আনন্দ–উচ্ছ্বাসে গণিত উৎসব

বেলুন উড়িয়ে শুরু হয় জাতীয় গণিত উৎসব ২০২২
ছবি : তানভীর আহমেদ

প্রবেশমুখ দিয়ে ঢুকতেই ঢোলের আওয়াজে গণিতের জয়ধ্বনি। মন আর হৃদয় নেচে ওঠে। দুই বছর পর আবার এই খোলা মাঠে উদ্‌যাপিত হচ্ছে গণিত উৎসব। ততক্ষণে সকালের রঙিন ঝলমলে মিষ্টি আলো ইট-পাথরের উঁচু ভবনের ফাঁক দিয়ে এসে মাঠে খেলা করছে। অন্যদিকে গণিতকে জয় করতে সারা দেশ থেকে খুদে গণিতবিদের আনাগোনায় পুরো উৎসব প্রাঙ্গণ আনন্দ-উৎসাহে ভরপুর।

রাজধানী ঢাকার সেন্ট যোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে গত ১১ মার্চ বসেছিল ‘ডাচ্-বাংলা ব্যাংক-প্রথম আলো জাতীয় গণিত উৎসব-২০২২’ এবং বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের ২০তম আসর। বিপুলসংখ্যক অভিভাবক, শিক্ষক, স্বেচ্ছাসেবক, দেশবরেণ্য গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, গবেষক; সর্বোপরি উৎসবের শুভানুধ্যায়ীরা উপস্থিত হয়েছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় গণিত মেলায়। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রথম আলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনায় গণিতের এই মহাযজ্ঞের আয়োজন করে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি।

চার ক্যাটাগরির সেরাদের সঙ্গে অতিথিরা
‘করোনার এ দুই বছরে শিক্ষার্থীদের হাতে স্মার্টফোন দিতে হয়েছে পড়ালেখার জন্য। এ স্মার্টফোনে শিক্ষার্থীদের অনেকের আসক্তি হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া স্মার্টফোন ব্যবহার করার প্রয়োজন নেই।’
মুহম্মদ জাফর ইকবাল, সহসভাপতি, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি

উৎসবের শুরু

শুরুতেই শিক্ষার্থীরা নিজ অঞ্চলের বুথে নাম নিবন্ধন করে সংগ্রহ করে রেজিস্ট্রেশন নম্বরযুক্ত উৎসবের পরিচয়পত্র এবং মাথায় বাঁধার জন্য লাল-সবুজের ব্যান্ডানা। জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে উৎসব শুরু হয়। পরে শত শত বেলুন উড়িয়ে সূচনা করা হয় গণিতের এই মহোৎসবের।

গণিত অলিম্পিয়াড

উদ্বোধন শেষে মাঠ থেকে সরাসরি পরীক্ষাকক্ষে নিয়ে যাওয়া হয় সব শিক্ষার্থীকে। সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। ঢং ঢং ঢং। শুরু হলো গণিত অলিম্পিয়াড (পরীক্ষা পর্ব)। পরীক্ষার হলে শিক্ষার্থীদের যত উদ্বেগ, তার চেয়ে বেশি উদ্বেগ অভিভাবকদের। অনেক অভিভাবক টেনশনে অস্থির হয়ে আয়োজকদের কাছে জানতে চান, পরীক্ষার প্রশ্ন সোজা হয়েছে, না কঠিন?

মুহম্মদ জাফর ইকবাল,মোহাম্মদ কায়কোবাদ, আবুল কাশেম মো. শিরিন, চৌধুরী মফিজুর রহমান, কামরুল আহসান, রেজাউর রহমান, মাহবুব মজুমদার, মতিউর রহমান, আব্দুল কাইয়ুম, আবদুল হাকিম খান

নানা আয়োজনে রঙিন উৎসব

মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর মঞ্চে ওঠেন নৃত্যরঙ্গের শিল্পীরা। পরিবেশন করেন চমক হাসানের লেখা গণিত উৎসবের গান ‘মন মেলে শোন শুনতে পাবি বিজয়ের আহ্বান, গণিতের ধ্বনিতেই বাজে ওই মুক্তির জয়গান’–এর সঙ্গে নৃত্য। এরপর শুরু হয় খুলনার সামাজিক সংগঠন ‘রূপান্তর থিয়েটার’–এর শিল্পীদের পরিবেশনায় ‘গণিতের পট’। পটে আঁকা ছবির সঙ্গে নেচেগেয়ে বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের শুরু, লক্ষ্য, অর্জন ও পথচলা নিয়ে ছিল তাঁদের অসাধারণ পরিবেশনা। এর এক ফাঁকে অনুষ্ঠিত হয় সুডোকু ও রুবিকস কিউব মেলানোর প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা দুটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত। ততক্ষণে প্রায় বিকেল। শুরু হয় উৎসবের সবচেয়ে মজার আয়োজন ‘প্রশ্নোত্তর পর্ব’। এখানে শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করে আর জবাব দেন দেশবরেণ্য শিক্ষকেরা। প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে শুরু হয় এক মিনিট পর্ব। যেখানে শুভেচ্ছা, গল্প, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার কথা অতিথিরা জানান শিক্ষার্থীদের। এ ছাড়া গণিত ও বিজ্ঞানের বইয়ের স্টল থেকে প্রিয় বইটি কেনা কিংবা প্রিয় লেখক, গণিতবিদ ও বিজ্ঞানীর কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেওয়াসহ নানা কাজে ব্যস্ত ছিল শিক্ষার্থীরা। এ ছাড়া মাঠে উড়ছিল লাল-নীল পতাকা, ফেস্টুন ও ব্যানার।

‘তোমাদের নিয়মিত চিন্তার অনুশীলন করতে হবে। মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম কারণ সে িচন্তা করতে পারে।’
অধ্যাপক মোহাম্মদ কায়কোবাদ , সদস্য, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি
‘শিক্ষার্থীদের গণিতের ভয় কেটে যাচ্ছে—এ উৎসব তার প্রমাণ। এখানে শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের যেভাবে প্রশ্ন করল, তা দেখে মনে হয়েছে, গণিতভীতি কাটিয়ে ওঠা যায়।’
আবুল কাশেম মো. শিরিন, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেড

গণিত জয়ের হাসি

বিকেলের প্রায় শেষ, সূর্যটা তার নির্দিষ্ট দিকে হেলে পড়ছে। শুরু হয় সমাপনী পর্ব। মোট ১০০ জনকে বিজয়ী ঘোষণা করে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় সনদ, মেডেল ও টি-শার্ট। এবারের আসরে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়নস হয়েছে প্রাইমারি ক্যাটাগরিতে আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী বিহন পাল, জুনিয়র ক্যাটাগরিতে রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাজরীফ হাসান, সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে সামসুল হক খান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী এস এম এ নাহিয়ান এবং হায়ার সেকেন্ডারি ক্যাটাগরিতে সরকারি আনন্দ মোহন কলেজের শিক্ষার্থী তাহজিব হোসাইন খান। এ ছাড়া সেরা গণিত ক্লাবের সম্মান পেয়েছে ২০১৯ সালের জন্য টাঙ্গাইলের বোসন বিজ্ঞান সংঘ। ২০২০ সালের জন্য নেত্রকোনার গণিত ক্লাব ম্যাথমেটিকস অ্যান্ড সায়েন্স অর্গানাইজেশন অব নেত্রকোনা (মেসন) ও ২০২১ সালের জন্য কুমিল্লা ম্যাথ অ্যান্ড সায়েন্স ফোরাম। দেওয়া হয় ভেন্যু প্রতিষ্ঠানকে শুভেচ্ছা স্মারক। অতিথিদের সঙ্গে মঞ্চে ডাকা হয় জাতীয় অলিম্পিয়াডে বিজয়ী সবাইকে। চলতে থাকে ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক। খুদে গণিতবিদদের সবার চোখেমুখে ভাসছিল নতুন কিছু শেখার আনন্দ, গণিত জয়ের হাসি।

‘২০ বছর আগে গণিত অলিম্পিয়াড শুরু হয়েছিল। সে স্বপ্ন রাতের স্বপ্ন নয়, দিনের। এ স্বপ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা জাতীয় পর্যায় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গিয়েছে গণিতের প্রতিযোগিতায়। তারা আগামী দিনে আরও কিছু অর্জন করবে, এই আশা করি।’
ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস, উপাচার্য নর্থইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট
যে গণিত জানে না, তার জীবন ষোলো আনাই মিছে। আজকের পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে গণিত জানতে হবে।
আব্দুল কাইয়ুম, সহযোগী সম্পাদক প্রথম আলো

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য দল

আগামী ৬ থেকে ১৬ জুলাই ৬৩তম আন্তর্জাতিক গণিক অলিম্পিয়াডের আসর বসবে নরওয়ের অসলোতে। তাই চলতি বছরের গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য অনলাইনে ৪১ হাজার ৩৫০ শিক্ষার্থী নিবন্ধন করেছিল। পরে তিনটি ধাপ যথাক্রমে অনলাইন বাছাই অলিম্পিয়াড, আঞ্চলিক অলিম্পিয়াড ও বিভাগীয় অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিভাগীয় অলিম্পিয়াডের বিজয়ী ৯০৯ জনকে জাতীয় গণিত উৎসবে আমন্ত্রণ জানানো হয়, এর মধ্যে উপস্থিত ছিল ৮৬৭ জন।

জাতীয় উৎসবের বিজয়ীদের মধ্য থেকে একাধিক ক্যাম্পের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে নরওয়ের জন্য বাংলাদেশ দল।