একদা হাওরের তিন উপজেলা ইটনা, মিঠাইন ও অষ্টগ্রাম ছিল কালীদহ সায়রের অন্তর্গত। জনশ্রুতি এ রকমই। এলাকাবাসীর কাছে সায়র মানে সাগর। সাগর সরে গেলে পরে বসতি গড়ে ওঠে।
কারা কবে কখন এখানে আবাস গড়েছিল, তা নিশ্চিত হওয়া যায় না। তবে হাওরের আদি বাসিন্দারা নিজেদের জঙ্গলি বলতেই পছন্দ করেন। জঙ্গলি কালক্রমে অনাবাদি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। অনাবাদিদের যে জমি নেই তা নয়, তবে আবাদের জন্য তাঁরা নতুন বসতি গড়া মানুষের ওপরই নির্ভর করতে শুরু করেন। কালের বিবর্তনে আবাদিরাও অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠেন এবং শুরু হয় আবাদি-অনাবাদি বিরোধ। এ বিরোধ তাঁদের সামাজিক জীবন থেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে গড়িয়েছে। নির্বাচন এলে তা নতুনভাবে দেখা দেয়।
এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। কারণ, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী রেজওয়ান আহাম্মদ উত্তরাধিকার সূত্রে আবাদি আর স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী সৈয়দ মহিতুল ইসলাম হলেন অনাবাদি বা জঙ্গলি।
স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৫০ বছর আগেও হাওরের সবকিছু আবাদি-অনাবাদি দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচিত হতো। বর্তমানে ভোটসংখ্যায় দুই পক্ষ প্রায় সমান-সমান। ভাব, বন্ধুত্ব, বিয়ে ও সামাজিক বন্ধন রচনায় প্রাধান্য পেত বিষয়টি। এর পর থেকে ধীরে ধীরে বিরোধ কমে আসে। ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও সেই সময় আওয়ামী লীগের মনোনয়নবঞ্চিত নেতা হিসেবে পরিচিত বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি ফজলুর রহমান স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হন। ফজলুর রহমান অনাবাদি। সেবার সভা, সমাবেশ ও বক্তৃতায় আবাদি-অনাবাদি বিষয়টি সামনে এনে উভয় প্রার্থী ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা করেন। সেবার ফজলুর রহমান দুই হাজার ভোটের ব্যবধানে আবদুল হামিদের কাছে হেরে যান।
সদরের ইসলামপুর গ্রামের শতবর্ষী আ. রহমানসহ আবাদিদের বেশ কয়েকজনের কথা থেকে জানা গেল, আবাদিদের বেশির ভাগই তৎকালীন ঢাকা জেলার চরাঞ্চলের মানুষ। চরে জমির চেয়ে লোকসংখ্যা বেশি হওয়ায় তাঁরা দলে দলে হাওরে পাড়ি জমাতে থাকেন। তখন হাওরের বেশির ভাগ এলাকাই ছিল ঘন জঙ্গলে আচ্ছাদিত। জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন ও কৃষিজমি বের করে ফসল ফলিয়ে অনাবাদিদের তাক লাগিয়ে দেন তাঁরা।
ঢাকি ইউনিয়নের অনাবাদি বসতি চারগ্রাম গ্রামের বাসিন্দা আতাবুর রহমান বলেন, ‘বুঝতে শুরুর পর থেকে বাবা-দাদাদের কাছ থেকে দুই বসতির দ্বন্দ্বের কথা শুনে আসছি। তবে এই ভাবনা থেকে ভোটের হিসাব-নিকাশ না করতে পারলে ভালো হতো।’