আমাদের সবার প্রিয় মীনা

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েশিশুদের অধিকার রক্ষার তাগিদ থেকে মীনা কার্টুনের জন্ম। দেখতে দেখতে ২১ বছর পার করেছে মীনা। দারুণ জনপ্রিয় মীনা চরিত্রটি এখনো সামাজিক আচরণ পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। শুরুতে শুধু মেয়েশিশুদের অধিকারের কথা বললেও ২১ বছরের পথপরিক্রমায় সব শিশুরই অধিকারের প্রতীক হয়ে উঠেছে মীনা। মীনাকে নিয়ে আমাদের এবারের আয়োজন

মীনা
মীনা

আমি বাবা-মায়ের শত আদরের মেয়ে

আমি বড় হই সকলের ভালোবাসা নিয়ে...

মিষ্টি এই গান কোথায় ব্যবহূত হয়, তা নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না। তার পরও বলছি, আমাদের সবার প্রিয় মীনা কার্টুন ছবির গান এটি। যারা কার্টুন ছবিটি দেখেছে, তারা জানে কার্টুনের প্রতিটি পর্বের শেষে গানটি বেজে ওঠে।

কার্টুনের প্রধান চরিত্র মীনা সবার খুব প্রিয়। দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের একান্ত পরিচিত প্রতীক হচ্ছে মীনা। সে হচ্ছে সমাজ পরিবর্তনের প্রতিনিধি। নয় বছরের মেয়েটির কাজই হলো কিসে সবার ভালো হবে, তা দেখা। মীনার জন্ম ১৯৯২ সালে। দেখতে দেখতে ২১ বছর পার হলেও মীনা আটকে আছে সেই নয় বছরেই।

কেমন করে মীনা দক্ষিণ এশিয়ার মেয়েশিশুদের প্রতীকে পরিণত হলো? এর পেছনে রয়েছে বহু গুণীজনের ভাবনা, শ্রম ও পরিকল্পনা। আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মেয়েদের অবস্থা ছিল করুণ। তখন গ্রামের বেশির ভাগ মেয়েকে পড়তে দেওয়া হতো না। শহরেও অনেক মেয়ে পড়ালেখা করতে পারত না। তখন সবার ধারণা ছিল, মেয়েরা ঘর-সংসার করবে; তাদের লেখাপড়ার কী দরকার। অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়া হতো। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ভালো ভালো খাবার দেওয়া হতো। মেয়েরাও যে ভালো ভালো চাকরি করতে পারে, ব্যবসা করতে পারে—এটা কেউ চিন্তাই করতে পারত না। এ অবস্থার তো পরিবর্তন হওয়া দরকার। তখন দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত সাতটি দেশ—বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভুটান, পাকিস্তান, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা (এখন সার্কভুক্ত দেশের সংখ্যা আটটি। পরে আফগানিস্তান যুক্ত হয়) ১৯৯০ সালকে ‘মেয়েশিশু দশক’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৯০ থেকে ২০০০ সালের মধ্যে মেয়েদের মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক অবস্থান, বিশেষ করে সুবিধাবঞ্চিত মেয়েশিশুদের অধিকার সংরক্ষণ, মেয়ে ও ছেলেশিশুদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং এ সম্পর্কে সব অঙ্গীকার গ্রহণ করা হয়। কিন্তু কীভাবে কাজটি করা হবে? তখন এই দেশগুলো ভাবল, মেয়েশিশুদের অধিকার সংরক্ষণের জন্য এমন একটা কিছু করতে হবে, যা তাদের অবস্থার পরিবর্তনে সহায়ক হবে। দায়িত্ব পড়ল জাতিসংঘের শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) ওপর। ইউনিসেফ চিন্তা করল, যদি এমন একটা চরিত্র সৃষ্টি করা যায়, যে পড়ালেখা করে এমন কিছু কাজ করবে, যা দেখে মেয়েদের মা-বাবারা বুঝতে পারবেন যে মেয়েদেরও লেখাপড়া করানো দরকার। যেমন ভাবা, তেমন কাজ। ডেনমার্কের আর্থিক সহায়তায় তৈরি করা হলো এক নতুন ধারাবাহিক অ্যানিমেশন কার্টুন ছবি, যার প্রধান চরিত্র হলো মীনা। নয় বছরের মীনা ভীষণ হাসিখুশি একটি মেয়ে। সবার জন্য ভালো কিছু করতে মীনা সবার আগে থাকে। সব সময়ই তার আগ্রহ, কিসে এলাকার মানুষের উপকার হয়। যখনই মা-বাবার দরকার পড়ে, তখনই মীনা তাঁদের সাহায্য করে। ঘরের কাজও যেমন করে, তেমনি পড়ালেখাও করে। মীনা কার্টুন তৈরির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ।

মীনা কার্টুন ছবিতে মীনা ছাড়াও আছে আরও বেশ কয়েকটি চরিত্র। আছে ওর পিঠাপিঠি ছোট ভাই রাজু আর প্রিয় পোষা টিয়াপাখি মিঠু। আছে ছোট বোন রানি, মা-বাবা, দাদি, ফুফু, গ্রামের দোকানদার, দোকানদারের ছেলে, স্কুলের বড় আপু রিতা, গ্রামের মোড়ল আর আছে মীনাদের গরু লালী ও ছাগল মুনমুন।

ফিলিপাইনে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের অ্যানিমেশন স্টুডিও হান্না বারবারায় ১৯৯২ সালে মীনা কার্টুনের প্রথম বেশ কয়েকটি পর্ব নির্মাণ করা হয়। এরপর ভারতের রামমোহন স্টুডিওতে নির্মাণ করা হয় মীনা কার্টুন। াখেন বাংলাদেশেই মীনা কার্টুন তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মেয়েশিশুদের যেসব সমস্যা রয়েছে, তার সুন্দর সমাধান এই কার্টুন সিরিজগুলোর মাধ্যমে অত্যন্ত সহজভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

মীনা কার্টুন শুধু বাংলা ভাষায় তৈরি হয়নি। হিন্দি, উর্দুসহ ২৯টি ভাষায় মীনা তৈরি হয়েছে। প্রথমে মীনার ১৩টি পর্ব বানানো হয়েছিল। প্রচার করা হয় সার্কভুক্ত সাতটি দেশের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে। এখন মীনার ২৭টি পর্ব রয়েছে। মীনার কার্টুন ছবি নিয়ে ২৩টি কমিক বইও বের হয়েছে। এসব বইও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ের ওপর টেলিভিশন ও বেতারের জন্য স্পট তৈরি করা হয়।

বাংলাদেশ টেলিভিশনে মীনা কার্টুন দেখানোর পাশাপাশি রেডিওতে প্রচারিত হয় মীনার অনুষ্ঠান। ইউনিসেফ ও বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস প্রথম রেডিওর জন্য মীনা সিরিজ তৈরি করে। ৬৮টি ভ্রাম্যমাণ ফিল্ম ইউনিটের মাধ্যমে মীনা পৌঁছে গেছে দেশের আনাচ-কানাচে। প্রাথমিক বিদ্যালয়, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন এনজিওর আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রকল্পে মীনা কমিক বইগুলো সহায়ক পাঠ উপকরণ হিসেবে ব্যবহূত হয়। এর পর থেকে বাংলাদেশের প্রত্যেকের কাছেই মীনা দারুণ জনপ্রিয়। এর ফলে আসতে থাকে বেশ কিছু পরিবর্তন। আগে গ্রামাঞ্চলের মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হতো না। তাদের বলা হতো বাড়ির কাজ ভালোভাবে শিখে নিতে। মীনা কার্টুন প্রচারিত হওয়ার পর আস্তে আস্তে পরিবর্তন হতে থাকে। মীনা কার্টুনে দেখানো হয়েছে, মীনাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হতো না। কিন্তু কিছু ঘটনার পর তাকে স্কুলে যেতে দেওয়া হয়।

মীনা কার্টুনের একটি পর্বে দেখানো হয়েছে, মীনার ভাই রাজুকে ভালো খাবারটি দেওয়া হয়। কিন্তু মীনাকে দেওয়া হয় না। কারণ হিসেবে বলা হলো, রাজু মীনার চেয়ে অনেক বেশি কাজ করে। কিন্তু মীনা প্রমাণ করে দিল, ছেলেদের চেয়ে মেয়েরা কোনো অংশে কম কাজ করে না। এর পর থেকে মীনাকেও ভালো খাবার খেতে দেওয়া হয়।

মীনা শুধু ছেলেমেয়ের সমান অধিকারের ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করেনি, সে সবার কাছে স্বাস্থ্য-সচেতনতা, পরিবেশ-সচেতনতা এবং শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরেছে। মীনার মাধ্যমে বলা হয়েছে, শিশুদের খেলাধুলা করার ও পর্যাপ্ত বিশ্রামের অধিকার আছে, শিশুর বৃদ্ধি ও পরিচর্যার ক্ষেত্রে বাবা ও মা উভয়ের সমান দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, সব শিশুর মতামত প্রদানের অধিকার রয়েছে, মেয়েদের বাল্যবিবাহ ভালো নয়, যৌতুক নেওয়া একটি মারাত্মক সামাজিক অপরাধ ইত্যাদি।

হাত ধোয়া, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ব্যবহার, বন্যার সময় করণীয়, মেয়েদের নিরাপত্তা, শিশুর ডায়রিয়া হলে কী করতে হবে, শহরে গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতন রোধ ও শিক্ষার সুযোগ প্রভৃতি বিষয়কে মীনা এত সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে যে, শিশুসহ সব বয়সী মানুষের ভেতরে জেগে ওঠে আত্মসচেতনতা। মীনা দেখে অনেক মা-বাবা মেয়েশিশুর অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠেন। তাঁরা তাঁদের মেয়েসন্তানকে স্কুলে পড়তে পাঠান। শিশুরাও স্কুলে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।

মীনার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা হিসাব করে ১৯৯৮ সালে সার্কের পক্ষ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বরকে মীনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর ২৪ সেপ্টেম্বর মীনা দিবস পালন করা হয়। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘মানসম্মত শিক্ষা পেলে বাল্যবিবাহ ও শিশুশ্রম রোধ হবে’।

মীনার উল্লেখযোগ্য কার্টুনগুলো হলো: ‘মুরগিগুলো গুণে রাখ’, ‘বুদ্ধিমতী মীনা’, ‘মীনা এল শহরে’, ‘মীনা কি স্কুল ছেড়ে দেবে’, ‘জীবন বাঁচানো’, ‘মীনার তিনটি ইচ্ছে’, ‘যৌতুক বন্ধ করো’, ‘বিয়ের বয়স হয়নি’, ‘মীনা ও দুষ্টু ছেলেরা’, ‘মেয়েদের যত্ন নাও’, ‘জাদুর পাথর’, ‘মীনার বন্ধু অনু’, ‘নতুন বন্ধু পিনুই’, ‘রূপকথার দেশে মীনা’, ‘পরীর গল্প’ ও ‘মীনার যুদ্ধ’।

ইউনিসেফ বাংলাদেশ ২০০৫ সাল থেকে শিশুদের নিয়ে বা শিশুদের জন্য নির্মিত বিনোদনমূলক, সংবাদভিত্তিক ও জীবনধর্মী প্রতিবেদন, প্রকাশনা ও অনুষ্ঠানের জন্য মীনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড দিয়ে আসছে। পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় নগদ টাকা, ক্রেস্ট ও সনদ। প্রথম পুরস্কার ৫০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় পুরস্কার ২৫ হাজার টাকা ও তৃতীয় পুরস্কার হিসেবে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়।

মীনাকে নিয়ে তৈরি হয়েছে পালাগান, বাউলগান, মীনার পাপেট শো, রেডিও জিঙ্গেল, গান, নাটিকা প্রভৃতি। মীনার ছবি-সংবলিত টি-শার্ট, মগ, বাসন, শুভেচ্ছা কার্ড, মীনা ও মিঠুর পুতুল, স্টিকার প্রভৃতি বানানো হয়।

১৯৯৩ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমান তাদের ফ্লাইটের অভ্যন্তরীণ বিনোদন কর্মসূচিতে মীনা কার্টুন অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিটি ফ্লাইটে মীনা কার্টুন প্রদর্শিত হতো। এ ছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে বিলবোর্ডে স্থান পেয়েছে মীনা। বিভাগীয় শহরগুলোর বিভিন্ন স্থানে রয়েছে মীনার ১১টি দেয়ালচিত্র। ঢাকা শহরের বহু রিকশামালিক তাঁদের রিকশার পেছনে চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের বদলে মীনার ছবি এঁকেছেন। এতেই বোঝা যায়, মীনা কতটা জনপ্রিয়। তথ্যসূত্র: ইউনিসেফ