ইউক্রেনে রুশ হামলা ও বাংলাদেশের নিরপেক্ষতা

২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে স্থল, আকাশ ও জলপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন রাশিয়ার সেনারা
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে রুশ হামলার ১৯ দিন অতিবাহিত হলো। চেচনিয়ার গ্রোজনি ও সিরিয়ার আলেপ্পোতে রুশ বাহিনী যেভাবে পোড়ামাটি নীতি অনুসরণ করেছিল, এখানেও তাই ঘটছে। ভাবা হয়েছিল বিদ্যুৎ–গতিতে রাজধানী কিয়েভ দখল হবে, নতুন রুশপন্থী সরকার গঠিত হবে এবং পুরো দেশ হাতের মুঠোয় আনা যাবে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনীয়দের সম্বন্ধে বলেছিলেন, এরা স্বাধীনতার যোগ্য নয়, কারণ তারা ‘লিটল রাশিয়ান’ বা খুদে রুশ মাত্র। সে খুদে রুশরা মস্কোর নির্দেশ মানতে রাজি না হওয়ায় এখন তাদের বোমায় বিধ্বস্ত করে হত্যার চেষ্টা চলছে।

এ যুদ্ধে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছে, তারা রুশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে উত্থাপিত এক নিন্দা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে মোট ১৪১টি দেশ। এ প্রস্তাবে দাবি করা হয়েছে, রাশিয়াকে ‘অবিলম্বে, পুরোপুরি ও নিঃশর্তে’ ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। মাত্র চারটি দেশ রুশ সরকারের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে প্রস্তাবটির বিপক্ষে ভোট দেয়। ৩৫টি দেশ নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে ভোটদানে বিরত থাকে, তাদের মধ্যে আছে বাংলাদেশ, ভারত ও চীন।

ঘটনাটি আমাদের ১৯৭১ সালের কথা মনে করিয়ে দেয়। ইউক্রেনের প্রশ্নটি রুশ ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণে ব্যর্থ হলে তা স্থানান্তরিত হয় সাধারণ পরিষদে। ১৯৭১ সালেও রুশ ও চীনা ভেটোর কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো প্রস্তাব গ্রহণে ব্যর্থ হলে বিষয়টি আলোচনার জন্য পাঠানো হয় সাধারণ পরিষদে।

নিরাপত্তা পরিষদ অথবা সাধারণ পরিষদে কোথাও বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতি মেলেনি। উভয় ক্ষেত্রেই একমাত্র লক্ষ্য ছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান যুদ্ধের বিরতি। ৭ ডিসেম্বর গৃহীত সে প্রস্তাবে ১০৪টি দেশ যুদ্ধবিরতির পক্ষে এবং ১১টি দেশ বিপক্ষে ভোট দেয়। ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে।

১৯৭১ সালে সেই ভোটের সময় ভারত ও রাশিয়া (তখন দেশটির নাম ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন) একদিকে ছিল, তারা যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। এটা এমন এক সময়ের কথা, যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ তার চূড়ান্ত প্রহরে প্রবেশ করেছে। এমন সময় যুদ্ধবিরতির অর্থই দাঁড়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিলম্ব অথবা বানচাল। সেদিন স্বাধীনতা ও মুক্তির পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে থাকায় আমাদের শৃঙ্খলমুক্তি ত্বরান্বিত হয়েছিল।

নৈতিকতা বনাম জাতীয় স্বার্থ
মার্কিন কূটনীতিক জর্জ কিনান একসময় বলেছিলেন, নৈতিকতা নয়, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থই মুখ্য। সময়ের বদল হয়েছে, পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তন এসেছে। আজকের যে রাশিয়া, তা সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়। জাতীয় স্বার্থ উপেক্ষা করে সেদিন যারা নির্যাতিত বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিল, আজ তারা জাতীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে নিজেরাই আক্রমণকারী। এটাও মোটেই কাকতালীয় নয় যে ভারত ও বাংলাদেশ এখন রাশিয়ার পাশে। দেশটির সঙ্গে তাদের উভয়েরই রয়েছে গভীর ও বহুমাত্রিক সামরিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক। ইউক্রেন প্রশ্নে তাদের যে ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান, তা বস্তুত রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক রসায়নের কারণে চীন আজ রাশিয়ার পাশে, যদিও ভোটদানে বিরত থেকে সে–ও নিজেকে নিরপেক্ষতার মোড়কে ঢাকতে চেয়েছে। একই কথা পাকিস্তান সম্বন্ধে, তারাও প্রস্তাবটির পক্ষে-বিপক্ষের বদলে ভোটদানে বিরত থাকে।

এ যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়, সাধারণ পরিষদের এ ভোট থেকে তার হদিস মেলে। বাংলাদেশ বলেছে, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, কূটনৈতিক উদ্যোগের মাধ্যমে ইউক্রেন প্রশ্নের সমাধান হোক। তারা জাতিসংঘ মহাসচিবকে এ প্রশ্নে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ করেছে। একই কথা বলেছে ভারত। একটি ক্ষুদ্র দেশ আক্রান্ত হয়েছে, তাদের আঞ্চলিক নিরাপত্তা হুমকির মুখে, ভারত বা বাংলাদেশ কেউ সেটার নিন্দা করেনি, বরং কূটনৈতিক ভাষার ‘জুজুৎসু’ দেখিয়ে দায়িত্ব এড়িয়ে গেছে।

বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এ ভোট গ্রহণের সময় তিনি নিউইয়র্কে। আমার এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ-টুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তি চাই।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যের সাধুতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু সমস্যা হলো, যুদ্ধ চাই না, কিন্তু যুদ্ধ তো শুরু হয়ে গেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সবার আগে চাই যুদ্ধের সমাপ্তি। আমরা সত্যি সত্যি যদি সে যুদ্ধের সমাপ্তি চাই, তাহলে তার একটি পূর্বশর্ত হলো চলমান যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ।

ভোটদানে বিরত থাকা যে নিরপেক্ষতা নয়, রাশিয়ার পক্ষে ভোট, সে কথা আর কেউ না হোক, রাশিয়া নিজে বিশ্বাস করে। সিঙ্গাপুরে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই কুদাশেভ ভোটদানে বিরত থাকা দেশগুলোর কথা উল্লেখ করে দাবি করেছেন, ৩৫টি দেশ এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোটদানে বিরত থেকেছে, তা থেকে প্রমাণিত হয় রাশিয়া মোটেই একা নয়। ভারত ও চীনের মোট জনসংখ্যা যোগ করে তিনি বলেছেন, বিশ্বের অধিকাংশ মানুষ পশ্চিমের বিপক্ষে ভোট দিয়েছে। তিনি এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোকে ইউক্রেনের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামানোর বদলে কোভিড–১৯ নিয়ে ভাবার পরামর্শ দিয়েছেন।

ইউক্রেন ও একাত্তর
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে উদ্ভূত সংকটের জন্য চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রায় সব আরব দেশ ভারতকে দোষারোপ করেছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে বলেছিল বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন। এসব দেশ কেউ বাংলাদেশের মানুষের ন্যায্য আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে মত দেয়নি। আজ রাশিয়ার হামলার পক্ষে সাফাই হিসেবে পশ্চিমের ঘাড়ে দোষ চাপানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, রাশিয়ার আইনসংগত নিরাপত্তা উদ্বেগ উপেক্ষা করে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোই এ যুদ্ধের কারণ। একইভাবে এ জোটের সদস্যপদ প্রার্থনা করে ইউক্রেনও একই অপরাধে অপরাধী।

ন্যাটোর সম্প্রসারণের কারণে নিজের নিরাপত্তা প্রশ্নে রাশিয়ার উদ্বেগ অজ্ঞাত নয়, এ প্রশ্নে কোনো কোনো পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ তাদের সহানুভূতির কথাও বলেছে (যেমন জার্মানি ও ফ্রান্স)। এ সমীকরণে বিবদমান পক্ষ ন্যাটো ও রাশিয়া আর তাদের মধ্যে ‘প্রক্সি’ লড়াইয়ের শিকার ইউক্রেন। ঘুঁটি হিসেবে যে দেশটিকে ব্যবহার করা হচ্ছে, সে কী চায়, কেন চায়, সে কথা বিবেচনায় আনাও কি জরুরি নয়? বাড়ির পাশে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ ঘনঘন গরম নিশ্বাস ছাড়ছে, ক্ষুদ্র দেশটি যদি নিজের নিরাপত্তার জন্য বিকল্প পথের খোঁজ করে, তা কি একদম অযৌক্তিক?

একাত্তরে ঠিক এভাবেই বাংলাদেশ সংকটের প্রশ্নটি ভারত ও পাকিস্তানের (এবং তাদের যার যার সমর্থক পরাশক্তির) লড়াই ভেবে বাঙালিদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করা হয়। কোনো কোনো পণ্ডিত যুক্তি দেখিয়েছেন, ন্যাটোতে অংশগ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করে ইউক্রেন এ যুদ্ধে রাশিয়াকে উসকিয়েছে। একাত্তরে বঙ্গবন্ধুকেও একই অভিযোগ শুনতে হয়েছিল। ইয়াহিয়া ও জুলফিকার আলী ভুট্টো দুজনেই বলেছিলেন, সব দোষ মুজিবের, কারণ তিনি আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি তুলে পাকিস্তান ভাঙতে চাওয়ার মতো গর্হিত অপরাধ করেছিলেন।

ভিন্ন অবস্থানে নেপাল
বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থান নিলেও দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি ক্ষুদ্র দেশ নেপাল, মালদ্বীপ ও ভুটান—ইউক্রেন প্রশ্নে জাতিসংঘের এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়ে ইউক্রেনের জনগণের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে।

ভূরাজনৈতিক অবস্থানের দিক দিয়ে বাংলাদেশ ও নেপাল একে অপরের কাছাকাছি। তারা দুজনেই ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী। উভয় দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভারতের হস্তক্ষেপের ক্ষমতা অপরিসীম, ফলে দেশটিকে তারা কেউ চটাতে চায় না। চীনের সঙ্গেও তারা নিকটতর সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী, সে কাজে বেশ সাফল্যও পেয়েছে তারা। তা সত্ত্বেও ইউক্রেন–বিতর্কে তাদের অবস্থানের প্রভেদ প্রশ্ন উদ্রেক করে বৈকি। কেন ভোটদানে বিরত ছিল, এ প্রশ্নে বাংলাদেশের জবাব, ‘আমরা যুদ্ধ-টুদ্ধ চাই না।’

অন্যদিকে জাতিসংঘে নেপালের রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, তাঁর দেশ কোনো দেশের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক সার্বভৌমত্বের ওপর শক্তি ব্যবহার বা শক্তি ব্যবহারের হুমকির বিরোধী। এর আগে নেপালি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের সমালোচনা করে যে বিবৃতি দেয়, তাতেও সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় সংহতি প্রশ্নে জাতিসংঘ সনদে উল্লেখিত নীতি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার তাগিদ দেওয়া হয়।

নেপালি বিশেষজ্ঞেরা এ অবস্থানকে যতটা না জাতীয় স্বার্থের প্রতিফলন, তার চেয়ে অধিক নৈতিক হিসেবে দেখছেন। ২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর জাতিসংঘের প্রস্তাবে নেপাল ভোটদানে বিরত ছিল। সে দেশের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী রমেশ নাথ পান্ডে সেই ভোটকে ‘ভুল’ বলে চিহ্নিত করে বলেছেন, এবার যে আমরা একটি প্রতিবেশী দেশের ওপর হামলার বিরোধিতা করেছি, সেটাই সঠিক অবস্থান।

নেপালি বিশেষজ্ঞ আর্জুন বাহাদুর থাপা সে কথা সমর্থন করে বলেছেন, জোটনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে অন্য দেশের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপের যেকোনো চেষ্টার বিরোধিতার নীতি অনুসরণ অধিক বাস্তবসম্মত।

ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রতিবাদের বদলে নিরপেক্ষতার চাদরে মুখ বুজে থেকে বাংলাদেশ তাদের জাতীয় স্বার্থ কীভাবে ও কতটা রক্ষা করল তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, হয়তো হবে। নিরপেক্ষতা প্রমাণের জন্য বাংলাদেশের যে অবস্থান তা যদি জাতীয় স্বার্থের অনুকূল মেনেও নিই, তা যে নৈতিক নয়, এ কথা বলা বোধ হয় অন্যায় নয়। নেপালের অবস্থান থেকে আমরা সে শিক্ষাই পাই।

কিয়েভে আমার প্রাক্তন সহপাঠী ভিক্তর, যার কথা আমি একাধিকবার উল্লেখ করেছি, সে আমাকে লিখেছিল, এ অসম যুদ্ধে আমরা অবশ্যই জিতব, তবে সে জন্য আমাদের প্রয়োজন বিশ্বের মানুষের সমর্থন। আমার কাছে ভিক্তরের প্রশ্ন ছিল, এ লড়াইয়ে তোমাদের পাশে পাব তো?

বাংলাদেশের কাছে এ প্রশ্ন আমারও।