আমার বাবা

মুর্তজা বশীর, জন্ম: ১৭ আগস্ট ১৯৩২, মৃত্যু: ১৫ আগস্ট ২০২০

কমবেশি সবাই শিল্পী মুর্তজা বশীরকে চেনেন। কিন্তু আমি তাঁকে চিনি আমার বাবা হিসেবে। খুবই নিয়মমাফিক মানুষ ছিলেন তিনি। সাধারণ জীবন যাপন করতেন। বাজার করতেন খুব আনন্দ নিয়ে। আবার খুব রাগীও ছিলেন। মনে আছে, ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে চকবাজারের মেলায় যেতাম, উৎসবগুলোয় যেতাম। বাসায় দাঁড়িয়ে চাচাতো বোনদের সঙ্গে তাজিয়া মিছিল দেখতাম। তখন আমাদের বাড়ির বাইরে বের হওয়ার অনুমতি ছিল না।

বাবার সঙ্গে ঢাকায় আমার শৈশব ছিল এতটুকুই। তারপর আমরা ফ্রান্সে চলে গেলাম। সেখানেও বাবাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। প্রথমে আমরা প্যারিসে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর বাসায় ছিলাম। পরে ধীরে ধীরে আমরা মেমোরেসি এলাকায় থিতু হই। বাবার ভাই ডাক্তার চাচা আবুল বয়ান মুজতাবা নকীয়্যুল্লাহ তখন সৌদি আরবে থাকতেন। তিনি আমাদের ওই সময় অনেক সাহায্য করেছিলেন।

আরও পড়ুন

শৈশব থেকেই বাবার সঙ্গে আমার অন্য রকম অন্তরঙ্গতা, যেটা মায়ের সঙ্গে ছিল না। ছোটবেলা থেকেই আমি একটু ছেলেদের মতো করে বড় হয়েছি। যার কারণে বলা যায়, আমার ছিল দুর্দান্ত সাহস। শার্ট-প্যান্ট পরতাম। এটা বাবাও পছন্দ করতেন। আমিও ছেলেদের মতো বড় হতে চেয়েছিলাম। আমার প্রথম পছন্দ ছিল, সাংবাদিক হব। সাংবাদিক হওয়া মানে, অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা। বাবাকে বললাম। তিনি বললেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই সুযোগ নেই। তারপর আইনজীবী হতে চেয়েছিলাম। এতে অসহায় মানুষদের সাহায্য করতে পারব। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিষয়টি আমার মধ্যে কাজ করত। কিন্তু চিত্রশিল্পী হওয়ার ইচ্ছা কখনো জাগেনি। কারণ, বাবাকে অনেক কষ্ট করতে দেখেছি। যদিও আমাদের তিন ভাই–বোনের মধ্যে ছবি আঁকার বিষয়টি আছে। আমার ছোট বোন মুনীজা বশীর যূথী খুব ভালো আঁকত। আমার ছেলে কুট্টুও নানার ছবি আঁকার মেধাটা পেয়েছে।

এমনও দেখেছি, বাবা বাজার করতে যাচ্ছেন টাকা ছাড়াই। আমরা তখন চট্টগ্রামে কাজীর দেউড়িতে থাকি। অষ্টম-নবম শ্রেণিতে পড়ি। আমাদের বাসায় একটা রেওয়াজ ছিল, গরুর গোশত ছাড়া ভাত খাওয়া হবে না। দুপুর হোক, রাত হোক—এটা একদম স্বাভাবিক বিষয় ছিল। সঙ্গে মুরগিও থাকত। আমার ভাই মেহরাজ বশীর যামী মুরগি খেতে পছন্দ করত। এমনও হয়েছে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ও পরবর্তীকালে উপাচার্য আবদুল মান্নান চাচার কাছ থেকে টাকা ধার করে বাজার করে বাসায় ফিরেছেন বাবা। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে সংসার চালাতেন তিনি।

আমার গৃহকর্তী, মাধ্যম: ক্যানভাসে তেলরং, মাপ: ১২২ X ৯১ সেমি, সাল: ২০০৩, শিল্পী: মুর্তজা বশীর

ছবি বিক্রি হয় না। ছবি আঁকছেন, ঢাকায় যাচ্ছেন, প্রদর্শনী করছেন—এভাবেই আমাদের জীবন চলছিল। কিন্তু অভাববোধ বাবা আমাদের কখনো বুঝতে দেননি। আম্মা খুব সুন্দরভাবে সংসার চালিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় সুজাতের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। এরপরই আমি সন্তানসম্ভবা হওয়ার সুসংবাদ পেয়ে যাই। তখন আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দেব। কিন্তু শরীর অনেক খারাপ। আমি মাস্টার্স পাস করেছি শুধু আমার বাবার জন্য। কারণ, আমার মাস্টার্সের সব নোট বাবার হাতে লেখা। আমার বিষয় ছিল সমাজবিজ্ঞান। বাংলা ছিল ঐচ্ছিক। বাবা রাত জেগে বই ঘেঁটে নোট লিখতেন। আর আমি সেগুলো মুখস্থ করতাম। কারণ, এ বিদ্যা আমার ভালোই ছিল।
বর্ষাকালে বাবা ছবি আঁকতেন না। বলতেন, বর্ষা মানে বিষণ্নতা। তিনি শীতকালে ছবি আঁকতে পছন্দ করতেন। চট্টগ্রামে মেহেদীবাগে শহীদ মির্জা লেনের ফয়েজ বিল্ডিংয়ের বাসায় প্রচুর আলো আসা বিশাল বারান্দায় তাঁকে ছবি আঁকতে দেখেছি। পরে আমরা কাজীর দেউড়িতে এনএসএল ম্যানশনে চলে এসেছিলাম। আসলে বাবা খুব পরিবারকেন্দ্রিক মানুষ ছিলেন। জীবনসঙ্গী ও তিন সন্তানের বাইরে তিনি কিছু বুঝতেন না। এমনকি তিনি আমাদের কারও সঙ্গে মিশতেও দিতেন না। নিজেও খুব একটা মিশতেন না। আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনে সন্ধ্যার পর বাইরে থাকারও অনুমতি ছিল না। বাবার নির্দেশ ছিল, ‘যা-ই কিছু করো, মাগরিবের নামাজের আগে বাসায় ফিরতে হবে।’

আমার বাবা মুর্তজা বশীর বহুমাত্রিক চরিত্র। আমার জন্মের পর থেকে এক বছর হওয়া পর্যন্ত নিজে আমার ছবি তুলে অ্যালবাম বানিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম সন্তান পৃথিবীতে এসেছে, সময়টি তিনি ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। পরে তাঁর কাছ থেকে জেনেছি, আমার ছবির অ্যালবামটি করে তিনি আনন্দ পেয়েছিলেন। আমরা তখন বেগমবাজারে থাকতাম।

ঢাকায় আসার আগে চট্টগ্রামে শেষ ছিলেন নাসিরাবাদে জাকির হোসেন রোডে ‘অবকাশ’ নামের এক বাসায়। এ সময় তিনি প্রচুর গবেষণা ও লেখালেখি করেছেন। ২০০৩ সালে বাবা স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। আমিও তাঁদের সঙ্গে সঙ্গেই থাকতাম। তাই চট্টগ্রামে আমার আর থাকা হলো না। ২০০৪ সালে আমিও ঢাকায় চলে এলাম। প্রথমে কিছুদিন বাবার সঙ্গে থেকে তারপর ঢাকার নানান জায়গায় ছিলাম। ২০০৬ সালে বাবার কাছাকাছি থাকতে মনিপুরীপাড়ার শেলটেক মণিহারে আবার চলে আসি। বাবাকে সারা জীবন থাকতে দেখেছি খুব ব্যস্ত। ডাকটিকিট, মুদ্রা আর টাকা সংগ্রহ করেছেন অবিরত। ২০১৩ সালের শেষ দিকে খুব অসুস্থ হয়ে গেলেন। কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁকে পেসমেকার লাগাতে হলো। সেই যাত্রায় বেঁচে গেলেন তিনি।

আত্মজা, মাধ্যম: ক্যানভাসে তেলরং, মাপ: ৯১ X ৯১ সেমি, সাল: ২০০৩, শিল্পী: মুর্তজা বশীর

২০১৩ সাল থেকে বাবার জীবন খুব সীমাবদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাঁর প্রিয় গরুর গোশত খাওয়া হয়ে গেল নিষিদ্ধ। সকালের নাশতায় আগে–পরে খেতেন কাঁচা হলুদ, এক কোয়া রসুন আর আদাকুচি। এ ছাড়া খেতেন আমলকি, হরতকি ও বহেরাগুঁড়া। হোমিওপ্যাথিক ওষুধও খেতেন। আম্মার মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে তিনি নামাজ পড়তে শুরু করলেন।

শেষের দিকে বাবাকে আঁকতে বলতাম। আম্মাকে অমর করে রাখতে চাওয়া সিরিজের ছবি আঁকতে উৎসাহ দিতাম। তিনি বলতেন, ‘কী আঁকব, সেগুলো মাথায় কাজ করে। ছবি আঁকা শুরু করলেই হয়ে যাবে।’ আমাকে বলতেন, ‘ছবি আঁকা তো রান্না না যে তোর মতো ঝটপট করে ফেলব। আমি কী আঁকব, সব সময় আমার মাথার কম্পিউটারে সেট করা আছে।’ ২০১৯ সালে অয়েল প্যাস্টেলে কাগজে কিছু জ্যামিতিক কাজ করেছিলেন। আয়াতবিষয়ক একটি সিরিজ করার চিন্তা করেছিলেন। সেসব কিছু না করেই ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট বাবা আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন।
আমি কখনো অনুভব করি না, বাবা নেই। প্রতিবছর শীতের সময় নার্সারিতে যেতাম তাঁকে নিয়ে। নিজে পছন্দ করে গাছ নিয়ে আসতেন। আর কখনো যাওয়া হবে না। যদিও বাবা আছেন সব সময় আমার সঙ্গে। প্রতিদিনই তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়, কথা হয়। বাবা, আপনি যেখানেই আছেন, ভালো থাকবেন।

মুনীরা বশীর: শিল্পী মুর্তজা বশীরের বড় মেয়ে