আখেরি মোনাজাতে সারা দুনিয়ার মানুষের রহমত কামনা

বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে মানুষের অশ্রুসজল প্রার্থনা । ছবি: প্রথম আলো
বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাতে আল্লাহর দরবারে মানুষের অশ্রুসজল প্রার্থনা । ছবি: প্রথম আলো

‘হে আল্লাহ, আমাদের দোয়া কবুল করে নাও। হে পরওয়ারদিগার, আমাদের ইমান রক্ষা করো, আমাদের ভালো কাজগুলো মঞ্জুর করে নাও। হে রাহমানির রাহিম, সব বিপদ দূর করে দাও, সারা দুনিয়ার মানুষের ওপর রহমত বর্ষণ করো।’
বিনম্র সুরে ইহকাল ও পরকালের মালিক মহান আল্লাহ পাকের কাছে দুই হাত তুলে এই মোনাজাত করছিলেন ভারতের মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। আর তাঁর মোনাজাতের মধ্যে কিছুক্ষণ পর পর ‘আমিন’ ‘আমিন’ ধ্বনি উঠছিল। বিশ্ব ইজতেমার ময়দান ও আশপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে লাগানো মাইকে সেই ধ্বনি ছড়িয়ে পড়ছিল তুরাগ নদের চারপাশের এলাকায়।
গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ নদের পাশে বিশ্ব ইজতেমার মূল মঞ্চ থেকে গতকাল রোববার সকাল নয়টা ৫৫ মিনিটে শুরু হয় এ বছরের ইজতেমার দ্বিতীয় পর্বের আখেরি মোনাজাত। ১৭ মিনিট স্থায়ী এই মোনাজাত করান ভারতের দিল্লির মাওলানা জোবায়েরুল হাসান। আরবি ও উর্দু ভাষায় তাঁর সুমধুর সুরের মোনাজাত শুরু হতেই লাখো মুসল্লির কলরব মুহূর্তে থেমে যায়। বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে নেমে আসে নীরবতা। তাঁর সঙ্গে লাখো মুসল্লি দুই হাত তুলে ‘আমিন’, ‘আল্লাহুম্মা আমিন’ ধ্বনি তোলেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়।
ঢাকার রমনা উদ্যানসংলগ্ন কাকরাইল মসজিদে ১৯৪৬ সালে প্রথম ইজতেমার আয়োজন করা হয়। মুসল্লির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ১৯৪৮ সালে ইজতেমার স্থান পরিবর্তন করে বর্তমান হাজি ক্যাম্পের স্থলে নেওয়া হয়। ১৯৫৮ সালে ইজতেমা হয় সিদ্ধিরগঞ্জে। মুসল্লি আরও বাড়তে থাকায় সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে ১৯৬৬ সালে টঙ্গীর তুরাগতীরের মাঠে ইজতেমার স্থান নির্ধারণ করা হয়। সেই মাঠেও স্থান সংকুলান না হওয়ায় ২০১১ সাল থেকে দুই পর্বে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেই হিসাবে এবার ইজতেমার প্রথম পর্ব ২৪ জানুয়ারি শুরু হয়ে শেষ হয় ২৬ জানুয়ারি। আর দ্বিতীয় পর্ব ৩১ জানুয়ারি শুরু হয়ে গতকাল ২ ফেব্রুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
মোনাজাতে অংশ নিতে গতকাল ভোররাত থেকে হেঁটেও ইজতেমাস্থলে পৌঁছান অনেক মুসল্লি। সকাল আটটার আগেই ইজতেমার মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে মুসল্লিরা মাঠের আশপাশের রাস্তা, অলিগলিতে অবস্থান নেন। ইজতেমাস্থলে পৌঁছাতে না পেরে কয়েক লাখ মানুষ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ও আবদুল্লাহপুর-আশুলিয়া সড়কে অবস্থান নেন। ফজরের নামাজ ও আখেরি মোনাজাতের জন্য তাঁরা পুরোনো খবরের কাগজ, পাটি, সিমেন্টের বস্তা ও পলিথিন বিছিয়ে বসে পড়েন। এ ছাড়া পার্শ্ববর্তী তিন-চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বাসাবাড়ি, কলকারখানা, অফিস, দোকান ও যানবাহনের ছাদ এবং তুরাগ নদীতে অনেক নৌকায় অবস্থান নেন মুসল্লিরা।
ইজতেমার তিন দিনের বয়ান শুনতে মুসল্লিদের বেশির ভাগ প্রথম দিনই তুরাগতীরে সমবেত হন। যাঁরা নিয়মিত বয়ান শুনতে পারেননি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই নিয়ত করেছিলেন আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা এবং আশপাশের এলাকার মানুষ ফজরের সময় থেকেই টঙ্গী অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন আখেরি মোনাজাতে শরিক হতে। আখেরি মোনাজাত উপলক্ষে গতকাল আশপাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কলকারখানাসহ বিভিন্ন অফিস-আদালতে ছিল ছুটি। নানা বয়সী ও পেশার মানুষ, এমনকি নারীরাও ভিড় ঠেলে মোনাজাতে অংশ নিতে সকালেই টঙ্গী এলাকায় পৌঁছান।
সময়ের আগেই মোনাজাত: সময় এগিয়ে আনায় অনেক মুসল্লি মোনাজাতে অংশ নিতে পারেননি। এর আগে মোনাজাত দুপুরের দিকে হলেও এই পর্বের আখেরি মোনাজাত শুরু হয় সকাল ১০টারও আগে। ফলে অনেক মুসল্লি ইজতেমা ময়দানের কাছে না পৌঁছাতেই আখেরি মোনাজাত শেষ হয়ে যায়।
ইথারে মোনাজাত: ইজতেমা মাঠে না এসেও মোনাজাতের সময় হাত তুলেছেন অনেক মানুষ। গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা মসজিদ মাঠ, ভোগড়া মধ্যপাড়া স্কুলের মাঠ, নলজানি ওয়্যারলেস মাঠ, ভুরুলিয়া ওয়াপদা মাঠ, কালিয়াকৈর উপজেলার রতনপুর, আন্দারমানিক, সফিপুর বাজারসহ বিভিন্ন এলাকায় ওয়্যালেস সেটে ও মুঠোফোনের মাধ্যমে মোনাজাত প্রচার করা হয়।
আরও একজনের মৃত্যু: গত শনিবার রাতে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে আরও এক মুসল্লি মারা গেছেন। তাঁর নাম আবদুল গনি (৬৫)। তিনি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল থানার দাড়িয়াল গ্রামের মৃত আনু ব্যাপারীর ছেলে। এই নিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমায় ১০ জনের মৃত্যু হলো।
ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানা: জেলা প্রশাসন পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালত তিন দিনে ইজতেমাস্থলের আশপাশের এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিশুদ্ধ খাদ্যদ্রব্য আইন, সিটি করপোরেশন আইন ও অন্যান্য দণ্ডবিধিতে ৩০টি মামলা দায়ের করেছেন। জরিমানা আদায় করেন দুই লাখ ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া দুই পর্বের ইজতেমায় ৫৭টি মামলা ও দুই লাখ ৬৩ হাজার ১০০ টাকা জরিমানা এবং তিন পকেটমারকে ১০ দিন করে কারাদণ্ড দিয়েছেন।
পকেটমার আটক: টঙ্গী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইসমাইল হোসেন জানান, ইজতেমা মাঠ ও আশপাশের এলাকা থেকে মুসল্লিদের ব্যাগ টানা, পকেট কাটাসহ বিভিন্ন অপরাধে গতকাল পর্যন্ত চার দিনে ৩৯ জনকে আটক করা হয়েছে। এদের মধ্যে ১৬ জনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
আগামী ইজতেমার তারিখ: ইজতেমার আয়োজক কমিটির মুরব্বি প্রকৌশলী মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, আগামী বিশ্ব ইজতেমার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। তাবলিগি প্রচারকাজের সুবিধার জন্য এটি করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ৯ জানুয়ারি শুরু হবে তিন দিনের প্রথম দফা। আবার চার দিন বিরতি দিয়ে তিন দিনের দ্বিতীয় দফা শুরু হবে ১৬ জানুয়ারি।