আব্বাসের জনপ্রিয়তায় সরকার ভয় পেয়েছে

আফরোজা আব্বাস
আফরোজা আব্বাস

সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে ঢাকা দক্ষিণের আত্মগোপনে থাকা বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মির্জা আব্বাসের পক্ষে তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস প্রথম আলোর মুখোমুখি হন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর পরামর্শক সম্পাদক কামাল আহমেদ
প্রথম আলো: শুরুতেই জানতে চাই যে আপনার স্বামী এর আগেও সরকার কর্তৃক মনোনীত মেয়র ছিলেন, নির্বাচিত ছিলেন না। তখন তিনি কতটা কাজ করেছেন, তা এখনকার প্রজন্মের অনেকেই জানে না। হয়তো বয়স্ক ভোটারদের কারও মনে থাকতে পারে। কিন্তু এটাও সত্য যে অনেক কাজই তিনি করতে পারেননি। তাই এখন যেসব অঙ্গীকারের কথা বলছেন, সেগুলো যে তিনি পূরণ করতে পারবেন, তা মানুষ কেন বিশ্বাস করবে?
আফরোজা আব্বাস: আপনি যেমন বললেন বয়স্ক ভোটার জানেন, যাঁরা অরিজিনাল ঢাকাবাসী, তাঁরা কিন্তু জানেন মির্জা আব্বাসকে, তিনি কতটুকু সৎ থেকে কাজ করেছেন। তো আমার বিশ্বাস, মির্জা আব্বাসকে পরীক্ষা দিতে হবে না। আমি প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি এবং সাড়া পাচ্ছি। এখন তাঁরা কেবল মির্জা আব্বাসকেই চাইছেন। ওনাদের (ভোটারদের) কোনো কথা নেই, কেবল একটাই কথা, আমরা ভোট দিতে পারব তো? পুরান ঢাকার কথা যদি বলেন, মির্জা আব্বাসের পক্ষ থেকে বলতে পারি অপূর্ণ যেগুলো রয়ে গেছে, অসম্পূর্ণ যেগুলো রয়েছে, সেগুলো সম্পন্ন করার চেষ্টা সে করবে। পরিচ্ছন্ন ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, আন্তর্জাতিক মানের ঢাকা।
প্রথম আলো: উনি পুরো ঢাকার মেয়র ছিলেন। এখন একটা অংশের মেয়রের জন্য লড়ছেন, সিদ্ধান্তটা কি রাজনৈতিক কারণেই। কারণ খণ্ডিত ঢাকার মেয়র হওয়ার মাঝে আগের সেই গৌরব তো আর থাকছে না?

আফরোজা আব্বাস: এর কারণটা আমি বলতে পারব না। এটা হয়তো হঠাৎ করেই হয়েছে। বলতে পারব না কখন কোন পরিস্থিতিতে এই সিদ্ধান্তটা হয়েছে। সময় এলে হয়তো জানা যাবে।
প্রথম আলো: ওনার বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা তিন ডজনের মতো, বেশিও হতে পারে। উনি মেয়র হলে মামলা সামাল দেবেন, না নগর সামাল দেবেন, কোনটা করবেন?
আফরোজা আব্বাস: যাঁরা রাজনীতি করেন তাঁদের মামলা থাকবেই, এগুলো সব রাজনৈতিক মামলা। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানিমূলক মামলা। এগুলো থাকবেই, কিন্তু কাজ করার সুযোগ তো দিতে হবে।
প্রথম আলো: আওয়ামী লীগ তো সরকারে আছে। আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে মামলাগুলো সবই সচল থাকবে, প্রত্যাহারের সম্ভাবনা নেই। কারণ, বাংলাদেশের সংস্কৃতিটাই এমন। তো সে ক্ষেত্রে তিনি কি মামলা সামাল দেবেন, নাকি নগর দেখবেন?
আফরোজা আব্বাস: মামলা তো প্রত্যাহার কোনোটিই হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের মামলাগুলো দেখুন, আওয়ামী লীগের মামলাগুলো স্পেশাল কোর্ট করে সন্ধ্যার মধ্যে খারিজ হয়ে গেল, কিন্তু আমাদের মামলাগুলো চলতেই থাকল। তারপর মামলাগুলো দেখেন, সাংবাদিকদের প্লট দিয়েছে, কবি-সাহিত্যিকদের প্লট দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের প্লট দিয়েছে—এসবের জন্যও মামলা হলো। কেউ কিন্তু বলতে পারবে না মির্জা আব্বাসের শাহজাহানপুরের বাইরে কোনো জায়গা আছে বা নিয়েছে। আমরা সব সময় বলি যদি কেউ পায় নিয়ে যাক। ও অনেক খেটেছে, আমরা কখনো আশাও করি না মির্জা আব্বাস নিজের জন্য কিছু করবে। বরং আমাদের অনেক জায়গা—ওর নিজের, আমার শ্বশুরের অনেক জায়গা বেচে ও রাজনীতি করেছে। রাজনৈতিক মামলা থাকবে; তার পাশাপাশি কাজ করতে হবে।
প্রথম আলো: হলফনামায় যে সম্পদের হিসাব দিয়েছেন তাতে দেখা গেছে, যে কয়জন প্রার্থী আছেন, সেখানে তিনি প্রায় সব প্রার্থীর মধ্যে ধনী, আপনাদের দুজনের মিলিয়ে প্রায় শতকোটি টাকার ওপরে সম্পদ। তো সেই সম্পদ রক্ষাও তো একটা বড় কাজ। ব্যবসায়িক স্বার্থ এবং নগরবাসীর সেবা —এই দুইয়ের মধ্যে যদি কোনো টানাপোড়েন হয়, তবে সেই টানাপোড়েন সামলাবেন কী করে?
আফরোজা আব্বাস: হবে না, ইনশা আল্লাহ। আপনি দেখেছেন হয়তো যে মির্জা আব্বাস সবচেয়ে ধনী। সম্পদের দিক থেকে সর্বোচ্চ, মামলার দিক থেকে সর্বোচ্চ, ঋণের ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ, সব দিক থেকেই সর্বোচ্চ সব দিকেই। এগুলো থাকবেই। তার লোনও আছে, সম্পদও আছে, সব হবে; রাজনীতিও হবে, জনগণের সেবাও হবে।
প্রথম আলো: তাঁকে নির্বাচিত করলে কি ঢাকা দক্ষিণের নাগরিকেরা একজন পূর্ণকালীন মেয়র পাবেন? নাকি খন্ডকালীন মেয়র, খন্ডকালীন ব্যবসায়ী পাবেন? লোন, ব্যবসা, ব্যাংকের শেয়ার, বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগ—এসব সামলাবেন, না মেয়রের কাজে করবেন?
আফরোজা আব্বাস: যখন পলিটিকস করেন তখন পুরোটাই পলিটিকস। ওর ব্যবসা পুরোটাই আমি দেখি। ও বিজনেসে ধরতে গেলে ফাইভ পার্সেন্টও সময় দেয় না। ওর সবকিছুই রাজনীতি। ওর যদি ব্যবসায় ক্ষতি হয়, তাতে ওর কিছু আসে যায় না। ওর কাছে রাজনীতিই সবকিছু। এর বাইরে অন্য কিছু নেই।
প্রথম আলো: রাজনীতিতে বাংলাদেশে দুই দলের ক্ষেত্রেই যেটা অভিন্ন অভিযোগ তা হলো এরা কেউ দলীয় সংকীর্ণতার ওপরে উঠতে পারে না। দেখা গেল, উনি মেয়র হলেন কিন্তু মেয়রের অফিসটা দলের অফিসে পরিণত হয়ে গেল। যে রকমটি বিভিন্নজনের ক্ষেত্রে অতীতে হয়েছে।
আফরোজা আব্বাস: ওর ক্ষেত্রে এমন হয়নি। দলীয়রাও পেয়েছে, আবার ওর সময়ে আওয়ামী লীগের লোকই সর্বোচ্চ জমি-প্লট পেয়েছেন। সাংবাদিকেরা পেয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছেন। ও সবার জন্য করার চেষ্টা করেছে।
প্রথম আলো: দলের একটা অংশ এই মনোনয়নে সন্তুষ্ট নয় বলে কথা চালু আছে বাজারে, তারা কি সবাই নেমেছে?
আফরোজা আব্বাস: এমন কথা আমার জানা নাই। সবাই নেমেছে এবং কাজ করছে। তবে কাজ করবে কীভাবে? মেয়র প্রার্থীর যেমন সমস্যা আছে জামিন হয়নি, আবার আমাদের কাউন্সিলর প্রার্থীরা আছেন, তাঁদেরও বেশির ভাগ হয় জেলে নয়তো মামলার জন্য সামনে আসতে পারছেন না। যাঁরা আমাদের দলীয় নেতা-কর্মী, তাঁরাও কিন্তু কিছু করতে পারছেন না। কাজ করছেন শুধু আত্মীয়স্বজন। আমি যখন যাই নির্বাচনী প্রচারণায়, আমার সঙ্গে শুধু ফাইভ পার্সেন্ট দলীয় নেতা-কর্মী থাকেন। আর নাইনটি ফাইভ পার্সেন্ট জনগণ। জনগণকে সঙ্গে নিয়েই কাজ করছি। কারণ আমাদের তো সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। আমরা সমান সুযোগ পাচ্ছি না সরকারের কাছ থেকে। মির্জা আব্বাসকে গণসংযোগের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে। গণসংযোগে অংশ নেওয়া সব প্রার্থীরই অধিকার।
প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয় না উনি আত্মগোপনে থাকার চেয়ে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে থেকে নির্বাচন করলে ভালো হতো? মানুষের মনে তো প্রশ্ন জাগে যে তিনি কেন আত্মগোপনে।
আফরোজা আব্বাস: এটাই তো আমাদের ইচ্ছা ছিল। আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, আদালত জামিন দেবে, আমরা আশা করেছিলাম সরকার সবার জন্য সমান সুযোগ দেবে। কিন্তু সরকার মির্জা আব্বাসের জনপ্রিয়তায় ভয় পেয়েছে। আমরা আশা করি, মির্জা আব্বাস আর অপেক্ষা করবে না, নেমে আসবে এবং প্রয়োজনে আত্মসমর্পণ করে কারাগারে থেকে নির্বাচন করবে।
প্রথম আলো: আপনার স্বামীর প্রতিদ্বন্দ্বী সাঈদ খোকন বলছেন যে আপনি অযথা অভিযোগ করছেন, শুধু প্রচার পাওয়ার জন্যই এটি করছেন। এমন কথাও বলেছেন যে আপনার এত অভিযোগ থাকলে আপনি নির্বাচন কমিশনে যান।
আফরোজা আব্বাস: প্রতিদিন আমরা নির্বাচন কমিশনকে জানাচ্ছি। আমার বাসার দেয়ালে সাঈদ খোকনের পোস্টার লাগানো আছে একটা, কিন্তু ছেঁড়া দেখবেন না। একদম যেভাবে লাগানো ছিল সেভাবে। কিন্তু আমাদেরটা কোথাও দেখেন সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলছে। ছেলেদের ধরে মারছে, কখনো পুলিশ ধরে নিয়ে যাচ্ছে। কেন অভিযোগ করব না বলেন। সাঈদ খোকন আমার সন্তানের মতো। আমি যেখানেই প্রচারণা চালাতে যাচ্ছি, আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পুলিশ প্রশাসনের সহায়তায় আমার প্রতিটা গণসংযোগে বাধার সৃষ্টি করছে। রাতে বাড়িতে বাড়িতে হামলা হচ্ছে। আমাদের এক কমিশনার প্রার্থীকে আওয়ামী লীগের এক কমিশনার প্রার্থী পিস্তল দিয়ে ভয় দেখিয়েছে। আমি যখন নিউমার্কেটে গেলাম, সেখানে পেছন থেকে একজনকে পুলিশ ধরে ফেলল। আমি দৌড়ে গিয়ে পুলিশকে অনুরোধ করে তাঁকে ছাড়িয়ে আনি। এভাবে ভীতির সৃষ্টি করছে। সরকার যদি একটা সমান প্রতিযোগিতাপূর্ণ নির্বাচন চায়, তাহলে সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। তা না হলে ৫ জানুয়ারির মতো নির্বাচন হয়ে যাবে। এ জন্য আমরা দাবি করেছি সেনাবাহিনী নিয়োগ করতে। আর একটা দাবি কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরার, যাতে কেন্দ্রের মধ্যে ভোট ডাকাতি না হয়, সবাই দেখতে পারে। একটা স্বচ্ছ নির্বাচন হয়।
প্রথম আলো: আপনি তো সাঈদ খোকনের বাসায় গিয়েছিলেন?
আফরোজা আব্বাস: আমি জানতাম না যে তাঁরা ওই বাসায় থাকেন না, সপরিবারে উত্তরের বাসিন্দা হয়েছেন। সেই এলাকায় প্রচারণার সময় আজান শুরু হওয়ায় নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম, সাঈদ খোকন প্রচারণায় থাকলেও তাঁর স্ত্রী বাসায় থাকবেন। তাঁর পাশের বাসায় নামাজ পড়েছি।
প্রথম আলো: দল আর আদর্শ ঢাকা আন্দোলন, আপনার প্রচারণায় এই দুটির কোনটির ভূমিকা কতটুকু? এই দুটির মধ্যে কিছুটা সমন্বয়হীনতা দেখা গেল। আপনার আগেই আদর্শ ঢাকার পক্ষ থেকে হঠাৎ করে ইশতেহার ঘোষণা হয়ে গেল। এই সমন্বয়হীনতা কেন?
আফরোজা আব্বাস: সমন্বয়হীনতা নাই। দল এবং আদর্শ ঢাকা মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আফরোজা আব্বাস: আপনাকেও ধন্যবাদ।