অভিযান-১০ লঞ্চের মালিক-চালকদের দায়ী করে মন্ত্রণালয়ের কমিটির প্রতিবেদন

ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে গত ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে
ফাইল ছবি

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনায় লঞ্চটির চারজন মালিক, মাস্টার ও চালকদের দায়ী করে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কমিটি।

সদরঘাটে কর্মরত নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালনে চরম অবহেলা করেছেন বলে প্রতিবেদনে বলা রয়েছে।

গতকাল সোমবার রাতে কমিটির আহ্বায়ক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. তোফায়েল ইসলাম মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ্ উদ্দিন চৌধুরীর কাছে প্রতিবেদনটি জমা দেন। প্রতিবেদনে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে ২৫ দফা সুপারিশ ও করণীয় উল্লেখ রয়েছে।

কম লঞ্চ চালিয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের ‘রোটেশন’ প্রথা বন্ধের সুপারিশ করেছে কমিটি। মালিকদের এ কৌশলের কারণে প্রয়োজনের তুলনায় কম লঞ্চ থাকে। এ সুযোগে লঞ্চে গাদাগাদি করে যাত্রী তোলা হয়। এতে দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চটি চাঁদপুর ঘাট অতিক্রম করার পর ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দেয়। ইঞ্জিনের ত্রুটি সারতে ব্যর্থ হওয়ায় লঞ্চটি আর না চালিয়ে নিরাপদ কোনো ঘাটে আগেই ভেড়ানো উচিত ছিল। অনেক যাত্রী লঞ্চটি ভেড়ানোর অনুরোধও করেছিলেন। কিন্তু মাস্টার ও ইঞ্জিনচালক এ বিষয়ে কর্ণপাত না করে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চটি চালাতে থাকেন।

লঞ্চে লাগা আগুন নেভানোর কোনো চেষ্টা করা হয়নি বলে উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, আগুন লাগার পর লঞ্চটির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় আনুমানিক ১৫ মিনিট চলার পর ঝালকাঠির ধানসিঁড়ি ইউনিয়নের চর বাটারাকান্দা গ্রামে নদীর পাড়ে লঞ্চটি ভেড়ে। এখানেই লঞ্চের প্রথম শ্রেণির ইঞ্জিনচালক মাসুম বিল্লাহ, দ্বিতীয় শ্রেণির ইঞ্জিন ড্রাইভার আবুল কালাম ও কর্মরত গ্রিজাররা (ইঞ্জিনকক্ষের সহকারী) পালিয়ে যান। নোঙর করা বা লঞ্চটি বাঁধার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া সত্ত্বেও সে চেষ্টা করা হয়নি।

লঞ্চটি প্রথম যেখানে ভিড়েছিল, সেখানে নোঙর না করায় বা বেঁধে না রাখায় জোয়ারের কারণে সেটি আবার মাঝনদীতে চলে যায়। লঞ্চটি পুড়তে পুড়তে প্রায় ৪০ মিনিট পর নদীর অপর পাড়ের দিয়াকুল গ্রামে ভেড়ে। এই সময়ে অনেক যাত্রী অগ্নিদগ্ধ হন। অনেকে নদীতে লাফ দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আগুন নেভানোর চেষ্টা করা হলে, লঞ্চটি চর বাটারাকান্দায় ভেড়ানোর স্থানে বাঁধলে বা নোঙর করলে হয়তো আগুনের তীব্রতা এত বৃদ্ধি পেত না। এত যাত্রীর প্রাণহানি ঘটত না।

আগুনের সূত্রপাত লঞ্চের ইঞ্জিন থেকেই হয়েছে উল্লেখ করে মালিকদের দায় নির্ধারণ করে কমিটি বলছে, নিবন্ধন সনদ অনুযায়ী লঞ্চটির দুটি ইঞ্জিনের মোট ক্ষমতা ছিল ১ হাজার ১০০ অশ্বক্ষমতার (বিএইচপি)। কিন্তু মালিকেরা নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে সনদের শর্ত ভেঙে অন্য জাহাজের পুরোনো ৩ হাজার ৩৬ বিএইচপির ইঞ্জিন সংযোজন করেন। পরিবর্তিত ইঞ্জিন লঞ্চটির জন্য উপযুক্ত কি না, তা উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পরীক্ষা করানো হয়নি।

অভ্যন্তরীণ জাহাজ বিধিমালা অনুযায়ী, কোনো নৌযানে ১ হাজার ২০ কিলোওয়াট বা ১ হাজার ৫০১ দশমিক ৯২ বিএইচপির চেয়ে বেশি ক্ষমতার ইঞ্জিন সংযোজন করলে লঞ্চে ইনল্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ার (আইএমই) নিযুক্ত করতে হয়। কিন্তু লঞ্চটিতে এই পদের কেউ ছিলেন না।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের অনুমতি না নিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ ডকইয়ার্ডে লঞ্চটিতে পুরোনো ইঞ্জিন সংযোজন করার কারণে ডকইয়ার্ডের মালিককেও এ ঘটনার জন্য দায়ী করা হয়েছে।

কর্মকর্তাদের চরম অবহেলা
প্রতিবেদনে কমিটি বলছে, প্রায় তিন মাস বসে থাকার পর লঞ্চটি আবার চালু হয়। এ সময় নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারক ও পরিদর্শক এবং বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শকেরা কেউই ভালোভাবে লঞ্চটি পরীক্ষা করেননি।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক মো. মাহবুবুর রশিদ লঞ্চটির ইঞ্জিন পরিবর্তনের বিষয়ে খোঁজ রাখেননি। তিনি লঞ্চটি পরিদর্শন করে চলাচলের জন্য অনুমতি দিতে সুপারিশ করেছিলেন। জাহাজ জরিপকারক তাঁর ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন।

লঞ্চটি প্রায় তিন মাস বন্ধ থাকার পর ঢাকা-বরগুনা রুটে ১৯ ডিসেম্বর প্রথম যাত্রা করে। ২৩ ডিসেম্বর করে দ্বিতীয় যাত্রা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সদরঘাটে নিয়োজিত নৌপরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ১৯ ও ২৩ ডিসেম্বর লঞ্চটি পরিদর্শন করেননি।

২৩ ডিসেম্বর হাবিবুর রহমান অন্য একটি তদন্তকাজে ব্যস্ত ছিলেন বলে তদন্ত কমিটির কাছে দাবি করেন। কিন্তু দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ তিনি দেখাতে পারেননি।

সদরঘাটে কর্মস্থল হওয়া সত্ত্বেও হাবিবুর রহমান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর লঞ্চটি পুনরায় চালু হওয়ার সময় পরিদর্শন বা কোনো অনুসন্ধান না করে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে চরম অবহেলার পরিচয় দিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছে কমিটি।

লঞ্চটির যান্ত্রিক ত্রুটি সারানোর পর পুনরায় সার্ভিসে আসার বিষয়টি অবগত হওয়া সত্ত্বেও বিআইডব্লিউটিএর নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের যুগ্ম পরিচালক জয়নাল আবেদীন নৌপরিবহন অধিদপ্তরের জাহাজ জরিপকারককে বিষয়টি না জানিয়ে যথাযথ ভূমিকা পালন করেননি বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে বিআইডব্লিউটিএর যে পরিবহন পরিদর্শক অভিযান-১০ লঞ্চকে ‘ত্রুটি নেই’ বলে যাত্রা শুরুর অনুমতি দিয়েছিলেন, সেই দিনেশ কুমার সাহার নাম তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।

সদরঘাটে বিআইডব্লিউটিএর সাতজন পরিবহন পরিদর্শক এবং নৌপরিবহন অধিদপ্তরের একজন পরিদর্শক দায়িত্ব পালন করেন।

এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭
ফাইল ছবি

কীভাবে আগুন লেগেছিল
লঞ্চের ইঞ্জিন থেকে যেভাবে আগুনের সূত্রপাত হতে পারে, সে সম্পর্কে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে তদন্ত কমিটি।

প্রথমত, ইঞ্জিন রুমের পোর্ট সাইডের মেইন ইঞ্জিনের ৩ নম্বর ইউনিটের ইন্ডিকেটর কক খোলা ও লকিং নাটটি আলগা অবস্থায় পাওয়া গেছে। ইঞ্জিন চালু অবস্থায় ইউনিটগুলোর ভেতরের (এগজস্ট টেম্পারেচার) তাপমাত্রা প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড থাকে। ইন্ডিকেটর কক খোলা থাকার অর্থ ১৩০ বার (ইউনিট) প্রেশারে প্রায় ৪০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার আগুনের ফুলকি প্রতি ফায়ার স্ট্রোকে বের হয়। ইন্ডিকেটর ককের লকিং নাট আলগা থাকায় ঝাঁকুনিতে আস্তে আস্তে ইন্ডিকেটরটি খুলে যায়। ফলে আগুনের ফুলকির সংস্পর্শে এসে চারপাশের বাতাস অনেক গরম হয়। ইঞ্জিনকক্ষে কোনো চালক কিংবা গ্রিজার না থাকায় এই গরম বাতাস একপর্যায়ে ইঞ্জিনকক্ষে রাখা ডিজেল ট্যাংকের সংস্পর্শে এলে, তা পুরোপুরি আগুনে রূপ নেয়। লঞ্চটিতে ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনসহ অনেক সহজ দাহ্য বস্তু ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে তাপায়িত হওয়ার কারণে স্টিল বডির মাধ্যমে পরিবাহিত হয়ে আগুন দ্রুত পুরো লঞ্চে ছড়িয়ে পড়ে।

দ্বিতীয়ত, ইঞ্জিনটির বিভিন্ন ইউনিটের এগজস্ট ভালভ বা ইনজেকটরের ত্রুটির কারণে অতিরিক্ত ফুয়েল এগজস্ট মেনিফোল্ডে গিয়ে জমা হয়। যার ফলে তাপমাত্রা (এগজস্ট টেম্পারেচার) অনেক বেড়ে যায়। পরবর্তী সময়ে তা টার্বো চার্জার দিয়ে যাওয়ার পথে সার্জিংয়ের সৃষ্টি করে। অতিরিক্ত এগজস্ট টেম্পারেচার হওয়ায় সার্জিং হয়। টার্বো চার্জার সার্জিং হলে প্রচণ্ড শব্দ হয়। টার্বো চার্জার সার্জিংয়ের কারণে স্কেভেঞ্জিং প্রেশার ড্রপ করে। যার ফলে ইঞ্জিনের ভেতর ফায়ারিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় বাতাসের ঘাটতি হয়। এতে ইঞ্জিন দুই থেকে তিনবার বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু চালক আবার ইঞ্জিন চালু করে নৌযানটির যাত্রা চালু রাখেন।

তৃতীয়ত, নতুন বা শক্তিশালী ইঞ্জিন স্থাপন করলে ইঞ্জিনের অনুপাতে পাইপলাইন, এগজস্ট পাইপে পরিবর্তন করতে হয়। যদি এগজস্ট পাইপ আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি না করা হয়, তাহলে এগজস্ট ব্যাক প্রেশার সৃষ্টি হতে পারে। এতে ইঞ্জিনের ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। এগজস্ট মেনিফোল্ডের তাপমাত্রা ৫৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৭৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এগজস্ট মেনিফোল্ড তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে ইঞ্জিন রুমের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। এতে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হতে পারে।

করণীয় ও সুপারিশ
অভিযান-১০ লঞ্চের অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা রোধে তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে ২৫টি করণীয় ও সুপারিশ উল্লেখ করেছে। এর মধ্যে অন্যতম ‘রোটেশন’ প্রথা বন্ধ করা।

এ ছাড়া রয়েছে প্রধান প্রধান নদীবন্দর অথবা ঘাট ছেড়ে যাওয়ার আগে (বিশেষ করে সাপ্তাহিক ছুটি ও উৎসব উপলক্ষে যাত্রীর চাপের সময়) নৌপরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএর পরিদর্শকদের যথাযথভাবে যাত্রীবাহী লঞ্চ পরিদর্শন করা। ঘন ঘন ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা। প্রয়োজনীয় সংখ্যায় জনবল বাড়ানো।

লঞ্চের ইঞ্জিনকক্ষের আগুন নেভানোর জন্য স্থায়ী কার্বন ডাই-অক্সাইড সিস্টেম থাকা বাধ্যতামূলক করতে বলেছে কমিটি।

লঞ্চে অগ্নিপ্রতিরোধের ব্যবস্থা সঠিক আছে কি না, তা ফায়ার সার্ভিস বিভাগের মাধ্যমে কমপক্ষে প্রতি তিন মাস অন্তর বাধ্যতামূলকভাবে পরীক্ষা করার কথা বলা হয়েছে।

লঞ্চের সব কর্মীর অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র পরিচালনা বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক প্রশিক্ষণ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে।

লঞ্চের ইন্টেরিয়র ডেকোরেশনে দাহ্য পদার্থ ব্যবহার না করার পাশাপাশি ইঞ্জিন রুমের আশপাশে দাহ্য পদার্থ না রাখার সুপারিশ রয়েছে।

প্রত্যেক নাবিকের ইউনিফর্ম পরা নিশ্চিত করা, আইন অনুযায়ী যাত্রীবাহী লঞ্চের বিমা বা নৌ দুর্ঘটনা ট্রাস্ট ফান্ড বাধ্যতামূলক করা, জরুরি নির্গমনপথ নিশ্চিত করারও সুপারিশ করেছে কমিটি।

ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে গত ২৩ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৭।

লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন অধিদপ্তর, ফায়ার সার্ভিস ও ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি সাত সদস্যের।