ইতিহাসবোধ বনাম উন্নয়ন ভাবনা

নতুন করে গড়ার জন্য ভেঙে ফেলা হতে পারে ষাটের দশকে নির্মিত টিএসসির দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটি। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।ছবি: আশরাফুল আলম

পৃথিবীর ইতিহাসে ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত বছরগুলো রাজনৈতিক অস্থিরতা ও পরিবর্তনের জন্য বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কেবল এশিয়া নয়, এ সময়ে বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ ইউরোপীয় উপনিবেশ শাসন থেকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগের মাধ্যমে নতুন ভৌগোলিক সীমানায় রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নতুন প্রসঙ্গের উত্থান ঘটে।

দুই দেশেই নতুন প্রসঙ্গ ও নতুন পরিচয়ের স্বার্থে, সাংস্কৃতিক বিকাশ পুনরুদ্ধারের জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। সাংস্কৃতিক বিকাশের মাধ্যম ও নিদর্শন হিসেবে স্থাপত্যচর্চা বরাবরই শীর্ষে অবস্থান করে। যেকোনো ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকে স্থাপনাগুলো। বলতে থাকে অব্যক্ত ইতিহাস।

তেমনই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা ও বিকাশের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে কিছু নতুন স্থাপনা গড়ার প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়, যা সমসাময়িক সময়ের আগে খুব একটা চোখে পড়েনি।

স্থানীয় স্থপতিদের সংখ্যা সীমিত থাকার কারণে, স্থানীয় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর নকশা, পরিকল্পনা ও প্রকল্প পরিচালনার জন্য বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তানে বেশ কয়েকজন বিদেশি স্থপতিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। স্থপতি লুই আই কান, পল রুডলফ, কনস্তানতিনোস দক্সিয়াদিস, রিচার্ড নিউট্রা, ড্যানিয়েল ডানহাম, রবার্ট জি বুই, স্ট্যানলি টাইগারম্যান এই স্থপতিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। তাঁরা উপনিবেশ শাসন থেকে সদ্য স্বাধীনতা পাওয়া একটি দেশের স্থাপত্যের অবয়ব গঠনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের নির্দিষ্টতা নির্ণয়ের প্রাক্কালে স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের পাশাপাশি এই বিদেশি স্থপতিরা তাঁদের প্রকৃত জ্ঞান, পেশাদারত্ব ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে স্থানীয় স্থাপত্যের সংজ্ঞা চিহ্নিতকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

দক্সিয়াদিসের নকশায় টিএসসি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র (টিএসসি) পূর্ব পাকিস্তানের শুরুর দিককার স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম, যা পূর্ব পাকিস্তানের স্থাপত্যের সংজ্ঞা চিহ্নিত করতে সাহায্য করেছে। গ্রিক স্থপতি কনস্তানতিনোস দক্সিয়াদিসের নকশায়, ফোর্ড ফাউন্ডেশনের আর্থিক সহায়তায় এর নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬২ সালে।

টিএসসি কমপ্লেক্সের একপাশে রয়েছে সুবিশাল মিলনায়তন, যার রেইনফোরসড কনক্রিট প্যারাবোলিক ছাদের নির্মাণ ও নকশা তখনকার সময় বিবেচনায় বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল।

সারিবদ্ধ কক্ষ, বদ্ধ করিডর আর সাদামাটা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে নকশা করতে গিয়ে স্থপতি দক্সিয়াদিস অনুপ্রাণিত হন বাংলার গ্রামীণ বসতি থেকে। গ্রামের বাড়ির মাঝখানে থাকে উঠান বা আঙিনা, যা বাড়ির সব কর্মকাণ্ডের প্রাণকেন্দ্র বলে বিবেচিত হয়। টিএসসির প্রাণকেন্দ্রে আছে এমনই এক প্রশস্ত মাঠ, যা পুরো কমপ্লেক্সের প্রাণের জায়গা। এটি ছাত্র-শিক্ষকের কথোপকথন ও মিথস্ক্রিয়ার উপযুক্ত পরিসর।

টিএসসি কমপ্লেক্সের একপাশে রয়েছে সুবিশাল মিলনায়তন, যার রেইনফোরসড কনক্রিট প্যারাবোলিক ছাদের নির্মাণ ও নকশা তখনকার সময় বিবেচনায় বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। এখানকার প্রতিটি পরিসরে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর বায়ু চলাচলের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়েছে। যেখানে খোলা রাখা সম্ভব হয়নি, কিছুটা আড়াল-নীরবতা দরকার কিংবা সূর্যের আলোকে আটকানো প্রয়োজন, সেখানে স্থপতি দক্সিয়াদিস জালি ব্যবহার করেছেন।

টিএসসি ভবনে বৃষ্টির পানি কীভাবে সরবে, সেটি নকশা–পরবর্তী চিন্তা হিসেবে দেখেননি স্থপতি। বরং এ দেশের ভৌগোলিক ও আবহাওয়াগত অবস্থান বিবেচনায় রেখে ভবনের ছাদ ইনভার্টেড রুফ অথবা বাটারফ্লাই রুফ হিসেবে ভবনের সঙ্গে একীভূত করে নকশা করেছেন। গ্রীষ্মপ্রধান দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিবেচনায় রেখে আধুনিক স্থাপত্য গড়ার ক্ষেত্রে টিএসসি এক অনন্য নিদর্শন। স্থাপত্যের ভাষায় একে বলে ট্রপিক্যাল মডার্নিজম বা ক্রান্তীয় আধুনিকতা।

লুই বার্জার গ্রুপের কমলাপুর রেলস্টেশন

১৯৬০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্রমবর্ধমান শীতল যুদ্ধ আর ঔপনিবেশিক শাসন–পরবর্তী সংগ্রামময় সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে প্রবলভাবে অনুভূত হয়। এদিকে ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে বিভিন্ন দেশে প্রকৌশলগত সহায়তা দেওয়ার উদ্যোগ নেয় যুক্তরাষ্ট্রের লুই বার্জার গ্রুপ। এটি হচ্ছে একটি পেশাদার পরিষেবা করপোরেশন। পূর্ব পাকিস্তানের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য ১৯৬১ সালে ঢাকায় তাদের কার্যালয় স্থাপিত হয়।

মেট্রোরেলের অবকাঠামোর জন্য ভাঙা হতে পারে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের নান্দনিক কাঠামো। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে।
ছবি: হাসান রাজা

লুই বার্জার অ্যান্ড কনসালটিং ইঞ্জিনিয়ার্স (পাক) লিমিটেড নামের এই কনসালটিং ফার্মের প্রধান স্থপতি হিসেবে নিযুক্ত হন হার্ভার্ড স্নাতক ড্যানিয়েল ডানহাম। এই ফার্ম ছিল প্রথম বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, যেটি সরকারি কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব পায়, যা সেই সময়ের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিরল ঘটনা।

তাদের প্রথম কাজগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন। বেশি যাত্রী পরিবহনের সুবিধার্থে ও যানজট নিরসনের উদ্দেশ্যে ফুলবাড়িয়া থেকে রেলওয়ে স্টেশনটি কমলাপুরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। এই স্টেশনের মূল চাহিদা ছিল একই ছাদের তলায় বৃহদাকার ও নিরবচ্ছিন্ন পরিসর তৈরি করা। তখন এত বড় ছাদের নকশা-চিন্তা ও নির্মাণ ছিল স্বপ্নতুল্য।

রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের বিশেষ কিছু চাহিদাও ছিল। যেমন ভবনটির নকশায় ও অবয়বে ইসলামিক আইডেনটিটি (পরিচয়) থাকতে হবে। স্থপতি ডানহাম বেশ কিছু প্রাথমিক পরিকল্পনা করলেন এবং কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ করে কাজ এগিয়ে নিলেন। তবে কিছুদিনের মধ্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রথম স্থাপত্য অনুষদের শিক্ষক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বর্তমান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) যোগ দেন। পরে প্রধান স্থপতি হিসেবে স্টেশনের নকশার কাজের হাল ধরেন একই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত স্থপতি রবার্ট জি বুই, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্র্যাট ইনস্টিটিউট থেকে স্থাপত্যে স্নাতক। তিনি প্রাথমিক নকশার ডোম আমব্রেলা স্কিম বা গম্বুজ ছাতা পরিকল্পনা থেকে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি এই দ্বিমাত্রিক নকশা থেকে আধুনিক ও সুবিশাল ত্রিমাত্রিক প্যারাসল ক্যানোপি কিংবা ছাতাসদৃশ ছাদ নকশা করেন।

এই ছাদ নির্মাণ মোটেই সহজ ছিল না। কাঠামোর পরিপূর্ণতা ও সম্ভাব্য ত্রুটিগুলো নির্ণয় ও যাচাই করতে স্থপতি রবার্ট জি বুই প্রথমে পুরো নকশার আদলে ছোট আকারে সাব-আরবান স্টেশনের ছাদ তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। এই পাইলট প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অনেক অজানা তথ্যের স্পষ্টতা দেয়। পরবর্তী সময়ে স্থপতি বুইর তত্ত্বাবধানে এবং স্থানীয় প্রযুক্তি ও শ্রমিকদের কাজের সমন্বয়ে পুরো প্রকল্পটি বাস্তব রূপ ধারণ করে।

টার্মিনাল ভবনের পুরো স্থাপত্যটি দুটি সিস্টেমে (ব্যবস্থা) গঠিত—ওপরে সরু খোলসের কংক্রিট প্যারাবোলিক ছাদ কাঠামো এবং এর নিচে সমতল ছাদসমৃদ্ধ কাঠামো। টিকিট বুকিং কাউন্টার, ওয়েটিং লাউঞ্জ, যাত্রী লাউঞ্জ, টয়লেট (শৌচাগার), ফুড কর্নারগুলো (খাবার দোকান) সমতল ছাদসমৃদ্ধ কাঠামোয় একত্র হয়ে ছাতাময় ছাদের নিচে আলাদা ও অনাড়ম্বরভাবে অবস্থিত।

টার্মিনালের বর্গাকার পরিকল্পনায় প্রতিটির পাশে ছয়টি করে বর্গক্ষেত্র রয়েছে। অভ্যন্তরীণ পরিসরে পর্যাপ্ত আলো–বাতাসের কমতি নেই কোথাও। এই পরিসরের তুলনা হতে পারে বাংলার চিরায়ত বটবৃক্ষের ছায়াঘেরা পরিসরের সঙ্গে, কিংবা কোনো মোগল প্যাভিলিয়নের সঙ্গে, যাতে একই ছাদের তলায় থাকে মানুষ ও পর্যাপ্ত আলো-হাওয়ার মেলবন্ধন। পরিপাটি পরিকল্পনা, প্রশস্ত প্লিন্থ আর ব্যবহারভেদে পরিসর-সীমানা খুব সুস্পষ্টভাবে চোখে পড়ে।

দূর থেকে টার্মিনালটি অন্য রকম অবয়বের কারণে খুব সহজেই চেনা যায়। স্টেশনটি যে কেবল যাত্রীছায়া ও রেল যোগাযোগে সহায়তা করেছে তা নয়, দিনের পর দিন বহু যাযাবর ও বাস্তুহারা স্বল্প আয়ের মানুষকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়েছে। দিয়েছে ঘরের বাইরে একটুখানি ছায়াময় আস্তানা।

কেন ইতিহাসকে বাদ দিয়ে উন্নয়ন?

স্থাপত্য বরাবরই ইতিহাসকে তুলে ধরে। পাতার পর পাতা লিখেও যা সহজে বোঝানো যায় না, তা এই ইট-পাথরের এক নিদর্শন দিয়ে খুব সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়। বাংলাদেশের পরিচয় বহন করে যে স্থাপত্যগুলো, তার মধ্যে প্রথম কাতারেই চলে আসবে টিএসসি ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন—এই স্থাপত্য দুটির নাম।

সম্প্রতি টিএসসি ও কমলাপুর রেলস্টেশন ভেঙে উন্নয়ন করার প্রসঙ্গ উঠেছে। উন্নয়ন করতে গিয়ে নিজস্ব পরিচয়, ইতিহাসকে বাদ দিতে হবে কেন? পরিচয়হীন যেমন কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই, ঠিক তেমনি ইতিহাসসমৃদ্ধ এই স্থাপত্যগুলো ছাড়া দেশের সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতিহাস ও ইতিহাসসমৃদ্ধ স্থাপত্যের কদর অনেক। আর পুরোনো স্থাপত্য বাঁচিয়ে রেখেই উন্নয়ন করা হয়েছে, এমন বহু নজির আছে। তাহলে আমরা কেন পারব না ইতিহাস অটুট রেখে উন্নয়ন করতে? দেশের ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধিকে অক্ষুণ্ণ রাখতে? ভেবে দেখার সময় এখনই!

লেখক: স্থপতি ও সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়