অবশেষে সরছে ৩৭ বছর আগের বিপজ্জনক ‘ডিডিটি’
ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা নিধনের জন্য ১৯৮৫ সালে আমদানি করা হয়েছিল ৪৮০ টন ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাফেনাইল ট্রাইক্লোরেথেন) পাউডার। মানুষ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক এই ডিডিটি ১৯৮৯ সালে নিষিদ্ধ করা হয়। তার পর থেকে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গুদামে পড়ে থাকে এই পাউডার। অবশেষে তা অপসারণের কাজ শুরু হচ্ছে।
ডিডিটি অপসারণের জন্য খরচ হবে ৭০ কোটির বেশি টাকা। অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে এই ডিডিটি প্রথমে ধাপে ধাপে জাহাজে তোলা হবে। এরপর আগামী এপ্রিল মাসে জাহাজটির ফ্রান্সের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা রয়েছে।
বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশের ওপর দিয়ে জাহাজটি যাবে। এ জন্য এই দেশগুলোর অনুমতিরও প্রয়োজন হচ্ছে। এই কাজে সহযোগিতা করছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। মূলত তারাই এই খরচ বহন করছে।
আগ্রাবাদ কেন্দ্রীয় ওষুধাগারের গুদামে থাকা ডিডিটি পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে আনা হয়েছিল বলে জানা গেছে। ডিডিটি পরিবেশসম্মতভাবে অপসারণের জন্য ২০২১ সালে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের নাম ‘পেস্টিসাইট রিস্ক রিডাকশন ইন বাংলাদেশ’। প্রকল্পের পরিচালক পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক ফরিদ আহমেদ।
প্রকল্পের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বেশ কয়েকটি সভা হয়েছে। গত ১১ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এফএও, স্বাস্থ্য, পুলিশ, কৃষি, কাস্টমস, বন্দর, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় এফএওর কর্মকর্তা মার্ক ডেবিস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিপজ্জনক জৈব রাসায়নিক পেস্টিসাইট অপসারণের আলোকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি ও নিরাপত্তা বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘ডিডিটি অপসারণের একটা প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা প্যাকেজিংয়ে যাব। এ ছাড়া কিছু অফিশিয়াল ফর্মালিটিজ সারতে হবে।’
ফরিদ আহমেদ জানান, ডিডিটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ম্যালেরিয়ার জীবাণুবাহী মশা নিধনের জন্য ডিডিটি বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। পরে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ২০০১ সালে বাংলাদেশ স্টকহোম কনভেনশনে সই করে। এই কনভেনশনে ডিডিটিসহ ক্ষতিকারক জৈব দূষণকারী কীটনাশক উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ বা সীমিতকরণ করা হয়।
প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, ডিডিটি অপসারণ কাজে জড়িত থাকবেন—এমন ১০ জনের মতো শ্রমিককে ইতিমধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা, ফায়ার সার্ভিস ও স্বাস্থ্যকর্মীদের দু-এক দিনের মধ্যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর অত্যন্ত সাবধানতার সঙ্গে ডিডিটি প্যাকেটজাত করে জাহাজে তোলা হবে।
জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘ডিডিটি অপসারণের কাজটি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা হবে। এ জন্য বেশ কিছু যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে আনা হয়েছে। পলিয়েকো নামের একটি প্রতিষ্ঠান ডিডিটি অপসারণের কাজটি পেয়েছে।’
ডিডিটি অপসারণ কাজের অংশ হিসেবে এফএওর একটি দল বর্তমানে চট্টগ্রামে রয়েছে। তারা বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালাগুলো তদারক করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এফএওর এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ধীরে ধীরে ডিডিটি জাহাজীকরণ শেষে এপ্রিলের দিকে জাহাজটি ফ্রান্সের উদ্দেশে চট্টগ্রাম ছেড়ে যাবে।
এফএওর ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘বিশ্বের অন্তত ১২টি দেশ দিয়ে জাহাজটি ফ্রান্সে পৌঁছাবে। এ জন্য প্রতিটি দেশের ছাড়পত্র প্রয়োজন হচ্ছে।’
ডিডিটি অপসারণের সময় গুদাম বা আশপাশের এলাকায় চলাচলে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। আজ বুধবার একটি প্রতিনিধিদল এলাকাটি পরিদর্শন করবে।
স্বাস্থ্য ও পরিবেশবিদেরা জানান, ডিডিটি অত্যন্ত মারাত্মক একটি রাসায়নিক। মানুষ, প্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের জন্য এই রাসায়নিক অত্যন্ত ক্ষতিকারক হিসেবে বিবেচিত হয়।
সূত্র জানায়, ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে আগ্রাবাদ এলাকার গুদামটিতে পানি ঢুকে গিয়েছিল। পরে পরিবেশ অধিদপ্তরের দূষণের প্রমাণ পায়। তখন তারা সেখানকার পানি পান ও জীবনযাপনে বেশ কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল।
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমাতে ডিডিটি আনা হয়েছিল। কিন্তু ডিডিটি মারাত্মক ক্ষতিকারক। এ জন্য তা অপসারণে ঝুঁকি রয়েছে। ডিডিটি অপসারণের ক্ষেত্রে এলাকার মানুষ ও পরিবেশের দিকটিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তাই সবাইকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এ বিষয়ে রসায়নবিদ অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, ‘ডিডিটি খুব দ্রুত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এটা পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। এটা নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা রয়েছে অনেক দেশে। কিন্তু অপসারণের সময় এখানকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে।’