েছে। এটি ত্রুটিপূর্ণ মামলা। ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে মামলাটি করা হয়েছে। যে কারণে আমাদের বিশ্বাস, আদালত ন্যায়বিচার করবেন।’