আদম ব্যবসায়ীদের কবলে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছেন যুবকেরা
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের হাজীরটারি গ্রামের সেকেন্দার আলীর ছেলে রবিউল ইসলামের (২৫) সংসার ধান, পাট, তামাকের ব্যবসা করে ভালোই চলছিল। চার মাস আগে রবিউলকে একই ইউনিয়নের বিড়াবাড়ি গ্রামের সাবেদুল ইসলাম (৪৫) ওমানে একটি চাকরির প্রস্তাব দেন। বেতন ৩৪ হাজার টাকা। রবিউল নিজের ৩৫ শতক জমি বিক্রি করে ও ধার-দেনা করে সাড়ে তিন লাখ টাকা তুলে দেন সাবেদুলের হাতে। গত মে মাসে রবিউলকে ওমানে পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে তাউজ নামের একটি কোম্পানিতে মাসিক মাত্র ১২ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকের কাজ পান তিনি। মাস খানেক পর কোম্পানির মালিক রবিউলকে দেশে পাঠিয়ে দেন। এখন রবিউল একেবারে নিঃস্ব।
রবিউলের স্ত্রী রুনা বেগম ১ সেপ্টেম্বর বলেন, ‘ঘরোত একটা দানাও নাই। মোর সাথত ঝগড়া করি পাঁচ দিন আগোত ওমরা (রবিউল) ঢাকায় রিকশা চালেবার গেইছে। সাবেদুল ভাইজান পালে বেড়ায় টাকাও চাবার পাইছু না। মোবাইলফোনোত টাকা ফেরতের কথা কইলে ভয় দেখায়।’
মুঠোফোনে আদম ব্যবসায়ী সাবেদুলের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমি জরুরি কাজে ঢাকায় আছি। শুনেছি পরিশ্রমের কাজ করতে না পারায় রবিউল নিজেই দেশে চলে এসেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স না থাকলেও ঢাকা অফিসের মালিকের আছে।’ তবে ঢাকা কার্যালয়ের ঠিকানা ও বসের মুঠোফোন নম্বর চাইলে পরে দেবেন বলে সাবেদুল নিজের মুঠোফোনের সংযোগ কেটে দেন।
একই অবস্থা ওই ইউনিয়নের দোহাজারী গ্রামের ওহেদ মাছুয়ার ছেলে ওবায়দুল হকের (২৬)। ওবায়দুল সিলেটে এসিআই কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতেন। বছর খানেক আগে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার পলাশবাড়ী গ্রামের নান্নু মিয়ার। একপর্যায়ে নান্নু তাঁর বন্ধু পলাশবাড়ী গ্রামের শহিদুল ইসলামের মাধ্যমে ওবায়দুলকে কাতারে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে অফিশিয়াল একটি চাকরির প্রস্তাব দেন।
ওবায়দুল তাঁর দুই বিঘা জমির মধ্যে এক বিঘা বিক্রি ও এক বিঘা বন্ধক রেখে তিন লাখ ৭৫ হাজার টাকা শহিদুলের হাতে তুলে দেন। গত ১৮ এপ্রিল তিনি কাতার যান। সেখানে একটি কোম্পানিতে ১১ হাজার টাকা বেতনে শ্রমিকের কাজ পান। ১৮ দিন কাজের পর কোম্পানির মালিক ওবায়দুলকে দেশে পাঠিয়ে দেন।
গত ২৯ আগস্ট ওবায়দুলের বাবা ওহেদ মাছুয়া বলেন, ‘নান্নু মিয়া কুবুদ্ধি দিয়া মোর সোনার সংসার নষ্ট করি দিছে। জমিজমা ব্যাচে (বিক্রি) ছাওটাক টাকা দিয়া এখন মাইনসের বাড়ি হামাক মজুর করিবার নাগেছে।’ মুঠোফোনে ওবায়দুল অভিযোগ করেন, টাকা ফেরত চাইলে শহিদুল ও নান্নু হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
শহিদুলের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ওবায়দুল নামের কাউকে চিনি না। আর আদম ব্যবসার সঙ্গেও আমি জড়িত না। এটা ভুল নম্বর’ বলেই সংযোগ কেটে দেন। তবে নান্নু মুঠোফোনে বলেন, ‘দেন-দরবার করে শহিদুলের মাধ্যমে ওবায়দুলকে বিদেশে পাঠাতে গিয়ে আমার নিজেরই কিছু টাকা খরচ হয়েছে। বেতন কম বলে ওবায়দুল নিজে দেশে ফেরত এসেছে।’
ইকরচালী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য রবিউল ইসলাম বলেন, সাবেদুল ছাড়াও এ ইউনিয়নে অন্তত সাত থেকে আটজন আদম ব্যবসায়ী আছেন।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তারাগঞ্জের যোগাযোগকর্মী আছিনুল হক বলেন, তারাগঞ্জের অন্তত ২৫ জন যুবক আদম ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে বিদেশে গিয়ে প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরেছেন।
ইকরচালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন ও কুর্শার চেয়ারম্যান শাহিনুর ইসলাম বলেন, সভা-সমাবেশের মাধ্যমে লোকজনকে বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে আহ্বান জানানো হচ্ছে। ভালো করে কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে বিদেশে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনে কাগজপত্র নিয়ে তাঁদের কাছে আসার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তবে চেয়ারম্যান মোবারক হোসেন হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘শত পরামর্শেও কাজ হয় না। আমাদের কাছে কেউ কাগজপত্র নিয়া আসে না। প্রতারিত হয়ে দেশে ফেরার পরও আমাদের কাছে লিখিত অভিযোগ না করায় আদম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারি না।’
তারাগঞ্জ থানার ওসি তাপস সরকার বলেন, আদম ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেনি। তাই তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।