আন্তর্জাতিক নৌপথ গাবখান ধুঁকছে নাব্যতাসংকটে

দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র আন্তর্জাতিক নৌপথ গাবখান নদের নাব্যতা হ্রাস পেয়ে এই পথে নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। নৌপথটি বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশ-ভারত প্রটোকল চুক্তির জাহাজ এবং ঢাকা-খুলনা-মোংলা-চট্টগ্রাম পথের পণ্য ও যাত্রীবাহী জাহাজ চলাচল ব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) বরিশাল অঞ্চলের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, এই নদটি (গাবখান চ্যানেল) ১৮০০ সালের গোড়ার দিকে খনন করা হয়। এটি ঝালকাঠির বিষখালী, সুগন্ধা থেকে পিরোজপুরের কচা, সন্ধ্যা নদীর সঙ্গে সংযুক্ত। ১৯৫০ সালে মোংলা বন্দর প্রতিষ্ঠার পর এটি আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের নৌ-যোগাযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই নদ দিয়ে প্রতিদিন পণ্য ও যাত্রীবাহী দেশি-বিদেশি ১০০ থেকে ১২০টি জাহাজ চলাচল করে।
কর্মকর্তারা বলেন, একসময় এই নদের প্রস্থ ছিল ২৫০ মিটার। তা কমে এখন ১০০ মিটার হয়েছে। কোনো কোনো স্থানে প্রস্থ আরও কম। সুগন্ধা নদীর প্রবেশমুখে বিশাল এলাকাজুড়ে চর পড়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
এই পথে চলাচলকারী বিআইডব্লিউটিএর একটি জাহাজের চালক ইউনুস আলী বলেন, প্রতি মাসে তেলবাহী কমপক্ষে ৭০টি জাহাজ এই পথ দিয়ে খুলনায় যায়। এই পথ বন্ধ হলে পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে সুন্দরবন ও বরগুনা উপকূল হয়ে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার ঘুরে গন্তব্যে যেতে হবে। এতে পণ্য পরিবহনের ব্যয় প্রায় দ্বিগুণ হবে।
বেসরকারি নৌযানের কয়েকজন চালক বলেন, পণ্যবাহী জাহাজগুলোকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। নাব্যতা কমে যাওয়ায় প্রায়ই পণ্যবাহী জাহাজ চরে আটকা পড়ে।
মহিউদ্দীন আহম্মেদ নামের বিআইডব্লিউটিএর আরেক চালক বলেন, জাহাজ চলাচলের জন্য ১১-১২ ফুট গভীরতা দরকার। কিন্তু জোয়ারের সময় গাবখানে গভীরতা সাত-আট ফুটের বেশি থাকে না। বিকল্প পথ না থাকায় এই গভীরতায় ঝুঁকি নিয়ে জাহাজ চালাতে হয়।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ-সংরক্ষণ বিভাগের বরিশাল কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দুই লাখ ঘনমিটার এবং ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক লাখ ঘনমিটার চর খনন করা হয়েছিল। এরপরও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় একবার খনন হয়েছে। কিন্তু পলি জমে তা আবার অল্প দিনের মধ্যেই ভরাট হয়ে যায়। চলতি বছরের এপ্রিলে জরুরি রক্ষণাবেক্ষণ প্রকল্পের আওতায় দুই কোটি টাকা ব্যয়ে নদের ঝালকাঠি অংশের প্রবেশমুখের চর অপসারণের কাজ শুরু করা হয়।
কিন্তু নৌপথ ব্যবহারকারীদের অভিযোগ, এভাবে খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কারণ, যতবারই খনন হয়েছে, কয়েক মাসের মধ্যে আগের অবস্থায় ফিরে গেছে নদটি। নদটির নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হলে বড় ধরনের খনন প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
খনন বিভাগের বরিশাল কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাইফুল্লাহ গতকাল সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন ড্রেজার দিয়ে নদটি খনন করছি। যত দূর সম্ভব নৌ-চলাচলের উপযোগী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এই নৌপথ ব্যবহারকারীরা বলছেন, কয়েক দফায় খননের পর নদটি ২৪০ ফুট প্রশস্ত ছিল। বর্তমানে কোথাও কোথাও তা ১৫০ থেকে ১১০ ফুটে নেমে এসেছে। নাব্যতাসংকটের কারণে বর্তমানে নদটি একমুখী নৌপথে পরিণত হয়েছে। ফলে ঝালকাঠির প্রবেশমুখে সুগন্ধা নদীতে ও পিরোজপুরের কাউখালীর প্রবেশমুখে সন্ধ্যা নদীতে জাহাজগুলোকে পাইলট স্টেশনের সংকেতের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়। নাব্যতা কমায় বর্তমানে এই পথ দিয়ে এক হাজার টনের বেশি ওজনের পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করতে পারছে না।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, নদের ঝালকাঠির সুগন্ধার মোহনায় চর পড়ে বেশ সংকুচিত হয়ে গেছে। এ ছাড়া গাবখান সেতুর আশপাশের অংশেও একই অবস্থা। নৌপথটি একমুখী হলেও অধিকাংশ নৌযান তা মানছে না।
বিআইডব্লিউটিএর খনন বিভাগের বরিশাল অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইদুর রহমান বলেন, ‘নদটি খনন করার পর তা অল্প দিনেই পলিতে ভরাট হয়ে যায়। এ জন্য সেখানে আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ খনন চলছে। মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে যাতায়াত সুগম করার জন্য বড় ধরনের খনন প্রকল্প হাতে নেওয়া হচ্ছে। ওই প্রকল্পে এই নদ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে একটি প্রকল্পের জন্যও আমরা আরেকটি প্রস্তাব পাঠিয়েছি।’