
১৯৮০ সালের কথা। মুন্সিগঞ্জসহ দেশের হাতে গোনা কয়েকটি জেলায় আলুর চাষ হতো। ওই বছর দেশে আলুর ফলন হয়েছিল নয় লাখ টন। তখন আলু ছিল গরিবের খাবার। সেই দিন বদলে গেছে, দেশে আলুর ফলন এখন কোটি টন ছুঁই ছুঁই করছে। গত এক যুগে দেশে আলুর ফলন বেড়েছে তিন গুণ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তের আলু ভর্তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এখন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর চিপস হিসেবেও জায়গা করে নিয়েছে।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক খাদ্য নীতি গবেষণা কেন্দ্রের (ইফপ্রি) এক যৌথ গবেষণা বলছে, গত পাঁচ যুগে বাংলাদেশে নীরব আলুবিপ্লব ঘটে গেছে। ভাতের পর এখন দেশের দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য ও খাদ্যশক্তির উৎস হচ্ছে আলু। গত পাঁচ যুগে এর উৎপাদন বেড়েছে ২৬ গুণ। আর মাথাপিছু আলু খাওয়ার পরিমাণ বেড়েছে ১০ গুণ। দেশের খাদ্যশক্তির এখন দ্বিতীয় প্রধান উৎস হচ্ছে আলু।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন শুধু আলুর উৎপাদন বৃদ্ধির দিকেই নজর দিচ্ছি না, বিদেশে রপ্তানি উপযোগী উন্নত আলু চাষের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। একই সঙ্গে সরকারি উদ্যোগে বিদ্যুৎ ছাড়া আলু সংরক্ষণাগার নির্মাণ করা হয়েছে। কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী দেশ ছাড়াও ইউরোপের বাজারে আলু রপ্তানি করছে। আমরা চেষ্টা করছি আলুর রপ্তানির পরিমাণ আরও বাড়াতে।’
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ২০১৩ সালের সর্বশেষ আলুর উৎপাদন-বিষয়ক পরিসংখ্যান বলছে, আলু উৎপাদনে বিশ্বে সপ্তম বাংলাদেশ। আর বাংলাদেশের ওপরে আছে চীন, ভারত, রাশিয়া, ইউক্রেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি। এফএওর হিসাবে ওই বছর বাংলাদেশে আলুর উৎপাদন হয়েছিল ৮৩ লাখ ২৬ হাজার ৩৯০ মেট্রিক টন। আর ২০০২ সালে হয়েছিল প্রায় ৩০ লাখ টন।
ইফপ্রি, বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী আখতার আহমেদ এ ব্যাপারে প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবন এবং কৃষকদের প্রচেষ্টায় আলু চাষের এই সফলতা এসেছে। কিন্তু দেশে দু-এক বছর পরপর কৃষকেরা আলু নিয়ে বিপাকে পড়েন। হিমাগারের অভাবে আলু রাখা যায় না। আলুর এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে স্বল্পব্যয়ে আলু সংরক্ষণাগার তৈরির ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে।
এ ব্যাপারে ইফপ্রি বাংলাদেশের প্রধান আখতার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান হিসেবে আলুর আবির্ভাব বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এতে অভ্যন্তরীণ বাজার আরও বিস্তৃত হলো। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের উপযোগী আলু উৎপাদন বাড়াতে হলে বীজ ও চাষ পদ্ধতির উন্নতি প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে এ বছর সারা দেশে ৯২ লাখ ৫৪ হাজার টন আলু হয়েছে। আর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এ বছর আলুর ফলন কোটি টন ছাড়িয়ে যাবে। এফএওর হিসেবে আলু উৎপাদনে এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে চীন ও ভারত। অথচ গত পাঁচ বছর আগেও বাংলাদেশ আলু উৎপাদনকারী দেশের তালিকায় প্রথম ২০টি দেশের তালিকাতেও ছিল না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কন্দাল গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা বিমল কুন্ডু প্রথম আলোকে বলেন, মূলত ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলু উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়তে থাকে। ইউরোপে যেখানে আলু পরিণত হতে পাঁচ থেকে ছয় মাস লাগে, সেখানে বাংলাদেশে আলু হতে তিন মাস লাগে। এখানকার মাটি, পানি ও আবহাওয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে যাওয়ায় আলুর উৎপাদন সময়কাল কমেছে বলে জানান তিনি।
গত এক যুগে দেশের বিজ্ঞানীরা ৬১টি আলুর জাত উদ্ভাবন করেছেন। গত এক বছরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) আলুর নতুন জাত উদ্ভাবনে বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। ২০১৪ সালে বারি-৪৭ থেকে বারি-৬১ পর্যন্ত আলুর মোট ১৫টি নতুন জাত উদ্ভাবন করেছেন বারির বিজ্ঞানীরা। দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাতগুলো থেকে দেশের ৭৫ শতাংশ আলু উৎপাদিত হচ্ছে বলে বারি থেকে জানানো হয়েছে।
বারি সূত্রে জানা গেছে, এত দিন দেশে আলুর অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল ব্যাকটেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়া। এ বছর বারি আলু-৪৬ ও বারি আলু-৫৩ নামে নতুন দুটি জাত উদ্ভাবন করেছেন আলু গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা, যাতে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ হবে না। এসব আলু বিদেশে রপ্তানি করতেও সুবিধা হবে।
আলু উৎপাদন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে আলু রপ্তানি করাও শুরু করেছে। তিন বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে আলু রপ্তানি বাড়ছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৪-১৫ অর্থবছরে প্রায় ২৩৩ কোটি টাকার আলু রপ্তানি হয়েছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে মাত্র ৩২ কোটি ২২ লাখ টাকার আলু রপ্তানি করেছিল। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তা ২৫০ কোটি ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ আলু গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের আলুর আদি জাত হচ্ছে মিষ্টি আলু। আর গোল আলুর আদি জাত দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরুতে। পরবর্তী সময়ে তা পর্তুগিজ ব্যবসায়ী ও নাবিকদের হাত ধরে ইউরোপে আলুর চাষ শুরু হয়। বাংলাদেশে ২০০ বছর আগে পর্তুগিজ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুন্সিগঞ্জ জেলায় আলুর আবাদ শুরু হয়।
আশির দশকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) বিজ্ঞানীরা নেদারল্যান্ডসের জাতগুলোকে উন্নত করে দেশের আবহাওয়া উপযোগী করা শুরু করে। নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত আলুর জাত কৃষকেরা চাষাবাদ শুরু করেন। দেশের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত তিন মাসে ফলন হয় এমন আলুর জাত উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করে। বর্তমানে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি এলাকা ছাড়া দেশের সব স্থানেই আলুর চাষ হচ্ছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু ফলে মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া ও রংপুর জেলায়।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশের খাদ্যশক্তির দ্বিতীয় প্রধান উৎস আলু। বাংলাদেশের মানুষ বছরে মাথাপিছু ২৩ কেজি করে আলু খায়, যা ভারতের চেয়ে আট কেজি বেশি। আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়ায় বাংলাদেশের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আলু বাংলাদেশের মানুষের ভিটামিন ও কার্বোহাইড্রেটের চাহিদার অনেকাংশ পূরণ করছে।
গত এক যুগে দেশে আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য যেমন চিপস, ফ্লেক্স ও অন্যান্য খাদ্য ও পণ্য উৎপাদন বাড়ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ক্যাটালিস্টের হিসাবে ২০১১ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশে ১৫টি আলু প্রক্রিয়াজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা স্থাপিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি কোম্পানি আলু থেকে উৎপাদিত চিপস ও ফ্রেঞ্চ ফ্রাই বিদেশেও রপ্তানি করছে।