আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে পদ্মায় নদীশাসন

২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। এই সেতু নির্মাণ ও তদারকিতে যুক্ত এবং সুবিধাভোগী জেলার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। আজ ছাপা হলো ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ও পানি বিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতের সাক্ষাৎকার।

আইনুন নিশাত

পদ্মা সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ দলের অন্যতম সদস্য অধ্যাপক আইনুন নিশাত। তিনি মূলত নদীশাসন ও এর ব্যবস্থাপনার দিকটি তদারক করেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ ও নদীশাসন নিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন প্রথম আলোকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইফতেখার মাহমুদ

প্রশ্ন :

প্রথম আলো: পদ্মা তো পৃথিবীর অন্যতম খরস্রোতা নদী। এর ওপর সেতু বানাতে গিয়ে আপনাদের কী কী চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে?

আইনুন নিশাত: অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আমরা পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে উদ্বোধনের অপেক্ষায় আছি। পদ্মার মতো বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময়ও নদীশাসনের পরামর্শক হিসেবে আমি ছিলাম। পদ্মা সেতুর নদীশাসনে আরেকটু সময় লাগবে, ২০২৩ সালে শেষ হবে। এটা এতটা জটিল ও কঠিন যে, সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে আমরা পদে পদে টের পেয়েছি। তবে যমুনা সেতুর কাজ করতে গিয়ে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা এখানে কাজে লেগেছে। এ ধরনের সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে সাধারণত আর্ন্তজাতিক নিয়ম–কানুন মানা হয়। আমরাও তাই করেছি। আমাজনের পর পদ্মাই সবচেয়ে শক্তিশালী নদী। ফলে এই নদীর চরিত্র বুঝে আমাদের কাজ করতে হয়েছে।

আরও পড়ুন

প্রশ্ন :

শক্তিশালী কোন অর্থে?

আইনুন নিশাত: নদীর স্রোতের গতি ও পানিপ্রবাহের পরিমাণের দিক থেকে শক্তিশালী বোঝাচ্ছি। সাধারণত পাহাড়ি নদী এমন খরস্রোতা হয়ে থাকে। সমতল নদীতে এমন স্রোত বিরল । বর্ষায় স্রোত এতটাই শক্তিশালী থাকে যে, অনেক সময় ফেরি তীরে ভিড়তে পারে না। ভারত থেকে আসা গঙ্গা নদী বাংলাদেশে রাজশাহী দিয়ে ঢুকে পদ্মা নাম ধারণ করে। সেখান থেকে রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে এসে যমুনার সঙ্গে মিশেছে। সেখানে বর্ষাকালে ৩০ থেকে ৪০ লাখ কিউসেক পানি আসে। তিস্তা নদীতে তিন লাখ কিউসেক পানি হলেই বন্যা শুরু হয়ে যায়। আর পদ্মায় পানির সঙ্গে বিপুল পরিমাণ পলি আসে। ফলে পানি ও পলি—দুটিকে একসঙ্গে আমাদের সামলাতে হয়েছে।

প্রশ্ন :

এত জটিল একটি নদী কীভাবে সামলেছেন?

আইনুন নিশাত: এখানে একটা সুবিধা আমরা পেয়েছি। ব্রিটিশ আমলে এসব খরস্রোতা নদীর ব্যবস্থাপনায় গাইড বাঁধ নামে একধরনের অবকাঠামো নির্মাণের প্রচলন ছিল। ভারতের পুনের এক পরীক্ষাগারে এর কৌশল তৈরি হয়। বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণের সময় আমরা ওই গাইড বাঁধ দিয়ে নদীটির ব্যবস্থাপনা করেছি। পদ্মার ক্ষেত্রেও একই কাজ করতে হয়েছে। বিদেশি পরামর্শকেরা এ নিয়ে আমাদের অনেক প্রশ্ন করেছেন। আমরা তাঁদের বিষয়টি বোঝানোর পর তাঁরা পুনেতে গিয়ে ওই কৌশলটি বুঝে একটি মডেল তৈরি করেন।

প্রশ্ন :

পদ্মায় তো প্রচুর ভাঙন হয়।

আইনুন নিশাত: পদ্মার মূল প্রবাহ প্রায় আড়াই কিলোমিটার। এর মধ্য দিয়ে প্রায় ৪০ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হয়। এ কারণে মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে পদ্মার দুই পাড়ে প্রচুর ভাঙন হয়। প্রাকৃতিক কারণে মাওয়া ঘাটে একটি পাতলা কাদার স্তর আছে। এর নিচের মাটি গাছের গুঁড়ি, পাথরের মতো শক্ত। ওই শক্ত স্তরের সুযোগ আমরা নিয়েছি। পদ্মার এক পাড় ভেঙে অন্য পাড় গড়ে। একসময় ভাগ্যকুলে ভাঙন ছিল, এখন আবার চর পড়ছে। এ ধরনের ভাঙ্গা–গড়া চলবে চর জানাজাতেও। ভাঙনের সম্ভাব্যতা, নদীর আচরণ ও পলি পড়ার হার—এসব হিসাব করে আমরা গাণিতিক মডেল তৈরি করে সেতুর কাজ শুরু করেছি।

প্রশ্ন :

পদ্মার গভীরতা তো অনেক।

আইনুন নিশাত: গভীরতার বিষয়টি সামলাতে আমরা ৮০০ কেজি ও ১২৫ কেজির জিও টেক্সটাইল ব্যাগ বানিয়ে পদ্মায় ফেলেছি। এমন ব্যাগ বানানো হয়েছে, যা থেকে বালু বের হবে না। এই ব্যাগের পরিমাণ ছিল ১ কোটি ৯০ লাখ ৯০ হাজার ৫২১টি। প্রয়োজনীয় বালু দেশের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে জোগাড় করা হয়েছে। ভারতের বিহার থেকে এক টন ওজনের বিপুল পরিমাণ পাথর এনে ফেলা হয়েছে। সব মিলিয়ে নদীশাসনের কাজটি অনেক কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং ছিল। নদীর স্বাভাবিক চরিত্র ঠিক রেখে নদীশাসন করা হয়েছে।

প্রশ্ন :

প্রথম আলো:ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেতু কতটুকু প্রস্তুত?

আইনুন নিশাত: পদ্মা সেতু চালুর পর নিয়মিত তদারকি করতে হবে। সেখানে পানিপ্রবাহের ধরনে কোনো বদল আসছে কি না, পলি কী পরিমাণ আসছে—এসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। নদীতে চর পড়বে, ভাঙন হবে—তাতে ভয়ের কিছু নেই। তবে নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করতে হবে।