অল্প সময়, ক্ষতটা গভীরে
অল্প সময়ের বিদায়ে অনিশ্চয়তা জড়িয়ে যায়। কাঠফাটা রোদে খেয়াঘাটের দিকে এগিয়ে আসা মানুষের ঘাম গড়িয়ে নামছে চিবুকে। দুই হাতে বোঝা আঁকড়ে থাকায় মুছে নেওয়ার সুযোগ নেই এখন। চোখেমুখে বিষণ্নতা। এমন দুটি দলের সঙ্গে দেখা হলো শ্যামনগরে পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বন্যতলায়। একদলের সঙ্গে আছে নারী ও শিশু। বিদায় জানাতে যতদূর সম্ভব এসেছে। সঙ্গে পরিবার না থাকায় আরেকটি দল এগিয়ে গেল এদের ছাড়িয়ে। ফলে ঘাটের খেওয়া পাওয়া নিয়ে শুরু হবে ঝামেলা। প্রথম দলটি প্রতিবেশী প্রতাপনগর ইউনিয়নের। পদ্মপুকুরের পাখিমারা ঘাট থেকে নওয়াবেঁকী হয়ে মুন্সিগঞ্জ (শ্যামনগর) বাসস্ট্যান্ডে যাবে। গন্তব্য ঢাকার সাভারের বিভিন্ন ইটভাটা। কোনো দল যাবে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত। জলজঙ্গল করা মানুষেরা ছুটছেন ইট বানাতে। ভাটি থেকে ভাটার জীবনের এ অস্থায়ী অভিবাসন নির্ভর করে দাদনমালিকের ওপর। কয়েক মাস আগে সরদার দাদন দিয়ে রাখে। একজন সরদার প্রতিটি গ্রামের ২০ থেকে ২৫ জন বনজীবীকে নিয়ে যান ইটভাটায় কাজ করাতে। কোথায় যাচ্ছেন শ্রমিক হওয়া মানুষটি, তা নিজেও জানেন না। পৌঁছানোর পর পূর্বনির্ধারিত কর্মস্থলে জনবল বেশি হলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্য কোথাও।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে উপকূলের জনজীবনে লোনাপানির প্রভাব, বাঁধের বসতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি, চিংড়ির ঘেরে ফসলের উর্বরতা হ্রাস বা উদ্বাস্তু হয়ে জনসংখ্যায় মিশে যাওয়ার খবরগুলো আলোচনায় কমবেশি উঠে আসছে। কিন্তু একই কারণে এ অঞ্চলের মানুষের অস্থায়ী অভিবাসী হওয়ার সঙ্গে আছে ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক সম্পর্ক বদলের ঘটনা।
প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে সাতক্ষীরার শ্যামনগরের বিভিন্ন ইউনিয়ন আর খুলনার কয়রার কিছু গ্রাম পুরুষশূন্য হতে শুরু করে। বন বিভাগের পাস পেলে এবং মাছ ধরার নৌকা, জাল ও দুই সপ্তাহের খাবার মজুত করতে পারলে একদল যায় সাগরে। অন্য দলটি ছোটে সরদারের দাদন নিয়ে শহরের ইটভাটায়। নুনের বিষে খুন হয়ে যাওয়া এ জনপদে কাজ নেই। ইটভাটায় কাজ করতে যাওয়া উপকূলীয় শ্রমিকদের চুক্তির মেয়াদ তিন থেকে ছয় মাস। এ সময়ের মধ্যে পরিবারের কারও মৃত্যুসংবাদ ছাড়া ফেরার সুযোগ নেই বাড়িতে। তাঁদের মধ্যে দু–একজন যাঁদের সামান্য পুঁজি থাকে, তাঁরা দাদনের দায় এড়াতে চায়। পরিবারের সদস্যসংখ্যা অল্প হলে সঙ্গে নিয়েই ছোটে। স্ত্রী, বোন বা ভাইও কাজ করে ভাটায়। সেখান থেকে আবার অন্য কোথাও যায় পরিবারটি; ফিরে আসা হয় না আর পরিচিত পরিবেশে। একজীবনে আর কখনো দেখা হয় না সেই মানুষের সঙ্গে, যাঁর হাতে হাত রেখে গত ভাঙন ঠেকাতে নেমেছিলেন খোলপেটুয়ার তীব্র স্রোতে। ফিরে আসা মানুষদের জীবনের গল্পটা আবার অন্য রকম।
বন্যতলায় ওয়াপদার ক্লোজারের পাশে বাঁধ। এ বাঁধ ধরে প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটলে ওয়াজিয়ার গাজীর বাড়ি। সড়ক থেকে প্রায় চার–পাঁচ হাত নিচু জমিতে ঘর। রোদের তাপে সামান্য দূরেও মরীচিকা দেখা যাচ্ছে তখন। ওয়াজিয়ার গাজির বাড়িতেই আশ্রয় নিলাম রোদের জন্য। গোলপাতার একটি ঘরের সামনে দেড় হাত প্রশস্ত মাটির উঠান। সেখানে বসে পা থেকে শামুকের ভাঙা অংশ খুঁটে তুলছেন ওয়াজিয়ার গাজীর মা। বৃদ্ধাকে একটু আগেই আমরা হাঁটুকাদা ভেঙে ফিরতে দেখেছি। ওয়াজিয়ার গাজীর বাঁ হাতের পেশি দেখলে হঠাৎ কুস্তিগির মনে হতে পারে। রোদে পোড়া তামাটে শরীরের মানুষটি জানান, মৃত্যু খুব কাছ থেকে দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে পরিবার থেকে আর বিচ্ছিন্ন হবেন না। পেশির ফুলে থাকা অংশটি আসলে শরীরের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া দলা পাকানো একটি মাংসপিণ্ড।
আম্পানের পর এ অঞ্চল লোনাপানিতে তলিয়ে গেলে তাঁর আর কাজ ছিল না। বনে যাওয়ায় আছে নিষেধাজ্ঞা। পাখিমারার গণি আমিন নামের এক সরদারের কাছ থেকে দাদন নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকার ভাটায় ইট পোড়ানোর সময় পাশে ডাই করে রাখা উঁচু মাটির স্তূপ শরীরের ওপর নেমে আসে। চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় আরেক সহশ্রমিক। ওয়াজিয়ারের হাতের পেশি ছিড়ে নেমে যায় কিছুটা নিচুতে। বাড়িতে ফেরত পাঠানো হয় তাঁকে। ক্ষতিপূরণ হিসেবে এক হাজার টাকাও দেয়নি ভাটামালিক বা দাদন সরদার। এখন ওয়াজিয়ার এক হাতে কাজ করেন। আর তাঁর বৃদ্ধ মা শামুক খুঁটে আনেন।
এই জনপদের খবর ভালো রাখেন স্থানীয় মানুষ। অস্থায়ী অভিবাসীদের জীবন মূল থেকে কতখানি বিচ্ছিন্ন, সে প্রসঙ্গে শ্যামনগরের সাংবাদিক পীযূষ বাউলিয়া বললেন, ‘অভাবের কারণে মানুষের নৈতিকতা বদলায়। তাঁরা দীর্ঘ সময় পরিবার বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকেন; এর মধ্যে ঝড় আসে, নদী ভাঙে। পরিবারের মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে বাঁধে আশ্রয় নেয়। সেখানেও হয়তো আবার আরেক বিপর্যয় ঘটে। ওদিকে স্ট্যাম্প লাগানো কাগজে দস্তখত দেওয়া মানুষেরা পালিয়ে আসতে পারেন না মহাজনের কাছ থেকে। দাদনের টাকা দিতে না পারলে পরে আবার যেতে হয় শ্রম দিয়ে সে টাকা শোধ করতে। ফিরে এলেও অনেক সময় দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী হয়তো সন্তান নিয়ে ভাসমান হয়ে গেছেন। এসবই চিংড়ির ঘের, লবণাক্ততার কারণে কর্মসংস্থান হারানোর ফল। পঙ্গু হয়ে যাওয়া ওয়াজিয়ারের মেয়ে রাবেয়া বন্যতলার এমন এক পরিবারের গল্প জানালেন, ‘আম্পানের পর ওয়াপদার বাঁধে উঠেছিল রবিউল সানার পরিবার। রবিউল দিনমজুরের কাজ শুরু করে। অভাবী জায়গায় সে কাজ করানোর মানুষও নেই। দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে কয়েক দিনের চাল–ডাল কিনে দিয়ে চলে যায় ভাটায় কাজে। মাসখানেক পরই হঠাৎ নিখোঁজ হয় রবিউলের ১২ বছরের মেয়ে জিন্নাত। দুজন নারীর সঙ্গে পাচার হয়ে গিয়েছে ভারতে।’ জিন্নাতের খাবার জোটাতে যাওয়া ইটভাটার শ্রমিক বাবা জানেননি, আনমনা হওয়ায় হাতের আঙ্গুলে যখন হাতুড়ির আঘাত লেগেছিল, ঠিক তখন হয়তো তাঁর সন্তানের শরীরে দেওয়া হচ্ছিল চেতনানাশক ইনজেকশন। এমন আয়ের মানুষদের মামলা করার অর্থ ও সাহস কোনোটিই থাকে না।
আম্পানের পর লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ায় কর্মহীন হওয়ার সংখ্যা বেড়েছে এ অঞ্চলে। অস্থায়ী অভিবাসী হয়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে পারিবারিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার গল্প, সন্তান হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা, মায়ের সঙ্গে উপার্জনকারী ছেলের আর কোনো দিন দেখা না হওয়ার কষ্ট। স্বস্তির বিষয়, এসব মানবিক গল্পের জরিপ হয় না।
তাই কোনো একদিন হঠাৎ সংখ্যা শুনে আমাদের আতঙ্কিত হওয়ার শঙ্কা নেই। কাগজে–কলমে হিসাব নেই, কত মানুষ প্রতিবছর এ সময় বনজীবী থেকে ইটভাটার শ্রমিক হন; কত মানুষ আর কোনো দিন ফিরে আসেন না।
বন্যতলায় দেখা হওয়া আনিসুর রহমান, সবুর গাজীদের সঙ্গে আপনজন ছিল না। তাঁরা এসেছেন কয়রা থেকে কপোতাক্ষ নদের খুঁটিঘাট হয়ে। তাঁরা পদ্মপুকুরের পাখিমারা থেকে আরেক দলের সঙ্গে মিলে রওনা হবেন দেশের বিভিন্ন ভাটার দিকে। অন্য দলটির সঙ্গে থাকা নারী, শিশুরা এসেছিল এগিয়ে দিতে। মানুষখেকো ও রকম মেজাজি রোদে তাঁরা সন্তান কোলে নিয়ে দ্রুত হাঁটতে পারছেন না। সঙ্গে আছে মাঝেমধ্যে গোপনে চোখ মুছে নেওয়ার যন্ত্রণা। উদ্বেগ আর হারানোর ভয়ের ছাপ চোখেমুখে। মানুষটি ফিরে না–ও আসতে পারেন। বিপরীতে আসতে পারে বড় কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। সে দুর্যোগে উন্মূল হতে পারে পরিবারটি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিপর্যয় মোটা দাগে স্পষ্ট। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি এর যে বিরূপ প্রভাব, সে ক্ষত গভীরে। তারই একটি অস্থায়ী অভিবাসন। উপকূলের কয়েকটি গ্রামে প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝি থেকে শুরু হয় কাজের খোঁজে বাড়ি ছাড়ার যাত্রা। চিরস্থায়ী বিদায়ে শোক আর স্মৃতির ওজন অধিক। কিন্তু সাময়িক অভিবাসী হওয়া জীবনের এই ক্ষণস্থায়ী বিদায় আশ্বাস নয়, অনিশ্চয়তার।