আদানি-রিলায়েন্সের বিদ্যুৎ প্রকল্প রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে!

ভারতের বেসরকারি খাতের বৃহৎ কোম্পানি আদানি ও রিলায়েন্স বিদেশে (ভারতের বাইরে) বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে সে দেশের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। ওই কোম্পানি দুটিকে অযাচিত (আনসলিসিটেড) প্রকল্প বাস্তবায়নের সুযোগ দেওয়ায় বাংলাদেশে প্রচলিত আইনের ব্যত্যয় ঘটছে। এ অভিমত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের।
রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি নিয়ে, বিশেষ করে আদানির ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে সিএনএন-আইবিএনের বিশিষ্ট সাংবাদিক করণ থাপারের একটি টুইট বার্তা উল্লেখযোগ্য।
টুইট বার্তায় করণ থাপার বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেসব দেশে গিয়ে ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন, তার সব কটি দেশেই আদানি পাওয়ার লিমিটেড বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চুক্তি কিংবা সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করেছে। ৬ জুন থাপার টুইটারে ওই বার্তা প্রকাশ করেন। সেদিনই ঢাকায় আদানি ও রিলায়েন্স বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) সঙ্গে দুটি আলাদা এমওইউ সই করে।
করণ থাপার তাঁর বার্তায় উল্লেখ করেন, নরেন্দ্র মোদি নেপালে গিয়ে ১০ হাজার কোটি রুপি ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ভুটানকে সাড়ে চার হাজার কোটি, মঙ্গোলিয়াকে ৬ হাজার ৪০০ কোটি এবং বাংলাদেশকে ১২ হাজার ৮০০ কোটি রুপি (২০০ কোটি মার্কিন ডলার) ঋণ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেছেন। এগুলোর প্রতিটি দেশেই আদানি বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য স্মারক সই করেছে।
আদানি ভারতে বর্তমানে ১০ হাজার ৪৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও ভারতের বাইরে এখন পর্যন্ত কোনো বিদ্যুৎ প্রকল্প করেনি। সাধারণত নিজ দেশের বাইরে বিদ্যুৎ প্রকল্প করার জন্য সব কোম্পানিরই বিদেশে একটি নির্দিষ্ট ক্ষমতার প্রকল্প বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা (একক কিংবা যৌথভাবে) চাওয়া হয়।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, রিলায়েন্স পাওয়ার লিমিটেড অবশ্য বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বাংলাদেশে উচ্চমূল্যের আমদানি করা এলএনজিভিত্তিক (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। কিন্তু বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, রিলায়েন্স তিন হাজার মেগাওয়াট করতে চাইলেও প্রথমে ২ হাজার ২৫০ মেগাওয়াট করতে চায়। আর ৭৫০ মেগাওয়াট পরে করবে বলছে।
এর কারণ অনুসন্ধান করে মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে রিলায়েন্সের ২ হাজার ২৫০ মেগাওয়াটের এলএনজিভিত্তিক একটি সদ্যনির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। কিন্তু তার জ্বালানি আমদানি করা এলএনজি হওয়ায় বিদ্যুতের উৎপাদনমূল্য ভারতের বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি পড়ছে। তাই কেন্দ্রটি চালানো সম্ভব হচ্ছে না। সম্ভবত তারা ওই কেন্দ্রটির যন্ত্রপাতিই বাংলাদেশে স্থানান্তর করতে চায়। এ ক্ষেত্রেও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র অবশ্য এ-ও মনে করে যে এ প্রকল্পগুলো শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে না। এই ধারণার কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, এ ধরনের একটি প্রকল্প করার জন্য জায়গা, বিদ্যুতের দাম প্রভৃতি অনেক বিষয়ে ঐকমত্যের দরকার।
গত শনিবার আদানি ও রিলায়েন্সের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব মনোয়ার ইসলাম অবশ্য প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের আশা প্রকাশ করেছেন। রিলায়েন্স ও আদানির কর্মকর্তাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, এমওইউ সই করার পর দয়া করে উধাও হয়ে যাবেন না, অতীতে অনেক কোম্পানিই যেমন করেছে। সরকার চায় এ প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হোক।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, সরকার বিশেষ আইনের (বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রণীত) আওতায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো প্রকল্প কোনো বিদেশি কোম্পানির অযাচিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে পারে কি না।
জানতে চাইলে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক সেলিম মাহমুদ বলেন, আইনে প্রকল্পের আকার কিংবা বাস্তবায়নকারী কোম্পানি দেশি হবে, নাকি বিদেশিও হতে পারে, এ সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। তাই সরকার চাইলে এ আইনের আওতায় বিদেশি কোম্পানিকে বড় প্রকল্পের কাজও দিতে পারে।
তবে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ম তামিম প্রথম আলোকে বলেন, কোনো আইনের ব্যাখ্যা শুধু ভাষার ভিত্তিতে হতে পারে না। সংশ্লিষ্ট আইনের লক্ষ্য, প্রণয়নের প্রেক্ষাপট, প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতিও দেখা দরকার। আলোচ্য আইনটি করা হয়েছিল দেশকে ভয়াবহ বিদ্যুৎ-সংকট থেকে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে উদ্ধার করা। সে জন্যই এ আইনের আওতায় স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য ছোট ছোট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যেগুলো মূলত ভাড়াভিত্তিক ও দ্রুত ভাড়াভিত্তিক হিসেবে পরিচিত।
ম তামিম বলেন, সরকার সাফল্যের সঙ্গে সেই সংকটকাল অতিক্রম করেছে। এখন সরকার বিদ্যুৎ খাতের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ ক্ষেত্রে আইনে বর্ণিত ‘দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করা’ প্রধান বিষয় নয়। এখানে প্রাধান্য পাওয়ার কথা সাশ্রয়ী দামে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বড় কেন্দ্র (বেইজ লোড প্ল্যান্ট) স্থাপন। তিন হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতার এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তার মধ্যে পড়ে না। আদানির প্রস্তাবিত ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক প্রকল্পও দ্রুত সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বাস্তবায়নযোগ্য নয়। আসলে ওই আইনের আওতায় আর কোনো নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র করার পর্যায় সরকার অতিক্রম করে এসেছে অনেক আগেই।
বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, রিলায়েন্স ও আদানির প্রস্তাবিত এত বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র অতীতে কখনো অযাচিত প্রস্তাবের ভিত্তিতে করার কথা সরকার ভাবেওনি। অনেকটা হঠাৎ করেই এগুলো সামনে চলে এসেছে। তবে এগুলো ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। দুই প্রধানমন্ত্রী যৌথ বিবৃতিতেও বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অনেকগুলো প্রকল্প সম্পর্কে সহযোগিতার কথা থাকলেও এগুলো সম্পর্কে কোনো বক্তব্য নেই।