রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ
ইউক্রেন ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান কতটা যৌক্তিক
জাতিসংঘে ইউক্রেন প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান এত দিনের অনুসৃত নীতিগত অবস্থান থেকে ভিন্ন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সঙ্গেও বাংলাদেশের অবস্থানের মিল নেই।
যেকোনো যুদ্ধের একটি বড় ফ্রন্ট হচ্ছে কূটনৈতিক ফ্রন্ট। যুদ্ধক্ষেত্র ও অর্থনৈতিক ফ্রন্টের পাশাপাশিই চলে এ ফ্রন্টের লড়াই। যুদ্ধরত দুই পক্ষই চায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের সমর্থন নিশ্চিত করতে। এ কূটনৈতিক লড়াইয়ের জায়গাটি হচ্ছে জাতিসংঘ। যদিও এটা ঠিক যে গত তিন-চার দশকে কোনো ধরনের সংঘাত এড়ানো বা বন্ধ করার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের সাফল্য আশাব্যঞ্জক নয়। তদুপরি কাঠামোগত কারণে জাতিসংঘের সক্রিয়তা কার্যত নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো ক্ষমতার অধিকারী পাঁচটি দেশের ইচ্ছানির্ভর হয়ে পড়েছে। এটি বলাও অতিরঞ্জিত হবে না যে পশ্চিমা দেশগুলোর পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড আছে, জাতিসংঘে তাদের আচরণে সেটা স্পষ্ট হয়। আবার এ ধরনের দ্বিচারিতা থেকে অ-পশ্চিমা বলে পরিচিত রাশিয়া বা চীনও মুক্ত নয়। তাই অনেকেই এখন এটা বলেন থাকেন, জাতিসংঘের আসলে আর কোনো রকম শক্তি নেই, কার্যকারিতাও নেই। এখানে বলে রাখা ভালো, জাতিসংঘ কেবল একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নয়, এর বিভিন্ন ধরনের এজেন্সি আছে, যেগুলো অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা জাতিসংঘ বলতে নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদকেই বুঝি। জাতিসংঘে কূটনৈতিক লড়াইয়ের আরেকটি কারণ হচ্ছে, নৈতিকভাবে নিজেদের অবস্থানের শক্তি দেখানো। নৈতিক বিজয় আশু ফল নির্ধারণ করে না, কিন্তু বিশ্বজনমত গঠনে সহায়তা করে। দীর্ঘ মেয়াদে তা যুদ্ধের গতিপথকে প্রভাবিত করে।
ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে জাতিসংঘে কী হয়েছে
রাশিয়া ২২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই এর বিরোধিতা করে বিবৃতি দেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার এ সিদ্ধান্ত কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। এতে ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘিত হয়েছে। সেই সঙ্গে এটি জাতিসংঘ সনদের যে নীতি, তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।’ ২৪ ফেব্রুয়ারি রুশ বাহিনী আগ্রাসন সূচনা করার সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক ডাকা হয়। ২৫ তারিখের এ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও আলবেনিয়ার পক্ষ থেকে রাশিয়াকে নিন্দা করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। এতে ১১টি দেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, তিনটি দেশ—ভারত, চীন ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ভোটদানে বিরত থাকে। রাশিয়ার ভেটোর কারণে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি।
নিরাপত্তা পরিষদ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের জরুরি অধিবেশনে তা আলোচনার জন্য পাঠিয়ে দেয়। ৩ মার্চ অনুষ্ঠিত এ অধিবেশনে রাশিয়ার ‘সামরিক অভিযান’–কে ‘আগ্রাসন’ বলে বর্ণনা করে তার নিন্দা, পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধিতা এবং অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে রাশিয়ার সৈন্য প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। ১৯১টি দেশের মধ্যে ১৪১টি দেশ এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। ৩৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং রাশিয়াসহ পাঁচটি দেশ এ প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দেয়।
বাংলাদেশের অবস্থান কী
দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ ভোটদানে বিরত ছিল। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার চারটি দেশ—নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তান। সাধারণ পরিষদের এ বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকার বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যে সামান্য আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশে অনেকেই একে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ বলেই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আসলেই কি তাই? জাতিসংঘে বাংলাদেশের দেওয়া অতীতের ভোটগুলো কি তার ইঙ্গিত দেয়? স্মরণ করা দরকার যে উত্থাপিত ও গৃহীত প্রস্তাবটি হচ্ছে একটি দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রশ্ন বিষয়ে ভোট। ভোটদানে বিরত থাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির কী ইঙ্গিত দিচ্ছে, তা বোঝা দরকার।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরুর দুই দিনের মধ্যে ২৬ ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে ইউক্রেন পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছিল এবং বাংলাদেশ সব ধরনের সংঘাত ও ‘ইউক্রেনের এলাকায় চলমান সামরিক অভিযান বন্ধের’ আহ্বান জানিয়েছিল। তাতে বলা হয়েছিল ‘বাংলাদেশ বিশ্বাস করে, জাতিসংঘের সনদে বলপ্রয়োগ নিষিদ্ধ করা, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তির যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, তা অবশ্যই ব্যতিক্রম ছাড়াই সব পরিস্থিতিতে মেনে চলতে হবে।’
এ বিবৃতির একটি অন্য ভাষ্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উপস্থাপন করেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের উপস্থায়ী প্রতিনিধি মনোয়ার হোসেন। এ সময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন নিউইয়র্কে অবস্থান করলেও জাতিসংঘের এ বিতর্কে অংশ নেননি।
বাংলাদেশ কেন ভোটদানে বিরত ছিল—তার দুটি ব্যাখ্যা ইতিমধ্যে দুজন মন্ত্রী দিয়েছেন। নিউইয়র্কের একটি বাংলা টিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা সব রকম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হোক, আমরা সেটাই চাই।’ ক্ষুদ্র দেশ হিসেবে সব রকম যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সংকট বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী (ডয়েচে ভেলে, ৩ মার্চ ২০২২)। পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে আরও বলেন, ‘শান্তি চাই বলেই নিরাপত্তা পরিষদে ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে বাংলাদেশ।’
পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, ‘দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে রাশিয়া-ইউক্রেন ইস্যুতে আমরা ভোট দিইনি।’ পরিকল্পনামন্ত্রী আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য, কর্মচারী নয়। ভোট দেওয়া না দেওয়ার হিসাব আমরা করব আমাদের দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে। শুধু আমরা একা নই, আরও অনেক রাষ্ট্র আমাদের সঙ্গে একই অবস্থানে গিয়ে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থেকেছে (যুগান্তর, ৫ মার্চ ২০২২)।’
এর এক দিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘খসড়া প্রস্তাবটি পড়লে দেখবেন, এটা যুদ্ধ বন্ধের জন্য নয়। কাউকে দোষারোপের জন্য এটি। আমরা শান্তি চাই। আমরা চাই না কোথাও যুদ্ধ হোক (প্রথম আলো, ৬ মার্চ ২০২২)।’ এসব বক্তব্যে বাংলাদেশের মন্ত্রীরা যে কথাটি উল্লেখ করছেন না তা হচ্ছে বাংলাদেশের এ অবস্থান অতীতে জাতিসংঘে ক্ষুদ্র দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে গৃহীত অবস্থান এবং নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে দেওয়া ভোটের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের জরুরি বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্লেষণ করলেই তা বোঝা যাবে।
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের অতীত অবস্থান
বাংলাদেশ জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ছিল ১৯৭৯, ১৯৮০, ২০০০ ও ২০০১ সালে। সে সময়ে নিরাপত্তা পরিষদে ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে অনুষ্ঠিত ভোটগুলোর দিকে নজর দেওয়া যায়। ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি ও স্থিতিশীলতাবিষয়ক প্রস্তাবের বিষয় ছিল চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যকার সীমান্ত বিরোধ। কম্বোডিয়ার বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে চীন-ভিয়েতনাম যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। ১৯৭৯ সালে একই পরিস্থিতির সূত্র ধরে ভিয়েতনাম কর্তৃক কম্বোডিয়ার ওপর সামরিক অভিযানের নিন্দা করে বাংলাদেশ আরও ছয়টি দেশের সঙ্গে একসঙ্গে প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল ১৫ জানুয়ারি। এ প্রস্তাব সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে গৃহীত হয়নি। পরে ১৩ মার্চ ইন্দোনেশিয়া এবং চারটি দেশ একটি প্রস্তাব আনে। বাংলাদেশ এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়, যা যুদ্ধ বন্ধের জন্য এবং কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামের ভৌগোলিক অখণ্ডতার পক্ষে, সেটিও সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর জন্য গৃহীত হয়নি। সে সময় ভিয়েতনাম সরকার ছিল সোভিয়েত-সমর্থিত এবং কম্বোডিয়ার সরকার চীন-সমর্থিত।
১৯৮০ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ আরও চারটি দেশের সঙ্গে একত্র হয়ে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। প্রস্তাবে আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বরখেলাপ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এ প্রস্তাব সোভিয়েত ভেটোর কারণে গৃহীত হয়নি। ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতার অধিকার প্রসঙ্গে ভোট হয়েছিল ২৬ এপ্রিল, প্রস্তাবক ছিল তিউনিসিয়া। বাংলাদেশের ইতিবাচক ভোট সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর কারণে তা গৃহীত হয়নি। ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর আফগানিস্তানবিষয়ক পাস হওয়া প্রস্তাবের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিল অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষেই। নিরাপত্তা পরিষদে বাংলাদেশের ভোটের বিশ্লেষণ বলে, বাংলাদেশ শক্তিশালী দেশের অবস্থান বিবেচনায় নেয়নি, তার নীতিগত অবস্থান থেকেই ভোট দিয়েছে।
বিশেষ জরুরি অধিবেশনে বাংলাদেশের ভোটের ধারা
বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর। সাধারণ পরিষদের বিশেষ জরুরি অধিবেশনে বাংলাদেশে যোগ দিয়েছে ষষ্ঠ অধিবেশন (১৯৮০) থেকে একাদশ অধিবেশন (২০২২)।
ষষ্ঠ অধিবেশনে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন এসেছে আফগানিস্তান ইস্যুতে ১৪ জানুয়ারি; বাংলাদেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপক্ষে ভারত ভোটদানে বিরত থাকে। সপ্তম অধিবেশনের বিষয় ছিল ফিলিস্তিন প্রশ্ন—১৯৮০ সালের জুলাই থেকে ১৯৮২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত একাধিকবার বৈঠক হয়েছে, তাতে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা, ইসরায়েলি আগ্রাসন, জমি দখল ইত্যাদি বিষয়ে গৃহীত সব প্রস্তাবে বাংলাদেশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র সব সময় এসব প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে।
অষ্টম অধিবেশনের (১৯৮১) বিষয় ছিল নামিবিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্ন। নিরাপত্তা পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে নিন্দা ও নিষেধাজ্ঞা প্রস্তাব পাস করা যায়নি যুক্তরাষ্ট্রসহ তিনটি দেশের ভেটোর কারণে। নামিবিয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকার অবৈধ দখলদারির বিরুদ্ধে এ প্রস্তাবে শুধু নিষেধাজ্ঞা জারির আহ্বান জানানো হয়নি, নামিবিয়ার স্বাধীনতার পক্ষের সংগঠন সাউথ ওয়েস্ট আফ্রিকা পিপলস অর্গানাইজেশনের (সোয়াপো) প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। এ প্রস্তাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনের প্রতি সোয়াপোকে সহায়তা করা, এমনকি সামরিক সহায়তা করার জন্যও আহ্বান করা হয়েছিল। এ দিক মনে রাখা দরকার এ কারণে যে ইউক্রেন প্রশ্নে বাংলাদেশের আপত্তির কারণ হিসেবে বলা হয়েছে এটি কেবল নিন্দা প্রস্তাব ছিল না, ছিল ‘দোষারোপের’। নামিবিয়ার স্বাধীনতার প্রশ্ন নিয়ে এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট পড়েনি, ভোটদানে বিরত ছিল যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৫টি দেশ।
১৯৮২ সালে নবম বিশেষ জরুরি অধিবেশনের বিষয় ছিল ইসরায়েল কর্তৃক সিরিয়ার গোলান মালভূমি দখলের নিন্দা। এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ২১টি দেশ ভোট দিলেও বাংলাদেশ প্রস্তাবের পক্ষেই থেকেছে। দশম বিশেষ জরুরি অধিবেশনের বৈঠক হয়েছে দফায় দফায়—১৯৯৭ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত। পূর্ব জেরুজালেম, গাজা এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকায় ইসরায়েলিদের হামলা ও বসতি স্থাপন বিষয়ে ইসরায়েলের নিন্দা করে নেওয়া প্রস্তাবগুলোতে বাংলাদেশের অবস্থান থেকেছে অটল; বাংলাদেশ ফিলিস্তিনিদের সার্বভৌমত্বের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে।
ষষ্ঠ থেকে দশম পর্যন্ত সাধারণ পরিষদের জরুরি বিশেষ অধিবেশনে বাংলাদেশের দেওয়া ভোটের তিনটি বৈশিষ্ট্য ছিল—প্রথমত এগুলো যেকোনো দেশের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতার পক্ষে; দ্বিতীয়ত এসব ভোট সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সঙ্গে; তৃতীয়ত শক্তিশালী দেশগুলো কী অবস্থান নিচ্ছে কিংবা আঞ্চলিক শক্তিগুলো কী অবস্থা নিচ্ছে, বাংলাদেশ সেগুলো বিবেচনা করেনি। নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য থাকার সময়ও বাংলাদেশের ভোটের প্রথম ও তৃতীয় বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। বাংলাদেশের করা প্রস্তাব ভেটোর কারণে গৃহীত না হওয়া থেকেই বোঝা যায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল নীতিগত। একাদশ অধিবেশনে ইউক্রেন প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের সঙ্গে মেলেনি এবং এত দিনের অনুসৃত নীতিগত অবস্থান থেকে স্পষ্টতাই ভিন্ন।
ভবিষ্যতে কী হবে
ইউক্রেন পরিস্থিতি অচিরেই অবসান হবে না। রাশিয়ার আগ্রাসনের চূড়ান্ত লক্ষ্য স্পষ্ট নয়, তবে এটা সহজেই বোধগম্য যে রাশিয়া ইউক্রেনকে তার নিয়ন্ত্রণে নিতে বদ্ধপরিকর। তাই এটাই স্বাভাবিক যে ইউক্রেনে রাশিয়া একধরনের দখলদারি তৈরি করবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং অন্যান্য দেশ এ অবস্থার অবসানে চাপ অব্যাহত রাখবে। সেই কারণেই বিষয়টি আবারও ভিন্ন ভিন্নভাবে জাতিসংঘে ফিরে আসবে। তখনো বাংলাদেশকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে সে নৈতিক অবস্থান থেকে ভোট দেবে, না তার বিবেচনা ভিন্ন কিছু দিয়ে প্রভাবিত হবে।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট।