অস্ত্রধারীরা ধরা পড়ে না

চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে সাড়ে তিন বছরে ১৩টি ঘটনায় ১৯ জনের ছবি ও ভিডিও বের হয়। গ্রেপ্তার কেবল চারজন।

চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন ও আধিপত্য বিস্তারসহ বিভিন্ন মারামারিতে গত সাড়ে তিন বছরে অস্ত্রবাজির অন্তত ১৩টি ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে। এসব ঘটনায় অস্ত্র হাতে থাকা ১৯ জনের ছবি ও ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁদের মধ্যে পেশাদার সন্ত্রাসীর পাশাপাশি যুবলীগ ও ছাত্রলীগের পদধারী নেতাও রয়েছেন।

প্রথম আলোর অনুসন্ধানে দেখা যায়, এসব অস্ত্রধারীর বেশির ভাগই ধরা পড়েনি। এখন পর্যন্ত চিহ্নিত হয়েছে ১২ জন, তাঁদের মধ্যে কেবল ৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে।

২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এসব অস্ত্রবাজির ঘটনার মধ্যে নয়টি চট্টগ্রামে এবং চারটি নোয়াখালীতে ঘটে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে নয়টি। চট্টগ্রামের চারটি ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। দুর্বৃত্তদের প্রদর্শিত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে পিস্তল, শটগান, এলজি ও বন্দুক।

অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারে উদ্বিগ্ন নাগরিক সমাজ। তারা এসব ঘটনার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গাফিলতি ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে দায়ী করেছে।

তবে চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সম্প্রতি প্রকাশ্যে অবৈধ অস্ত্রধারী যারা নজরে এসেছে কয়েকজনকে ধরেছি, বাকিদের ধরার চেষ্টা করছি।’ চারটি ঘটনায় মামলা না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অস্ত্র উদ্ধার না হওয়ায় মামলা করা যায়নি। এরপরও বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

সর্বশেষ গত রোববার নোয়াখালী জেলা শহরে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও ধাওয়া চলাকালে চার তরুণের হাতে প্রকাশ্যে অস্ত্র দেখা গেছে।

এর আগে গত ৩০ আগস্ট চট্টগ্রামের চন্দনাইশে শোক দিবসের কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত হয়। এর একপর্যায়ে সেখানে অস্ত্র উঁচিয়ে গুলি ছোড়েন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাবেক সদস্য গিয়াস উদ্দিন ওরফে সুজন। গুলি ছোড়ার ভিডিও চিত্র পরে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। চার দিন পর ৪ সেপ্টেম্বর র‍্যাব রিভলবার, পিস্তলসহ গিয়াস উদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে।

অভ্যন্তরীণ সংঘাতে অস্ত্রের ব্যবহার

নোয়াখালীর বসুরহাট পৌরসভা এলাকায় গত ১৩ মে মেয়র আবদুল কাদের মির্জার দুই অনুসারী অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষের লোকজনকে ধাওয়া ও গুলি করে। ওই ঘটনায় মেয়র কাদের মির্জার দলীয় প্রতিপক্ষ কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমানের পাঁচজন অনুসারী আহত হন। মামলা হলেও পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

ওই হামলা ও অস্ত্র প্রদর্শনের ঘটনার ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার (ভাইরাল) পর শনাক্ত হয় যে অস্ত্রধারী দুজন হলেন সহিদ উল্যাহ ওরফে কেচ্ছা রাশেল (২৫) ও আনোয়ার হোসেন ওরফে পিচ্ছি মাসুদ (২৮)। দুজনের বিরুদ্ধে ১০টির বেশি করে মামলা রয়েছে।

অস্ত্রধারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।
আখতার কবির চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, সুজন, চট্টগ্রাম

কাদের মির্জা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই। নিজ ভাই-ভাবি এবং দলীয় সাংসদদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে নানা অভিযোগ তুলে কাদের মির্জা সারা দেশে আলোচনায় আসেন। এর জেরে কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগে বিভক্তি দেখা দেয়, যা একপর্যায়ে সংঘাতে রূপ নেয়। আর এই সংঘাতে ১৯ ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির (২৫)। এর ১৮ দিনের মাথায় ৯ মার্চ বসুরহাট পৌরসভা কার্যালয়ের কাছে আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান শ্রমিক লীগের ওয়ার্ড সভাপতি মো. আলাউদ্দিন (৩২)। দুই ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দুটি নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কিন্তু কোনো ঘটনায় এখনো পর্যন্ত গুলিবর্ষণকারীদের চিহ্নিত করতে পারেনি পুলিশ।

সর্বশেষ গত রোববার বিকেলে নোয়াখালী জেলা শহরে আওয়ামী লীগের বিবদমান দুই পক্ষ—সাংসদ একরামুল করিম চৌধুরী এবং সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শিহাব উদ্দিনের অনুসারীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলা ও ধাওয়া চলাকালে অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষকে লক্ষ্য করে গুলি করেন এক তরুণ। এ ছাড়া ঘটনাস্থলে ছিলেন অস্ত্রধারী আরও তিনজন। এর মধ্যে পুলিশ এক তরুণের পরিচয় শনাক্ত করার দাবি করলেও তাঁকে গতকাল দুপুর পর্যন্ত গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রকাশ্যে অস্ত্র হাতের ভিডিও পুলিশের কাছে রয়েছে। তাদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

‘অস্ত্রধারীদের হাতে কেউ নিরাপদ নয়’ উল্লেখ করে এসব দুর্বৃত্তকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খাইরুল আনম চৌধুরী।

নির্বাচনী সহিংসতায় অস্ত্রবাজি

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনের দিন পাথরঘাটা এলাকায় গুলি ছুড়তে থাকা পিস্তল হাতে যুবকের ছবি বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর নাম আ ফ ম সাইফুদ্দিন। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সহসভাপতি। ওই দিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষের সময় একটি গলিতে কালো প্যান্ট ও জ্যাকেট পরা সাইফুদ্দিনকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। পুলিশ তাঁকে এখনো খুঁজে পায়নি।

সাইফুদ্দিন এখনো সংগঠনের পদে বহাল আছেন। এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ইমরান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সাইফুদ্দিন কি না, আমরা নিশ্চিত নই।’

তবে ওই অস্ত্রধারী যুবক যে সাইফুদ্দিন, কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নেজাম উদ্দিন তা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, সাইফুদ্দিনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুটি খুনের ঘটনায়ও প্রকাশ্যে অস্ত্রের ব্যবহার হয়। নির্বাচনের দিন খুলশীতে একটি ভোটকেন্দ্রের সামনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষে গুলিতে আলাউদ্দিন নামের দিনমজুর নিহত হন। এর আগে ১২ জানুয়ারি পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ও বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিতে নিহত হন আজগর আলী নামের এক মহল্লা সরদার। দুটি ঘটনার ভিডিও পুলিশ উদ্ধার করলেও অস্ত্রধারীকে শনাক্ত করতে পারেনি।

এর আগে ২০১৮ সালের ২৯ মার্চ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের গোসাইলডাঙ্গা ওয়ার্ডের উপনির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের বাইরে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থী বিবি মরিয়মের পক্ষে চার যুবক প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিয়ে কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তার করেন। ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়লেও বিজয়ী বিবি মরিয়ম দাবি করেন, অস্ত্রধারীদের তিনি চেনেন না।

২০১৮ সালের ৩০ মার্চ প্রথম আলোতে অস্ত্রধারীদের ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রথম আলোর অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই চার অস্ত্রধারীর মধ্যে রাকিব হায়দার এম ই এস কলেজের ছাত্র, তাঁর হাতে ছিল পিস্তল। অস্ত্রধারী আরেক যুবক মাহমুদুর রশিদ ওরফে বাবু, তিনি নগর ছাত্রলীগের সদস্য। বাকি দুজনের পরিচয় শনাক্ত হয়নি।

ওই অস্ত্রধারীদের গ্রেপ্তারের কোনো চেষ্টাও নেই পুলিশের। এই বিষয়ে বন্দর থানার ওসি নিজাম উদ্দিন গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় এখনো কোনো মামলা হয়নি।

পেশাদার সন্ত্রাসীদের অস্ত্র প্রদর্শন

চলতি বছরের ১১ জুন চট্টগ্রামের বাকলিয়া কালা মিয়া বাজার আবদুল লতিফ হাটখোলা রোডে বড় মৌলভি বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে ‘বিনা মূল্যে কবর দেওয়া হয়’ লেখা সাইনবোর্ড লাগাতে গেলে স্থানীয় সাইফুল্লাহ মাহমুদের পরিবারের ওপর আক্রমণ চালান সেখানকার মো. এয়াকুব বাহিনীর লোকজন। দুই পক্ষের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হন চারজন।

প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনার দিন এয়াকুব ও তাঁর সহযোগী জাহেদুল ও মো. ওয়াসিমের হাতে ছিল পিস্তল, মহিউদ্দিনের হাতে ছিল একনলা বন্দুক, এলজি ছিল আলী আকবর ও মো. নেজামের হাতে। এই ঘটনায় করা মামলায় পুলিশ অস্ত্রধারীদের মধ্যে এয়াকুব ও জাহেদুলকে গ্রেপ্তার করে। বাকিরা পলাতক। অস্ত্রধারীরা পেশাদার সন্ত্রাসী। পুলিশ জানায়, জায়গা দখলসহ আধিপত্য বিস্তারে তাঁরা ভাড়াটে সন্ত্রাসী হিসেবে ব্যবহৃত হন।

ওই ঘটনার মামলার বাদী ও গুলিতে আহত সাইফুল্লাহ মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীদের বেশির ভাগই গ্রেপ্তার না হওয়ায় তাঁরা আতঙ্কে আছেন।

বাকলিয়া থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে গত ২৩ জুন চাক্তাই রাজাখালী বিশ্বরোড এলাকায় ট্রাকস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এর জেরে ৩৫ নম্বর বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের নেতা পরিচয় দানকারী মহিউদ্দিন জনিকে অস্ত্র হাতে প্রতিপক্ষ মো. সায়েমকে শাসাতে দেখা গেছে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরার ফুটেজে। এই ঘটনায়ও মামলা হয়নি।

এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি সিটি নির্বাচনের দিনও রাজাখালী ফায়ার সার্ভিসের সামনে নির্বাচনী প্রতিপক্ষকে অস্ত্র হাতে তাড়া করতে দেখা যায় এই মহিউদ্দিন জনিকে। ওই ভিডিওটিও ছড়িয়ে পড়ে।

বকশিরহাট ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মান্না বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, মহিউদ্দিন যুবলীগের কেউ নন। দলের নাম ভাঙানোর কারণে এর আগে তাঁকে সতর্ক করা হয়েছিল।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি স্কুলছাত্র আদনান ইসফার খুনে ব্যবহার হওয়া অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি। একই বছরের ১৬ ফেব্রুয়ারি এক কিশোরকে গুলি করতে যাওয়ার পথে পুলিশের তল্লাশিতে পড়ে একটি কিশোর দল। তারা সেখানে পুলিশকেও গুলি করে। গ্রেপ্তার তিন কিশোর পরে আদালতে জবানবন্দিতে বলে, মো. ফারুক ওরফে টোকাই ফারুক নামে যুবলীগ নামধারী এক নেতা অস্ত্রটি তাদের দিয়েছিলেন। পরে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।

প্রকাশ্য অস্ত্রধারী ও খুনের ঘটনায় ব্যবহার করা অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রধারীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকলে এ ধরনের ঘটনা আরও বাড়বে। মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে।