আফগানিস্তানে তালেবান শাসন: বাংলাদেশের নারীনেত্রীরা যা ভাবছেন

সুলতানা কামাল

আফগানিস্তানের পূর্ত দপ্তরের কর্মী তিনি। এখনো তাঁর চাকরি আছে কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত নন। কারণ, আগস্ট মাসে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর তাঁর অফিস যাওয়া বন্ধ। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের এই নারী তাঁর স্বামীকে হারিয়েছিলেন ২০০১ সালে, তালেবানের প্রথম দফায় ক্ষমতা দখলের পর। দেড় বছর আগে একমাত্র ছেলে তালেবানের হামলায় নিহত হয়েছেন। এখন চাকরিতে কবে যেতে পারবেন, সেই অনিশ্চয়তায় জীবন কাটছে তাঁর। পেশা অনিশ্চিত হয়ে চরম আর্থিকসংকটে তিনি।

এই কাবুল নগরের আরেক নারী একটি সংগীত বিদ্যালয় চালাতেন। গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর তাঁর সংগীত বিদ্যালয়ের কোনো বাদ্যযন্ত্র আর আস্ত নেই। পেশা হারিয়েছেন। আর ঘর থেকে বের হওয়াও তো এখন দুষ্কর।

ডা. ফওজিয়া মোসলেম

এই দুই নারী তাঁদের দুর্বিসহ অবস্থার কথা তুলে ধরেছেন ‘ওয়ান বিলিয়ন রাইসিং’ বা ‘উদ্যোমে উত্তরণ শতকোটি’ নারী নির্যাতন বন্ধে গঠিত বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে। এমন অনেক নারীরই আত্মসাক্ষ্য নথিবদ্ধ করেছে এই জোট। নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে আন্দোলনে ‘ভি-ডে’ আন্দোলন শুরু করেন মার্কিন নাট্যকার ও মানবাধিকারকর্মী ইভ এনসেলার। এটি শুরু হয় ২০১৩ সালে। আজ শনিবার বিকেলে সারা বিশ্বের সঙ্গে রাজধানী ঢাকাতেও আফগান নারীদের ওপর নিপীড়ণ বন্ধে সমাবেশ হবে এই নেটওয়ার্কের উদ্যোগে। আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর নারীর শিক্ষা, চলাফেরা, পেশার ওপর নানা বিধিনিষেধ সৃষ্টি হয়েছে। নারীদের নিগৃহীত হতে হয়েছে প্রকাশ্যে।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের নারীদের মধ্যেও এসব ঘটনা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের অধিকারকর্মী, রাজনীতিক, পেশাজীবী নারীরা তাঁদের উদ্বেগের কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল শুধু ওই দেশের নারী নয় সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি অশুভ বার্তা দেয়। বাংলাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এই ক্ষমতা দখল উজ্জীবিত করবে। উগ্রবাদী শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক সুবিধার জন্য রাষ্ট্রশক্তির সমঝোতাকে তাঁরা সমালোচনা করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এসব সমঝোতার উদ্যোগ রাজনীতিতে সাময়িক সুবিধা দিলেও আখেরে তা দেশের জন্য মারাত্মক ক্ষত সৃষ্টি করবে।

খুশী কবির

আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর বাংলাদেশের শঙ্কিত ও সাবধান হওয়ার কারণ আছে বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘এ দেশের রাজনীতিতে ও সমাজের বিভিন্ন স্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী সাম্প্রদায়িক প্রভাব বেড়েছে। তাদের সহিংস আচরণও দেখা গেছে। “আমরা হব আফগান, বাংলাদেশ হবে তালেবান” এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভয়ানক হুমকি আমরা শুনেছি।

কিন্তু বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক মানুষের জন্য তা হয়নি। কিন্তু সেই মানসিকতার মানুষ তো সমাজ থেকে চলে যায়নি। আফগানিস্তানে তালেবানের বিজয়ের পর তারা যে উদ্বুদ্ধ হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায়।’

বাংলাদেশে উগ্রবাদী শক্তি একসময় এমনকি সরকারেরও অংশ হয়ে ছিল। আর দীর্ঘসময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনার বিরোধীরাই সক্রিয় ছিল। সে সময় তারা আরও পুষ্ট হয়েছে বলে মনে করেন সুলতানা কামাল। আর এসব কারণেই বাংলাদেশে শঙ্কা আছে ও সাবধান হওয়ার দরকার আছে বলে মনে করেন এই মুক্তিযোদ্ধা। এখন অসাম্প্রদায়িক নীতি ও নৈতিকতা রক্ষার সাংবিধানিক দায়িত্ব আরও বেশি করে সরকারকে পালন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। কারণ হিসেবে সুলতানা কামাল বলেন, ‘ধর্মীয় উগ্রবাদী শক্তির প্রাথমিক লক্ষ্যবস্তুই থাকেন নারীরা। নারী অধিকার রক্ষায় বাংলাদেশের সরকারকে আরও সজাগ হতে হবে।’

তারানা হালিম

দেশে জঙ্গিবাদ দমনে বর্তমান সরকার বেশ সফল হলেও বিভিন্ন উগ্র মতাদর্শিক গোষ্ঠীর সঙ্গে সরকার সমঝোতার নীতি নিয়েছে বলে মনে করেন নারীনেত্রী খুশী কবির। তিনি এ প্রসঙ্গে কওমি শিক্ষাকে সাধারণ শিক্ষার সমান্তরালে স্বীকৃতি দান এবং হেফাজত নেতৃত্বের সঙ্গে শাসক দলের যোগাযোগের ঘটনা তুলে ধরেন। সরকারের এসব কর্মকাণ্ড শেষ বিচারে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে লাভবান করেছে বলেই মনে করেন বেসরকারি সংগঠন নিজেরা করির প্রধান সমন্বয়কারী খুশী কবির।

২০১৮ সালে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতোকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি আইনি বৈধতা পায়। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারির ব্যবস্থা রাখা হয়নি।

২০১৩ সালের মে মাসে ঢাকায় বড় সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম তাদের শক্তির জানান দেয়। সে সময় বিরোধী দল তাদের সেই সমাবেশে সমর্থন দেয়। পরে বর্তমান সরকারের সঙ্গে হেফাজতের শীর্ষ নেতৃত্বের যোগাযোগ বাড়ে। কিন্তু হেফাজতের নেতৃত্বের পরিবর্তন হওয়ার পর হেফাজত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে বিরোধিতা করে। গত ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সফরের সময় হেফাজতের সহিংস তৎপরতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। পরে নারায়ণগঞ্জে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ডের পর সরকার হেফাজতের ওপর চড়াও হয়। গ্রেপ্তার হন একাধিক নেতা।

রুমিন ফারহানা

খুশী কবির মনে করেন, ধর্মীয় উগ্রবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠীর তৎপরতা থাকলেও তারা এ দেশে কখনোই সফল হবে না। কারণ হলো বাংলাদেশের মানুষ চেতনায় অসাম্প্রদায়িক। আর এ দেশের নারীদের সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি।

খুশী কবির বলেন, ‘আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশের নারীরা নানা ক্ষেত্রে এগিয়ে আছেন। তবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরিখেও অনেক জায়গায় পিছিয়েও আছেন।’

বাংলাদেশে নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, রাজনীতি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের নারীর অধস্তনতা এখনো আছে বটে। তবে তারপরও শিক্ষা, কর্মক্ষেত্র, স্বাস্থ্যসহ নানা ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো।

নারী-পুরুষের সমতা (জেন্ডার ইক্যুইটি) প্রতিষ্ঠায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবচেয়ে ভালো বলে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) ২০২০ সালের প্রতিবেদনে উঠে আসে। ১৪৪টি দেশের মধ্যে বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০। দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশই ১০০–এর মধ্যে ছিল না।

মোশফেকা রাজ্জাক

সার্বিক উন্নয়ন এবং সেই সঙ্গে নারীর এই অগ্রগতি বাংলাদেশের একটি শক্তির জায়গা বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম। সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থানে সেই অগ্রগতি বাংলাদেশে বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তাঁর আছে। কারণ, আফগানিস্তানে যে শক্তি ক্ষমতা দখল করেছে, বাংলাদেশে তাদের অনুসারীরা আছে বলে মনে করেন তিনি।

ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘সব ক্ষেত্রেই এসব গোষ্ঠীর কাজ হলো ধর্মকে ব্যবহার করে নারীদের নিগ্রহ করা।’

তালেবান ক্ষমতা দখলের পর তাদের স্বীকৃত দেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বিএনপির প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। জাফরুল্লাহর এ অবস্থানের সমালোচনা করেন ফওজিয়া মোসলেম। তিনি বলেন, ‘জাফরুল্লাহ ভাইয়ের কাছে থেকে এ ধরণের কথা প্রত্যাশা করি না। তাঁর কাছে থেকে এ কথা শোনা অত্যন্ত পীড়াদায়ক, দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।’

তালেবানের সাম্প্রতিক উত্থানে বাংলাদেশেও যে উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে উদ্দীপ্ত করেছে সে সম্পর্কে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকেও সাবধান করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম গত ১৪ আগস্ট বলেন, আফগানিস্তানে তালেবানের সঙ্গে যোগ দিতে কিছু ব্যক্তি সে দেশে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারপারসন মুনীরুজ্জামানও বলেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে।

তালেবানের উত্থানে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি খুশি হবে। তবে তা বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও নারীর অগ্রগতিতে প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন বর্তমান সরকারের সাবেক প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের নারীরা নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। আর বর্তমান সরকারের মূল মতাদর্শ জঙ্গিবাদ ও মৌলবাদবিরোধী। কাজেই নারীর অধিকারের বিরুদ্ধে যেকোনো চক্রান্ত সরকারকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের নারীরাই মোকাবিলা করবেন।

বর্তমান সরকারের একসময়ের হেফাজতঘনিষ্ঠতার অভিযোগের বিষয়ে তারানা হালিমের কথা, ‘হেফাজতের নীতি নারীর উন্নতির অন্তরায়। ইসলাম প্রদত্ত নারীর সম্মানকে তারা বারবার তিরস্কার করেছে। এদের থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখাই এই দেশের নারী তথা সব মানুষের জন্য মঙ্গলজনক।’

তালবানের উত্থান বাংলাদেশে ওই মনোভাবাপন্ন মানুষদের উৎসাহিত করবে বলে মনে করেন বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা। তিনি বলেন, ‘এই ভাবধারার মানুষেরা এটাকে তাদের জয় হিসেবেই চিহ্নিত করবে।’

টুকু তালুকদার

রুমিন ফারহানার শঙ্কার আরেকটি জায়গা আছে। তিনি মনে করেন, দেশের গণতান্ত্রিক শক্তি যখন দুর্বল হয়, তাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা হয়, তখনই উগ্র শক্তির বিকাশ হয়। এখন বাংলাদেশ এর একটি উর্বর ক্ষেত্র হয়ে গেছে।

রুমিন ফারহানার কথা, ‘দেশের বিরোধী শক্তিকে চাপে রাখা হয়েছে। তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে। তাই উগ্রবাদের একটি উর্বর ভূমি বাংলাদেশ। তালেবানের উত্থানে এর ওপর প্রভাব পড়বে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রাজনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটাই এর পেছনে ভূমিকা রাখবে।’

তবে সাবেক সাংসদ ও আওয়ামী লীগ নেত্রী তারানা হালিম মনে করেন, ‘জামায়াতসহ উগ্রবাদী শক্তির মূল পৃষ্ঠপোষক বিএনপি। তারা স্বাধীনতাবিরোধী এ শক্তিকে সরকারের মন্ত্রীও করেছিল। জঙ্গিবাদের ভিত্তি এ দেশে বিএনপিই গড়ে দেয়। জাতীয় পর্যায়ের নারীনেত্রীদের ভাবনার পাশাপাশি খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি প্রান্তে থাকা নারীনেতৃত্বের মতামত নিতে এবং একই সঙ্গে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের ভাবনার দিকে।’

রাঙামাটির নারী অধিকারকর্মী টুকু তালুকদার মনে করেন, সমাজে উগ্রবাদের একটি ধারা বহমান আছে। তারা আফগানিস্তানের এ ঘটনায় উদ্দীপ্ত হবে। তবে রাষ্ট্র শক্ত অবস্থানে আছে বলেই তাঁর মত। তারপরও এর একটি নেতিবাচক প্রভাব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নারীদের মধ্যে পড়বে বলে মনে করেন তিনি।

টুকু তালুকদার বলেন, ‘দেশের বৃহত্তর জাতির প্রতি কোনো প্রভাব সৃষ্টি হলে এর প্রভাব যে সংখ্যায় কম জাতির মানুষের ওপর পড়বে তা নিশ্চিত।’

তালেবানের ক্ষমতা দখলে বাংলাদেশে কিছু শঙ্কা আছে বটে। তবে বাংলাদেশের

মানুষের শক্তি যেকোনো নেতিবাচকতার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে বলেই বিশ্বাস রংপুরের নারীনেত্রী মোশফেকা রাজ্জাকের। তিনি বাঙালি বেগম রোকেয়া নারী সংগঠনের সহসভাপতি। তাঁর কথা, সরকার উগ্র মতাদর্শের বিরুদ্ধে কঠোর। এখন তালেবানকে ঘিরে যারা উদ্দীপ্ত, তাদের এই উদ্দীপনা বেশি দিন থাকবে না। রাষ্ট্রীয় এই অবস্থান, সেই সঙ্গে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের সহজাতবোধই বাংলাদেশকে উগ্রবাদ থেকে রক্ষা করবে।