ইতালির ছবিতে বাংলার নায়ক

প্রথমবার ইতালি গিয়ে ব্যর্থ মনোরথে ফিরে এসেছিলেন পায়েল। সেটা ১৯৯৯ সাল। মাত্র তিন মাস ছিলেন সেবার। বিদেশ-বিভুঁইয়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার মতো কর্মসংস্থান করে উঠতে পারেননি তিনি। মূল সমস্যা ভাষা। ইতালীয় ভাষাটা কিছুতেই রপ্ত হচ্ছিল না। সেই ব্যর্থতা ছাইচাপা আগুনের মতো বুকের ভেতর ছিলই। দ্বিতীয়বার তাই আর পেছন ফিরে তাকাননি। ইতালীয় ভাষা তো রপ্ত করলেনই, উপরন্তু সেই ভাষায় চলচ্চিত্র ও নাটকে অভিনয় করে ভেতরের আগুনটা দেখালেন সবাইকে।আজ পায়েল ঠাকুর ইতালির মঞ্চ ও টিভি নাটক এবং চলচ্চিত্র অঙ্গনে পরিচিত মুখ। গত বছর আইরিশ বাসছি পরিচালিত লেটারা ডা মাদ্রাজ (মাদ্রাজের চিঠি) ছবিতে নায়ক হিসেবেই অভিনয় করেছেন তিনি। দর্শক-সমালোচকদের প্রশংসাও পেয়েছেন। ছবিটি প্রদর্শিত হয়েছে কান চলচ্চিত্র উৎসব, রোম ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ও ইরাকের কুহক চলচ্চিত্র উৎসবের মতো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের বড় আসরগুলোতে।

পুরো নাম আল এমরান। পারিবারিক পদবি ঠাকুর। সোলেমান ঠাকুরের ছেলেটি ডাকনামের সঙ্গে পারিবারিক পদবি মিলিয়ে নাম নিলেন পায়েল ঠাকুর। এই নামেই এখন তাঁর পরিচিতি। বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে সরাইল অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে স্কুলজীবন শেষ করে এসে ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা আইডিয়াল কলেজে। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে প্রথমবার পাড়ি জমিয়েছিলেন ইতালি। ফিরে আসার কথা তো আগেই বলেছি। ফিরে এসে ভর্তি হন তেজগাঁও কলেজে। সেখানে ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে আবার ইতালি যান।

দ্বিতীয়বার ইতালি গিয়ে প্রথমেই একটি ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হন। মোটামুটি কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো ভাষা শিখে চাকরি নেন একটি বারে। এর ঠিক উল্টো দিকেই ছিল একটি থিয়েটার স্কুল। এই স্কুলের ছাত্র-শিক্ষকেরা মহড়া শেষে আড্ডা দিতে আসতেন বারে। অধিকাংশই তরুণ। পায়েলের সঙ্গে তাঁদের ভাব জমে উঠল অল্প দিনেই। ওদের সঙ্গেই কখনো-সখনো মঞ্চনাটক দেখতে যেতেন। নাটক দেখে ফিরে আসার পরও সেই ঘোর থেকে মুক্তি মিলত না। সারা দিনের খাটাখাটুনির পর রাতে বিছানায় গেলে কখনো স্বপ্নের ভেতর নিজেকেও যেন সেই মঞ্চে দেখতে পেতেন। কিন্তু দিনের বেলা প্রচণ্ড কাজের মধ্যে চাপা পড়ে যেত সেই স্বপ্ন।

এ রকম টানাপোড়েনের দিনগুলোতে বন্ধুরা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করল তাঁদের সঙ্গে থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হতে। সাতপাঁচ না ভেবে ভর্তি হয়ে গেলেন পায়েল। বছর খানেক চলল থিয়েটার স্কুলে পাঠ নেওয়া ও কর্মশালায় অংশগ্রহণ। পিয়ের পাওলো সেপে, হোসাইন তাহেরির মতো নাট্যকার-নির্দেশকদের কাছে হাতে-কলমে পাঠ নেওয়ার অভিজ্ঞতা অনেক দূর এগিয়ে দিল তাঁকে।

প্রথম সুযোগ পেলেন ২০০২ সালে ফ্রান্সেসকা গার্সেয়া নির্দেশিত একটি নাটকে, যার নাম বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায় আমরা কেউ কাউকে চিনি না। প্রথম নাটকের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে পায়েল বললেন, ‘দিনের বেলা বারের কাজ শেষ করে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর আট ঘণ্টা মহড়া চলত। অমানুষিক কষ্ট। কিন্তু সেই কষ্টের কথা ভুলে গেছি প্রথম মঞ্চায়নের দিন দর্শকদের প্রতিক্রিয়া দেখে। সেই দিনটি আমি জীবনে ভুলব না।’ এরপর একে একে বেশ কিছু মঞ্চনাটকে অভিনয় করেছেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য মিরর অব বাটারফ্লাই, রোমানি প্রভৃতি।

মঞ্চে কিছুটা খ্যাতি পাওয়ার পর ডাক এল টেলিভিশন নাটকে। পায়েলের অভিনীত টিভি নাটকগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো দ্য টিম, এ ডক্টর ইন এ ফ্যামিলি, দ্য ক্যারাবিনিয়েরি, অল ক্রেজি ফর লাভ, পুলিশ স্টেশন প্রভৃতি। এর মধ্যে ক্যারাবিনিয়েরি নাটকে পায়েল সহ-অভিনেতা হিসেবে পেয়েছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতিমান চলচ্চিত্রাভিনেতা কবির বেদীকে।

টিভি থেকে চলচ্চিত্রে পা রাখতে সময় লাগেনি বেশি। কারণ ইতিমধ্যেই পায়েলের অভিনয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলো হচ্ছে রিটুরনেল্লা, আকুয়াডোট্রো সিলভিও, দ্য ইমিগ্র্যান্ট প্রভৃতি। বহুল প্রশংসিত ছবি লেটারা ডা মাদ্রাজ-এ পায়েলের অভিনয়ের খ্যাতি তাঁর পেশাকে দাঁড় করিয়েছে শক্ত মাটির ওপর।

‘সরাইল অন্নদা স্কুলের সেই ছেলেটি আজ ইতালির চলচ্চিত্র তারকা, ভাবতে কেমন লাগে আপনার?’—জানতে চেয়েছিলাম। পায়েল বললেন, ‘নিজেকে সেলিব্রিটি ভাবি না আমি। প্রতিদিন ঘুমোতে যাওয়ার আগে ভাবি, আমাকে যেতে হবে আরও অনেকদূর।’

l আমিই বাংলাদেশ নিয়ে পরামর্শ ও তথ্য যোগাযোগ: [email protected]