আদালতে গুরুত্ব পায়নি 'তলিয়ে যাওয়া তালপট্টি'

বহুল আলোচিত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ হেগের স্থায়ী সালিসি আদালতে গুরুত্ব পায়নি। এই দ্বীপটি বেশ কয়েক বছর আগে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হেগের আদালতের বিচারকেরা গত বছর সরেজমিন এসে এই দ্বীপের অস্তিত্বের প্রমাণ পাননি। তবে বঙ্গোপসাগরের যে জায়গায় আগে দ্বীপটি ছিল, সে অংশটি আদালতের রায়ে ভারতের অংশে পড়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, তালপট্টি এখন নেই। তালপট্টি যে জায়গায় ছিল তার ক্ষুদ্র একটি অংশ এই সীমানা নির্ধারণের মাধ্যমে ভারতের দিকে পড়লেও নিচের দিকে গিয়ে বিশাল একটি এলাকায় বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
নেদারল্যান্ডস থেকে একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারণে তালপট্টি নিয়ে শেষ পর্যন্ত সালিসি আদালতে কোনো আলোচনা হয়নি। প্রথমত, বাংলাদেশ ও ভারতের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের রায়টি হয়েছে ১৯৪৭ সালের র্যাডক্লিফের মানচিত্রের ভিত্তিতে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ দক্ষিণ তালপট্টির মালিকানা দাবি করলেও দেশের মানচিত্রে তা দেখাতে পারেনি। ভারতও স্যাটেলাইট ইমেজের মাধ্যমে আদালতকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে এ দ্বীপের অস্তিত্ব। সর্বোপরি, গত বছরের অক্টোবরে বিচারকেরা বঙ্গোপসাগর সফরে এসেও দ্বীপটির অস্তিত্ব খুঁজে পাননি।
এই মামলার সঙ্গে যুক্ত ঢাকায় একজন কর্মকর্তা মনে করেন, ভারত যদি তালপট্টির অস্তিত্ব দেখাতে সমর্থ হতো তাহলে তারা সমদূরত্বের দাবি প্রতিষ্ঠার করার ক্ষেত্রে এগিয়ে যেত। কারণ ভূখণ্ডের অস্তিত্ব থাকলে সাগরের সীমারেখা সেখান থেকে টানার বিষয়টি আদালতকে মেনে নিতে হতো।
১৯৭০ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার জানায়, চব্বিশ পরগনা জেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় একটি নতুন দ্বীপের উৎপত্তি হয়েছে। ভারত এর নাম দেয় পূর্বাশা বা নিউ মুর এবং নিজেদের মানচিত্রে এর অধিকার দাবি করে। বাংলাদেশের দিক থেকে দ্বীপটির অবস্থান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সীমানা বরাবর। বাংলাদেশ এ দ্বীপের মালিকানা দাবি করে এর নাম দেওয়া হয় দক্ষিণ তালপট্টি। যুক্তরাষ্ট্রের ল্যান্ড রিসোর্স স্যাটেলাইটের ১৯৭৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, ওই দ্বীপের আয়তন প্রায় আড়াই হাজার বর্গমিটার, যা ভাটার সময় বেড়ে ১০ হাজার বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হয়।
গতকাল সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব রিয়ার এডমিরাল (অব.) মো. খুরশেদ আলম জানান, ১৯৭০-এর ঘূর্ণিঝড়ের পর দ্বীপটা জেগেছিল। ১৯৮৫ সালে উড়িরচরে যে ঝড় হয়, তার পর থেকে দ্বীপটি আস্তে আস্তে তলিয়ে যায়। ১৯৮৯ সালে স্যাটেলাইটের ধারণ করা ছবিতে এই দ্বীপটির অস্তিত্ব আর পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালে ভারতের করা এক গবেষণাতে বলা হয়েছে, ‘নিউ মুর ইজ নো মোর (নিউ মুর আর নেই)।’
এ পর্যায়ে ‘তাহলে তালপট্টি এখন কাদের ভাগে যাবে’—একজন সাংবাদিকের এ প্রশ্নের উত্তরে খুরশেদ আলম জানান, গত বছরের অক্টোবরে বঙ্গোপসাগরে সরেজমিন পরিদর্শনের সময় বিচারকদের তালপট্টিসংলগ্ন এলাকায় নেওয়া হয়। ভারতও বিশেষ ক্যামেরার সাহায্যে দ্বীপটিকে দেখানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাদের ক্যামেরায়ও তালপট্টির অস্তিত্ব মেলেনি। দ্বীপ হিসেবে থাকলে তালপট্টির পানির ওপরে থাকার কথা।
সাগরের ওই অংশটুকু এখন কার ভাগে পড়েছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে খুরশেদ আলম বলেন, যেহেতু র্যাডক্লিফের ১৯৪৭ সালের মানচিত্র অনুযায়ী সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হয়েছে, তাই ওই অংশটুকু ভারতের দিকে পড়েছে।
খুরশেদ আলম বলেন, ১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশ যতগুলো মানচিত্র প্রকাশ করেছে, তার কোনোটিতে তালপট্টি নেই। রাজনৈতিক সীমারেখার মানচিত্র দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘এখানে কিন্তু তালপট্টি নেই। আমরা তালপট্টির দাবি করে এসেছি, কিন্তু কেউ খেয়াল করে দেখিনি, হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মানচিত্রে তালপট্টি নেই।’
মালিকানার দাবি কি তবে তুলে নেওয়া হয়েছে—এ প্রশ্নের উত্তরে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, যেটির অস্তিত্ব নেই সেটি দাবির প্রশ্ন আসে কী করে!
এ সময় খুরশেদ আলম বলেন, ‘১৯৮০ সালের আগে যখন দ্বীপ ছিল, তখন অবশ্যই দাবি করেছি। কিন্তু আমাদের কোনো মানচিত্রেই আমরা প্রমাণ করতে পারিনি যে জায়গাটা আমাদের। আমাদের নিজেদের মানচিত্রগুলো আগেই সংশোধন করা উচিত ছিল। কিন্তু করিনি। ২০১০ সালে যে মানচিত্র আমরা সংশোধন করেছি, আদালত তা গ্রহণ করেননি।’