আবার রিতা-মিতা

বগুড়ার সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে দুই বোন মিতা ও রিতা। ছবিটি গতকাল তোলা ষ প্রথম আলো
বগুড়ার সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে দুই বোন মিতা ও রিতা। ছবিটি গতকাল তোলা ষ প্রথম আলো

রাজধানীর মিরপুরের মানসিক ভারসাম্যহীন সেই দুই বোন রিতা ও মিতা আবারও আলোচনায় এলেন। প্রায় চার মাস ধরে বগুড়ার একটি আবাসিক হোটেলে অবস্থান করার পর গতকাল রোববার তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছে।গত ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে দুই বোন বগুড়া শহরের সদর থানাসংলগ্ন আকবরিয়া আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষে ছিলেন।এর আগে ২০০৫ সালের ৭ জুলাই মিরপুর ৬ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের ৯ নম্বর সড়কের একটি বাড়ি থেকে তাঁদের উদ্ধার করা হয়েছিল। সেখানে তাঁরা দীর্ঘ প্রায় নয় বছর রহস্যময় জীবন যাপন করে আসছিলেন। তাঁদের বিশ্বাস, সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে তাঁদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। সব নাগরিক সুবিধাহীন বাড়িটি এতটাই ভগ্ন আর মনুষ্য বসবাসের অনুপযোগী ছিল যে এলাকাবাসী এটিকে ভূতের বাড়ি বলতেন। শুরু থেকেই দেশের মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা দুই বোন জটিল মানসিক রোগে আক্রান্ত বলে জানান। বড় বোন রিতা চিকিৎসক ও মিতা প্রকৌশলী।

বগুড়ায় দুই বোন

আকবরিয়া হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হাসান আলী প্রথম আলোকে জানান, ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১১টার দিকে পুলিশের একজন সদস্য ওই দুই বোনকে হোটেলে পৌঁছে দেন। থানার সামনে থেকে তাঁদের তিনি নিয়ে আসেন। হোটেল রেজিস্টারে তাঁরা নিজেদের নাম আইনুন্নাহার (৪৯) ও নুরুন্নাহার (৪৫) এবং বাবা মৃত শরফুদ্দিন খান উল্লেখ করেন। ঠিকানা মণ্ডলগ্রাম, নাসিরনগর, বি-বাড়িয়া। হোটেলের তিনতলার ২১ নম্বর কক্ষে থাকতেন তাঁরা। এ পর্যন্ত তাঁরা ভাড়া বাবদ প্রায় ৭০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন।

হোটেলের ব্যবস্থাপক লিটুনুর রহমান বলেন, ‘তাঁরা প্রায় সারা দিন হোটেল কক্ষেই থাকতেন। কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। কারও সাহায্যও নিতেন না। মাঝেমধ্যে একজন বাইরে এসে খাবার নিয়ে যেতেন। কিন্তু এক সপ্তাহ ধরে তাঁরা হোটেল ভাড়া পরিশোধ না করায় তাঁদের খোঁজ করা হয়। এ সময় তাঁরা অসংলগ্ন ও আধ্যাত্মিক কথাবার্তা বলেন। কয়েক দিন ধরে দরজা বন্ধ করে দিলে থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।’

বগুড়া সদর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গতকাল সকালে হোটেলে গিয়ে ওই দুই নারীকে অনেক ডাকাডাকি করলেও কক্ষ খোলেননি। পরে বিষয়টি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতিকে জানানো হয়।

মহিলা আইনজীবী সমিতির জ্যেষ্ঠ সদস্য শাহাজাদী লায়লা ওই দুই নারীর সঙ্গে কথা বলেন। তাঁরা যে রাজধানীর মিরপুরের সেই দুই বোন রিতা ও মিতা, তা নিশ্চিত হন।

শাহাজাদী লায়লা বলেন, অনেক ডাকাডাকির পরও তাঁরা হোটেল কক্ষের দরজা খোলেননি। তাঁদের অনুরোধ করে বলা হয়, ‘আপনারা কিছু খান’। তাঁরা বলেন, ‘হোটেলের সব শয়তান, সব দোজখে যাবে, বাংলাদেশ শয়তানে ভরে গেছে, সব দোজখে যাবে। আল্লাহর হুকুম ছাড়া দরজা খোলা যাবে না।’ প্রায় পাঁচ মিনিট পরে দরজা খুলে মিতা বলেন, ‘ম্যাডাম, ওনার হুকুম হয়েছে আপনার সঙ্গে যাওয়ার, চলুন আমরা যাব। একটু দাঁড়ান ও (বড় বোন) ছাত্রী পড়াচ্ছে, পড়ানো শেষ হলেই যাব।’

আইনজীবী সমিতির ওই নেত্রীর সহযোগিতায় দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ওই দুই বোনকে হোটেল থেকে শহরতলির বারপুর সামাজিক প্রতিবন্ধী পুনর্বাসন কেন্দ্রে নেওয়া হয়।

কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আবদুল মানিক বলেন, দুই বোন প্রচণ্ড ক্লান্ত ও অসুস্থ ছিলেন। এ জন্য তাঁদের বিশ্রামে রাখা হয়েছে। তবে দুপুরের দিকে সামান্য খাবার খেয়েছেন তাঁরা।

পেছনের কথা

২০০৫ সালে মিরপুর থেকে রিতা-মিতাকে উদ্ধারে সহযোগিতা করেন আইনজীবী এলিনা খান। তিনি বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছরের জুনে রিতা-মিতার সঙ্গে শেষ দেখা হয়। তাঁদের বড় বোন কামরুন্নাহার হেনা ও ভগ্নিপতির জিম্মায় ছিলেন তাঁরা। রিতা-মিতার কিছু হলে আমাকে জানাতে বলেছিলাম। তবে তাঁরা কিছু জানাননি। আমিও বিভিন্ন কাজে দেশের বাইরে ছিলাম।’

এলিনা খান বলেন, আত্মীয়স্বজন যদি দায়িত্বে অবহেলা করেন তাহলে বাইরের মানুষের পক্ষে সার্বক্ষণিকভাবে দেখাশোনা করা কঠিন বিষয়।

জানা গেছে, রিতা অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের অধ্যাপক শহীদ মঞ্জুর সহপাঠী। তাঁর সূত্রে রিতা ওই স্কুলে চাকরি পান।

বোন কামরুন্নাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওরা আমার কাছেই ছিল। পরে একসময় আর থাকতে চায় না। ওরা আলাদা বাসা ভাড়া নেয়। অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে চাকরি হয় রিতার। পরে আর আমাকে ওদের বাসায় ঢুকতে দিত না। মিরপুরে দোকান ভাড়ার টাকা আর রিতার চাকরির টাকায় তারা ভালো আছে বলে জানায়। আমি খুবই অসুস্থ থাকায় পরে আর খোঁজ নিতে পারিনি।’