ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থীদের শীর্ষ তালিকায় বাংলাদেশ কেন

অভিবাসী ফাইল ছবি

ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের নাম দেখে শুরুতেই ধাক্কা লাগার কথা। বিশেষ করে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্তরণের এ পর্বে সিরিয়া, আফগানিস্তান, ইরাক আর পাকিস্তানের সঙ্গে একই তালিকায় নিজের দেশের নাম থাকায় ভালো অনুভূতি জাগারও কথা নয়।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলেছে, আন্তর্জাতিক কিছু ঘটনাপ্রবাহের কারণে ইউরোপমুখী মানুষের সংখ্যাটা করোনা সংক্রমণের আগের পর্বে ফিরে গেছে। ২০২১ সালে ইউরোপের দেশগুলোয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আশ্রয়প্রার্থী মানুষের সংখ্যা আগের বছরে চেয়ে ৩৩ শতাংশ বেড়েছে।

ইউরোপের দেশগুলোয় আশ্রয়ের আবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে—এমন শীর্ষ পাঁচ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।

ইইউর আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক সংস্থা (ইইউএএ) গত মঙ্গলবার তাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সাধারণত, আগের বছরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন তৈরি হলেও এবারের প্রতিবেদনে এ বছরের শুরুর দিকটা, বিশেষ করে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসনের প্রসঙ্গটাও এসেছে। বিশ্বের যে ছয়টি দেশ থেকে বেশিসংখ্যক মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছেন, সে তালিকার শেষের নামটি বাংলাদেশ।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর অন্তত ৬ লাখ ৪৮ হাজার ব্যক্তি ইউরোপের দেশগুলোয় আবেদন করেছেন। আশ্রয়প্রার্থীর আবেদনের তালিকার শীর্ষে রয়েছে সিরিয়া। সে দেশ থেকে ১ লাখ ১৭ হাজার মানুষ আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। সিরিয়া ছাড়া শীর্ষ ছয় দেশের তালিকায় রয়েছে আফগানিস্তান (১ লাখ ২ হাজার), ইরাক (৩০ হাজার), পাকিস্তান ও তুরস্ক (২৫ হাজার করে) ও বাংলাদেশ (২০ হাজার)।

৩৮৫ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় ইইউএএর নির্বাহী পরিচালক নিনা গ্রেগোরি বলেন, ২০১৫-১৬ সালে সিরিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট শরণার্থী সংকটের পর গত বছর প্রতি মাসে সর্বোচ্চসংখ্যক মানুষ ইউরোপে আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। মূলত, তিনটি কারণে আবেদনপ্রার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে অভিবাসীদের ওপর বেলারুশ সরকারের নিপীড়ন, আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতায় ফেরা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ।
নিনার মতে, আন্তর্জাতিক কয়েকটি ঘটনার প্রেক্ষাপটে বিপুলসংখ্যক মানুষ ২০২১ সালে ইউরোপের দেশগুলোয় আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। এর ফলে আবেদনকারীদের সংখ্যা করোনা সংক্রমণের আগের পর্যায়ে ফিরে গেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত আবেদনকারীর হার মোটামুটি স্থিতিশীল ছিল। সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের দিকে সংখ্যাটি বাড়তে থাকে। বিশেষ করে আফগানিস্তান ও সিরিয়ার মানুষের আবেদনের হার বেড়ে যাওয়ায় এ সংখ্যা হঠাৎ বৃদ্ধি পায়।

প্রতিবেদনে প্রধান তিনটি কারণে ইউরোপে আশ্রয়প্রার্থী বাড়ার সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কোনো যোগসূত্র নেই। মূলত, ভূমধ্যসাগরের পাশাপাশি ইইউ এবং ইইউর সদস্য নয়—এমন বিভিন্ন দেশের স্থলপথ পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে যাত্রার কারণে বাংলাদেশের নাগরিকের সংখ্যা বাড়ছে। কয়েক বছর ধরে লিবিয়া হয়ে ইতালি, স্পেন, গ্রিস ও মাল্টা যাওয়ার হার থামছে না। আবার বসনিয়া, ক্রোয়েশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের এ দেশগুলোর নতুন নতুন রুটে বাংলাদেশিদের বিপজ্জনক যাত্রার বিষয়টি এখন আর গোপন নয়। সরকার অবৈধ অভিবাসনের লাগাম টানতে ব্যর্থ হওয়ায় মানব পাচারকারীরা এখনো লোকজনকে ইউরোপে যেতে প্রলুব্ধ করতে পারছে। মানব পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়া লোকজন শেষ পর্যন্ত নানা পন্থায় ইউরোপ গিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন। চূড়ান্তভাবে ইউরোপে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।

ইইউর আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক প্রতিবেদনটিতে ২০১৬ থেকে ২০২০ সালে বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছরই আবেদনকারীর সংখ্যা ছিল ১০ হাজারের বেশি। ২০১৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চার বছরে আবেদনের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ১৫ হাজার, ১৮ হাজার ৮৬৫, ১৩ হাজার ৭৪০, ১৫ হাজার ৮৪৫ এবং ১১ হাজার ৫৭০ জন। আর ২০২১ সালে ২০ হাজার ১১০ আবেদন পড়েছে।

২০২১ সালে ইউরোপে সঙ্গীহীন কিশোর-কিশোরী আবেদনকারী শীর্ষ তিন দেশের তালিকায়ও বাংলাদেশের নাম আছে। গত বছর আফগানিস্তান, সিরিয়া ও বাংলাদেশ থেকে আবেদনকারীর সংখ্যা যথাক্রমে ১২ হাজার ৫৭৫, ৩ হাজার ৮৬০ ও ১ হাজার ৩৪০ জন।

সিরিয়া, পাকিস্তান, কলম্বিয়া, নাইজেরিয়া ও বাংলাদেশের সংখ্যা যথাক্রমে ২৩ হাজার ৯৮৫, ২০ হাজার ৮৭৫, ২০ হাজার ৪৫০, ১৬ হাজার ৯১০ ও ১৫ হাজার ৯৩৫ জন।

ইউরোপে কর্মরত বেশ কয়েকজন কূটনীতিক ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ বলছেন, বসনিয়ার জঙ্গলসংলগ্ন শিবির ও সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোশিয়ার আশ্রয়শিবিরে এ মুহূর্তে অবস্থানরত বাংলাদেশের লোকজনের নাম হয়তো পরের বছরের প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যান্বেষণে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করে একেকজন বেশ কয়েক দেশ ঘুরে ইউরোপের কোনো দেশ কিংবা লিবিয়া, তিউনিসিয়া, তুরস্ক পৌঁছেছেন। যেভাবেই হোক তাঁরা ইউরোপে ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবেন, এটাই হয়তো তাঁদের জন্য স্বাভাবিক।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও অভিবাসন বিশেষজ্ঞ মো. শহীদুল হকের মতে, বিদেশ যেতে মরিয়া একশ্রেণির মানুষের স্বপ্নকে পুঁজি করে মানব পাচারকারীরা নির্বিঘ্নে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ কারণে মানব পাচারের শিকার হওয়া লোকজন ইউরোপের দেশগুলোয় আশ্রয় নিচ্ছেন। কাজেই বিপুল সংখ্যায় বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থী মূলত অবৈধ অভিবাসনের শিকার। এসব মানুষ রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ইউরোপে যাননি।

শহীদুল হক বলেন, এ সমস্যা নতুন নয়, অনেক দিন ধরে চলছে। এমনকি লিবিয়ায় লোক পাঠানো বন্ধ করতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনাও ছিল। এরপরও মানব পাচার বন্ধ হয়নি। বিয়োগান্ত কোনো ঘটনা সামনে এলে সবাই নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন পর সবাই হাল ছেড়ে দেয়। এর ফলে হয় কী, মানব পাচারের শিকার যেসব লোককে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়, তাঁদের কেউ কেউ পরে মানব পাচারকারীর তালিকায় যুক্ত হন। এমন এক পরিস্থিতিতে এ সংকটের সমাধান রীতিমতো দুরূহ।

প্রসঙ্গত, ইইউভুক্ত দেশগুলোয় আশ্রয়প্রার্থী লোকজনের সহযোগিতার লক্ষ্যে ২০১০ সালে গঠন করা হয়েছিল ইউরোপীয় আশ্রয় সমর্থন দপ্তর বা ইএএসও। ২০১১ সাল থেকে বিশেষায়িত ওই দপ্তর আশ্রয়প্রার্থীদের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দপ্তরের নাম পরিবর্তন করে ইইউএএ করা হয়। গত চার বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনের সঙ্গে ইইউর আশ্রয়প্রার্থীবিষয়ক এবারের প্রতিবেদনটি অনেক বেশি ইউরোপকেন্দ্রিক। অর্থাৎ অন্য বছরগুলোয় ইউরোপসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানের পরিস্থিতির চিত্র বা পর্যালোচনা থাকলেও এবারের প্রতিবেদনে মূলত ইউরোপের পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করা হয়েছে।