
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার সন্তোষপুর গ্রাম। গ্রামটি মধুপুর শালবনের অংশ। বনের ভেতরে বন বিভাগের বিট অফিস। কাছে একটি ছোট মনিহারি দোকান। সেই দোকানে একটি বড় পাত্রে পানি ভরা আছে। সেই পানি খেয়ে যাচ্ছে বন থেকে আসা একদল বানর।
শুধু পানি নয়, এই দোকান এবং এর মালিক আবু হানিফ এসব বানরের খাবারের জোগানদাতাও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বানরের দল এসে ভিড় জমায় তাঁর দোকানের সামনে। আর হানিফ নিজের সাধ্যমতো বাদাম-বিস্কুট-কলা, যখন যা পারেন, তা দিয়েই এই প্রাণীদের খিদে মেটান। এমনটা চলে আসছে প্রায় ১৬ বছর হলো। স্থানীয় ব্যক্তিদের কাছে আবু হানিফের পরিচিতি এখন ‘বানরের জিম্মাদার’।
গত রোববার দুপুরে হানিফের দোকানের সামনে গিয়ে দেখা গেল ৮ থেকে ১০টি বানর। ওদের দেখিয়ে হানিফ বলছিলেন, ‘ওই যে বড়টা হলো নেতা। নেতার কিন্তু দাপট আছে। ১০ টাকার বাদামের প্যাকেট তার একার জন্য লাগে। আর ওই ছোটটা হলো নেতার পিএস। এখন নেতার পেছন পেছন সব চলে যাবে। আবার যখন খিদা লাগবে, তখন আসবে।’
হানিফ এমনভাবে কথাগুলো বলছিলেন, যেন এই প্রাণীগুলো তাঁর কত কাছের। সত্যিই কাছের, কেননা তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।
সন্তোষপুর ময়মনসিংহ বন বিভাগের অধীন। শালবন বলা হলেও সন্তোষপুরে শালগাছ এখন হাতে গোনা। বনের একটি বড় অংশ উজাড় করে আশির দশকে হয়েছে রাবার বাগান। দিন দিন মানুষের বসতিও বেড়েছে বনে। ফলে বানরের মতো বন্য প্রাণীর বসত গেছে হারিয়ে। তাই তারা খাবারের সন্ধানে এভাবে চলে আসে। ওদের কষ্ট বুঝতে পারেন হানিফ। হানিফ বললেন, তিন বছর আগে তিনি এখানে দোকান দিয়েছেন। সকাল সাতটায় এসে বানরের খাবার দেন। খাবার দিতে দেরি হলেই বানরগুলো গন্ডগোল শুরু করে। তবে ২০০০ সাল থেকেই তিনি বানরকে খাবার দেন। তাঁর এ কথায় এলাকাবাসীরও সায় মিলল।
বানর দেখার জন্য হানিফের দোকান ঘিরে দর্শনার্থীদের ভিড় জমে। বানরের দল কোনো কোনো দর্শনার্থীর কাঁধে চড়ে বসে। তাদের খাবার কেড়ে নেয়। তবে দুষ্টামির মাত্রা বেড়ে গেলে হানিফ ধমক দেন। তাতে বেশ কাজ হয়।
হানিফের বাড়ি দোকানের কাছেই। তাঁর চার মেয়ে, তিন ছেলে। পরিবারের লোকজন হানিফের বানরপ্রেম দেখে মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে, ‘বান্দরের ওপর এত দরদ কেন?’ হানিফ নিজেও এ প্রশ্নের উত্তর জানেন না। শুধু বলেন, ওদের দেখলে মায়া লাগে।
প্রতিদিন বানরের পেছনে হানিফের ১০০ টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হানিফের পক্ষে তা কষ্টসাধ্য হলেও মেনে নেন তিনি।
কিছুদিন আগে এলাকার চেয়ারম্যান ত্রাণের খাবার থেকে এক বস্তা চাল বানরদের জন্য বরাদ্দ দেন। এই চাল ছিটিয়ে দেন হানিফ। পাশাপাশি তাঁর দোকানের বাদাম বা অন্য খাবারই প্রধান ভরসা। দর্শনার্থীরাও কিছু খাবার দেয়। তবে বৃষ্টির দিনে দর্শনার্থী থাকে না বললেই চলে। ওই দিন হানিফের খরচ কিছুটা বেড়ে যায়।
সন্তোষপুর বন বিভাগের বিট কর্মকর্তা আরজু মিয়া বললেন, বনে অন্তত ২০০ বানর আছে। এদের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ নেই। গেল বছর তিন মাসে ১০ হাজার টাকা মিলেছিল। এবার এই সহায়তা আর আসেনি।
হানিফের একার পক্ষে এতগুলো বানরের খাবারের ভার নেওয়া সম্ভব নয়। আর বনের এসব প্রাণীকে বাইরের খাবার দিয়েই দীর্ঘদিন সুস্থ রাখা যাবে না—এ কথা মানেন ময়মনসিংহের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা গোবিন্দ রায়। এদের নিত্য খাবারদাবার দিয়ে সহায়তা করা হানিফের বিষয়ে তিনি জানেন না বটে; তবে সাধুবাদ জানালেন এই প্রচেষ্টার। আর বললেন, প্রায় উজাড় হওয়া বনে আবার দেশীয় ফলদ গাছ লাগিয়ে বানরদের আবাসস্থল ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন তাঁরা।