আকাশের কাছে স্কুলের চেয়ে গরু পালন কেন গুরুত্বপূর্ণ

আকাশ কালিন্দী
ছবি: নাজনীন আখতার

তুমি কোন ক্লাসে পড়ো?

—ফাইভে। এখন স্কুলে যাই না।

কেন?

—গরুগুলো দেখতে হয় যে (ঘাস খেতে থাকা গরুগুলোর দিকে নির্দেশ করে)!

১৩ এপ্রিল হবিগঞ্জের ‘বৃন্দাবন টি এস্টেট’ চা–বাগানে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল ১২ বছরের শিশু আকাশ কালিন্দীর সঙ্গে। গরু পালনের অজুহাতে চা–বাগানের এই শিশুটি স্কুলে যায় না। ওর বাবা–মা দীনেশ কালিন্দী আর পুতুল কালিন্দী চা–বাগানের কর্মী।

ওই দিন ঘণ্টা দুয়েকের চা–বাগান সফরে গরু অন্যের জিম্মায় দিয়ে আমার সঙ্গী হয়েছিল আকাশ। নানা কথায় তার পরিবার সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া গেল। সেই সঙ্গে সে স্কুলে অনিয়মিত কেন, তা নিয়ে আরও প্রশ্ন করার সুযোগ হলো। জবাবে তার অনেক ‘যুক্তি’। বড় বোন ছিল। অসুস্থতায় বোনের মৃত্যুর পর সে এখন মা–বাবার একা সন্তান। মা–বাবা দুজনই সকালে কাজে বেরিয়ে যায়। তাহলে সে ছাড়া গরুগুলো কে দেখবে?

আকাশের কাছে স্কুলের চেয়ে গরু পালন গুরুত্বপূর্ণ—কিন্তু কেন? নিজেকেই প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করলাম। বাগানের বিনা মূল্যের স্কুলে পড়তে তার খরচ লাগে না। মা–বাবা দিনে ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করেন। মা স্থায়ী কর্মী হওয়ার কারণে বাগানে থাকার ঘর পেয়েছে। আড়াই টাকা কেজি দরে সপ্তাহে ৪ কেজি আটা রেশন পায়। এতটুকুন সুবিধা আকাশকে সুন্দর ও স্বাভাবিক শৈশব দেওয়ার কোনো নিশ্চয়তা দেয় না ঠিকই। কিন্তু ন্যূনতম পড়ালেখা করার নিশ্চয়তা তো দেয়!

মনের মধ্যে খচখচানি। আবার জানতে চাইলাম ‘গরু দেখার জন্য তুমি স্কুলে যাবে না?’ একগাল হেসে আকাশের একই উত্তর ‘কী করব! গরুগুলো তাহলে কে দেখবে?’

তার মানে আকাশ কি ‘পাঠে আমার মন বসে না...’ ঘরানার ছেলে! আকাশের স্কুলের নাম ‘বৃন্দাবন চা–বাগান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’। বাগানের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত স্কুলটিতে ৪৭ বছর ধরে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন নিতাই বুনার্জি। যাঁর মা–বাবাও একসময় চা–বাগানের কর্মী ছিলেন। ঢাকায় ফিরে নানা মাধ্যম হয়ে নম্বর জোগাড় করে ২৭ এপ্রিল ষাটোর্ধ্ব নিতাই বুনার্জির মুঠোফোনে কল দিলাম। ‘স্যার, আকাশ কি স্কুলে আসে না?’ তিনি তখন স্কুলেই ছিলেন। খাতা দেখে জানালেন, ‘১ জানুয়ারি আকাশ স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভের বই নিয়ে গেছে। এরপর এই কয় মাসে এক দিনও আসেনি। আকাশের মা–বাবার ফোন নেই। লোক মারফত কয়েকবার ডেকে পাঠিয়েছিলাম। তাঁরাও আসেননি। তাই কেন সে আর স্কুলে আসে না, সেটা জানতে পারিনি।’ তিনি জানান, স্কুলটিতে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। ২৫০ শিশু পড়ছে। গত বছর চতুর্থ শ্রেণিতে আকাশসহ ৩০টি শিশু পড়ত। এখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে ২৫ জন। অনিয়মিত হওয়ায় দুই শিশুকে চতুর্থ শ্রেণিতেই রেখে দেওয়া হয়েছে। আকাশসহ তিন শিশু নানা অজুহাতে স্কুলে আসছে না।

ইউনিসেফের সহায়তায় ‘সিলেট বিভাগের চা–বাগানের নারী ও শিশুদের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদারে করণীয়’ শিরোনামে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) এ বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরপর চা–বাগানের ৫ শতাংশ শিশু স্কুলে ফেরেনি। জাতীয়ভাবে শিশুদের ঝরে পড়ার হার আরও বেশি। বাংলাদেশে শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে, দেশে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ১৭ শতাংশ এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ঝরে পড়ার হার ৩৬ শতাংশ।

আকাশের কাছে স্কুলের চেয়ে গরু দেখভাল বেশি গুরুত্বপূর্ণ কেন? মাথায় এই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। আকাশের মতো অনেক শিশুর শিক্ষায় অনাগ্রহী হয়ে ওঠার পেছনে আমরা প্রত্যেকেই কি কমবেশি দায়ী নই! শুধু ভালো শিক্ষা, ভালো বই আর সরঞ্জাম দিয়ে শিক্ষায় টান তৈরি করা যায় না। কী কী উপায়ে শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, সেটা নিয়েও ভাবা জরুরি। বিশেষ করে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশুদের কাছে স্কুলটিকে আনন্দদায়ক করতে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা যতটুকু ভূমিকা পালন করার কথা, ততটুকু কি তাঁরা করছেন?

জার্মানিতে প্রথম স্কুলে যাওয়া রীতিমতো উৎসবের ব্যাপার। সে দেশে প্রথম স্কুলে যাওয়া শিশুদের হাতে ‘স্কুল কোন’ নামে কার্ডবোর্ডের একটি বিশালকায় কোন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সেই বর্ণিল কোনের ভেতর থাকে চকলেট, ইরেজার, পেনসিল, খেলনা ইত্যাদি। দুই শ বছরের বেশি সময় ধরে এই রেওয়াজ আছে দেশটিতে। শিক্ষার মাধ্যমে নতুন জীবনে প্রবেশের একটি প্রতীকী উপহারটি আসে এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে। (সূত্র: বিবিসি)

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক তাপস কুমার বিশ্বাস শিশুদের শিক্ষা প্রসঙ্গে আমাকে বললেন, ‘একবার গবেষণার কাজে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলায় গিয়েছিলেন। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় কিছু শিশু কেন ঝরে পড়ছে, তা জানতে। এক শিশুকে পেয়েছিলেন যার মা জানতেনই না ছেলে পরীক্ষা দেয়নি। তিনি সকালে খড়ি কুড়াতে গিয়েছিলেন। আর ছেলে পরীক্ষা বাদ দিয়ে মাছ ধরতে চলে গিয়েছিল। এই শিক্ষকেরও মতে, একটা শিশুকে শেখার বিষয়ে আগ্রহী করে তুলতে শিক্ষক ও অভিভাবকের যে ভূমিকা রাখার কথা, তার ঘাটতি রয়েছে আমাদের দেশে। স্কুলগুলোকে শিক্ষার্থীদের জন্য আনন্দদায়ক করার দায়িত্ব শিক্ষক যথাযথ পালন করতে পারছেন না। তাঁরা পরীক্ষার জন্য পড়ান, শেখানোর জন্য পড়ান না। ফলে পরীক্ষাভীতি আর শাস্তির ব্যবস্থাই সেখানে ইস্যু হয়। শিশুটির কাছে স্কুল আনন্দদায়ক কিছু হয় না। তিনি বললেন, ‘প্রশিক্ষিত ও সংবেদনশীল শিক্ষক নিয়োগের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রান্তিক জায়গায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পরিচালিত স্কুলগুলো বেশ ভালো চলে। নজরদারি রাখলে সব জায়গার প্রাথমিক স্কুল ভালো চলবে।’

ইউনিসেফের সহায়তায় ‘সিলেট বিভাগের চা–বাগানের নারী ও শিশুদের সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থা জোরদারে করণীয়’ শিরোনামে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‌্যাপিড) এ বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পরপর চা–বাগানের ৫ শতাংশ শিশু স্কুলে ফেরেনি।

অধ্যাপক তাপসের সঙ্গে আমি একমত। নজরদারি থাকলে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. উজ্জ্বল হোসেনের মতো কর্মকর্তাদের আকস্মিক পরিদর্শনে গিয়ে দেখতে হবে না যে, স্কুলের শিশু শিক্ষার্থীদের দিয়ে উকুন বাছাচ্ছেন এক শিক্ষক, ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এক শিক্ষক এক নারীকে দিয়ে চুল বেঁধে দিচ্ছেন। (সূত্র: ঢাকা পোস্ট)

স্কুলগুলোতে এখনো পাখি পড়ার মতো মুখস্থবিদ্যার প্রচলন। পাঠ্যবিষয়কে আনন্দদায়ক হিসেবে উপস্থাপন করা হয় না। স্কুলের প্রতি আগ্রহ জন্মানোর জন্য পাঠদানের প্রচলিত ব্যবস্থার সঙ্গে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড যুক্ত করলে একঘেয়েমিপনা কাটে। সেটা কয়টা স্কুল করে? স্কুল থেকে ক্লাসের বাইরে আনা, সেটা মাঠে খেলাধুলা হতে পারে, তাদের মধ্যে স্বপ্ন বুনতে অতিথি বক্তা আনা, কোনো সামান্য বিষয়ে ক্লাসের ভেতরেই প্রতিযোগিতা করে পুরস্কারের ব্যবস্থা করা, পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়তে উৎসাহ দেওয়া, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে চেনা, কোন শিক্ষার্থীর কোন বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে, সেসব জেনে নিয়ে তাকে পথ দেখানো, তার আগ্রহের জায়গাটি তাকে কত দূর নিয়ে যেতে পারে সে সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, কয়টা স্কুল এসব করে? অথচ ক্লাসের সবচেয়ে মনোযোগী, অনুগত শিক্ষার্থীও হতাশায় ভুগতে পারে। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তেমন সম্পর্ক থাকলে হতাশার জায়গাটিকে শনাক্ত করে ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করা যায়।

অধ্যাপক তাপস দরিদ্র পরিবার নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন, উপবৃত্তি, অবৈতনিক শিক্ষার মাধ্যমে শিশুটিকে শুধু শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ‘কস্ট অব অপরচুনিটি’র (সুযোগ লাভজনিত খরচ) কারণে শিশুটি পরিবার থেকে যে সহায়তা পাওয়ার কথা, তা পায় না। শিশুটির পরিবার তার খাওয়া–পরার খরচ বহন করতে চায় না। তাকে আয় করে পরিবারে অবদান রাখতে হয়। অভিভাবকেরা হিসাব করেন, যে সময়টা সে স্কুলে থাকছে, সে সময়টায় সে আয় করতে পারত।

খাতা দেখে জানালেন, ‘১ জানুয়ারি আকাশ স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভের বই নিয়ে গেছে। এরপর এই কয় মাসে এক দিনও আসেনি। আকাশের মা–বাবার ফোন নেই। লোক মারফত কয়েকবার ডেকে পাঠিয়েছিলাম। তাঁরাও আসেননি
নিতাই বুনার্জি, প্রধান শিক্ষক, বৃন্দাবন চা–বাগান বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়

এমন এক শ্রমজীবী শিশু মো. আদর (১৪) ও তার রিকশাচালক বাবা মো. রফিক এবং মা খণ্ডকালীন গৃহকর্মী নার্গিসের সঙ্গে কথা হয়েছিল আমার। করোনা এই শিশুটির পড়ালেখায় ছন্দপতন ঘটিয়েছে। করোনার আগে ২০২০ সালে বেসরকারি সংস্থা কমিউনিটি পারটিসিপেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিডি) শিশুটিকে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শিশুকল্যাণ প্রাথমিক বিদ্যালয়–৫–এ প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেয়। করোনার কারণে সে মাত্র তিন মাস পড়ার সুযোগ পায়। বাবা গাড়ি সারাইয়ের দোকানে কাজে লাগিয়ে দেন ছেলেকে। দুই বছরের বিরতিতে স্কুল এখন আর টানে না আদরকে। বাবা মো. রফিক বললেন, ‘ও কাজও করে না। বখাটে হইয়া গ্যাছে, সারা দিন আড্ডা মারে, নেশা খায়।’

আকাশ কালিন্দীর কথায় আবার ফিরে আসি। তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগমুহূর্তে বলেছিলাম, ‘আকাশ আমার মনে হচ্ছে, গরু পালার জন্য না, তোমার স্কুলে যেতে ভালো লাগে না, তাই যাও না।’ আকাশের হাসি চওড়া হলো। কিছু তত্ত্বকথা বললাম, ‘লেখাপড়া না করলে তো বড় হতে পারবে না। লেখাপড়া করলে চা–বাগানেই বড় চাকরি পাবে। কত ছেলেমেয়ে কত অনটনের মধ্যেও পড়ালেখা করে...ইত্যাদি।’ মুখ দেখে বুঝতে পারলাম না এসব কথা আকাশকে কতটা উদ্বুদ্ধ করেছে! তার মুখে একটুকরো হাসি ঝুলে ছিল। ছোট হলেও চা-বাগান সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান। চা–বাগানের প্রতিটি জায়গা তার নখদর্পণে। কথাবার্তায় সাবলীল। এমন তো হতে পারে নামের মতোই তার স্বপ্নের পরিধি বিশাল। হয়তো তার আগ্রহের জায়গাটিতে আমরা তাকে পৌঁছে দিতে পারছি না। একটু উদ্বুদ্ধ করতে পারলেই সে হয়তো শিক্ষায় ফিরবে, তার স্বপ্নটিকে মুঠোয় ভরতে পারবে!