আম মানেই উৎসব

আম মানেই উৎসব। কেন? কারণ, আম মানেই স্মৃতি। আম কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার, আমার মতো আমজনতার অবশ্যই মনে পড়ে যাবে শৈশবের কথা। আর এই এলাকার নৃগোষ্ঠীর মনে পড়বে সম্মিলিত মানুষের ইতিহাস, প্রায় ছয় হাজার বছর আগেও এই অঞ্চলে নাকি আম ছিল।

আমের কথা আছে পুরাণে, আমের কথা আছে কালিদাসে, গৌতম বুদ্ধ আমবাগানের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছিলেন, বৈশালীর আম্রপালি ছুটে এসেছিলেন তাঁর কাছে, আলেকজান্ডার আমের প্রশংসা করেছিলেন, আকবর বাদশাহ এক লাখ গাছের আমবাগান করেছিলেন—কথার তো শেষ নেই। আমাদের জাতীয় সংগীতে আছে আমের বনে ঘ্রাণে পাগল হয়ে যাওয়ার কথা, আর বাংলার স্বাধীনতা পলাশীর আম্রকাননে অস্ত গিয়ে উদিত হয়েছিল মুজিবনগরে, মেহেরপুরের আমবাগানে।

মাহবুব সিদ্দিকীর লেখা বই আম-এ একটা চমৎকার রস-গল্প আছে রসাল নামের ফলটি নিয়ে। ‘বীরবল শাহি ভোজ খাচ্ছেন। বাদশাহ আকবর বললেন, বীরবল, আরও খাও। বীরবল বললেন, মাফ করুন, পেটে আর এক কণাও জায়গা নেই। তারপর এল পাকা পাকা নধরকান্তি আম। বীরবল হাত বাড়ালেন। পেট বরাবর চালিয়ে দিলেন কয়েকটা আম। বাদশাহ বললেন, এ কী বীরবল! তুমি যে বললে পেটে কোনো জায়গাই নেই। বীরবল জবাব দিলেন, রাস্তায় ভিড়। কারও পা ফেলার জায়গা নেই। এই সময় আপনি যদি রাস্তায় যান, লোকেরা সরে যাবে। আপনার পথ ঠিকই হয়ে যাবে। তেমনি ফলের রাজা হলো আম। রাজা এসেছে, পেটে আর সব খাদ্য সরে গেছে। জায়গা হয়ে গেছে।’

রাজা-বাদশাহদের কথা থাকুক, আমার নিজের কাছে আম মানেই শৈশবের রঙিন দিনগুলোর সানন্দ প্রত্যাবর্তন। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—
সেই মনে পড়ে, জ্যৈষ্ঠের ঝড়ে রাত্রে নাহিকো ঘুম,
অতি ভোরে উঠি তাড়াতাড়ি ছুটি আম কুড়াবার ধুম।
সেই সুমধুর স্তব্ধ দুপুর, পাঠশালা-পলায়ন—
ভাবিলাম হায়, আর কি কোথায় ফিরে পাব সে জীবন!

আমাদের সবার শৈশবজুড়ে আছে আম আঁটির ভেঁপু, আমাদের সবার ছোটবেলা একই রকম, অপু আর দুর্গার কালবোশেখির মধ্যে ছুটে যাওয়া আমগাছতলায়। কাঁচামিঠা নামে এক-আধটা আমগাছ থাকতই আশপাশে, আমের মুকুল থেকে গুটি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো অবিরাম ঢিল নিক্ষেপ। নুন-লঙ্কা দিয়ে কাঁচা আম মেখে খাওয়া। তারপর আসবে আম-কাঁঠালের ছুটি। একটা দেশে একটা ‘ভ্যাকেশনের’ নামই আম আর কাঁঠাল দিয়ে, উফ্‌! পাকা আম নিয়ে খোসা ছাড়িয়ে কামড়ে খাচ্ছি, কনুই বেয়ে নামছে আমের রস, শার্টজুড়ে আমের রসের দাগ, ধোয়ার পরও সেই দাগ আর যাবে না। আমের আচার থেকে আমসত্ত্ব, আম-ডাল থেকে ম্যাংগো স্টিকি রাইস, আম দিয়ে দুধভাত থেকে ম্যাংগো লাচ্ছি। আম-দুধ মিলে যায়, আঁটি যায় ভাগাড়ে। কখনো কখনো আমও যায়, ছালাও যায়।
আমাদের অর্থনীতিতে আমের স্থান অতি উচ্চ। বাংলাদেশের আমের বাজার নাকি ১৪ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশে সৃজনশীল বইয়ের বাজার চার শ কোটি টাকার মতো, তার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যাবে, জ্ঞানের চেয়ে আম বড়! কাজেই জামাইবাড়িতে বড় বড় আমের ঝাঁকা পাঠান। অফিসের বসের বাড়িতে দুই বাক্স আম পাঠিয়ে বলুন, নিজের বাগানের।

আম নিয়ে পুরান ঢাকার কৌতুক দুটো বলে নিই।
১. ক্রেতা বললেন, কী মিয়া, তোমার আম সত্যিই ল্যাংড়া তো? বিক্রেতা বললেন, ছাহেব, এইটাও কওন লাগব, ল্যাংড়া না হইলে কি মাথায় কইরা ঝাঁকায় তুইলা আনতে হয়?
২. ক্রেতা বললেন, কী মিয়া, তোমার আম তো ছোট? বিক্রেতা বলল, খালি আমার আমের বাইরের চেহারা দেখবেন? আমার আমের আঁটি বড়!

সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছেন, এই কৌতুকের বিলেতি রূপ হলো, ‘কী সাহেব, আপনি নাকি রোজ দেরি করে অফিস আসেন?’ ‘আপনি কি শুধু আমার আসাটা দেখবেন। যাওয়াটা দেখবেন না? আমি রোজ তাড়াতাড়ি অফিস থেকে যাই।’
আমাদের শিশুশিক্ষা শুরু হয় আম দিয়ে। ছোটবেলায় প্রথম শব্দ আমরা পড়ি আ আর ম। আম। আর আমাদের প্রথম ছবি আঁকতে হয় আমের। কখনো কখনো আমাদের জীবনের শেষ ইচ্ছা হয় আম খাওয়ার। কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর হবে। তিনি নিজে শেভ করে আম কেটে খেলেন। তারপর হেঁটে গেলেন ফাঁসির মঞ্চের দিকে। শেরেবাংলা ফজলুল হক কত ডজন আম খেয়েছিলেন এক বৈঠকে, তা নিয়ে কথা এখনো শেষ হয়নি। ‘আমগাছ জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’ (মাহবুব সিদ্দিকী)

আম নিয়ে উৎসব করা তাই বাহুল্য নয়। বরং আম নিয়েই তো উৎসব করা উচিত। আমের আছে ইতিহাস, আছে ঐতিহ্য, আছে বর্তমান, আছে ভবিষ্যৎ, আমের আছে অর্থনীতি, আছে বর্ণ, গন্ধ, রস, স্বাদ। আসুন, যোগ দিই আমের উৎসবে।