ইয়ামিনের ভারত যাত্রা ও ফিরে আসা

শিশু ইয়ামিনকে গতকাল তার মা শামসুন্নাহারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছবিটি চট্টগ্রাম নগর ভবন থেকে তোলা  l প্রথম আলো
শিশু ইয়ামিনকে গতকাল তার মা শামসুন্নাহারের হাতে তুলে দেওয়া হয়। ছবিটি চট্টগ্রাম নগর ভবন থেকে তোলা l প্রথম আলো

শিশুটির নাম মো. ইয়ামিন। বয়স ১২। জন্মের আড়াই মাসের মধ্যে বাবাকে হারায় সে। মা শামসুন্নাহার পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। চোখের সমস্যার কারণে তিন বছর আগে চাকরি ছেড়ে দেন তিনি। এক বছর আগে সংসারের খরচ জোগাতে ঘর ছাড়তে হয় শিশুটিকেও। ঢাকার বিমানবন্দর স্টেশন এলাকায় খেলনা বিক্রির কাজ নেয় সে। সময়-সুযোগ পেলে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বায়েজিদের বার্মা কলোনিতে মা-বোনদের দেখতে আসত সে। মাঝেমধ্যে তাদের জন্য টাকাও পাঠাত। ইয়ামিনের জীবন এভাবেই কাটছিল।
চার মাস আগে ‘ঘটনাচক্রে’ ইয়ামিন বেনাপোল সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। ভারত যাত্রা ও সেখান থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসার সেই কাহিনি শোনা যাক তার মুখেই। দিনটি ছিল কোনো এক শুক্রবার। বিমানবন্দর থেকে টঙ্গীতে যাওয়ার জন্য খুলনাগামী একটি ট্রেনে চেপে বসে ইয়ামিন। কিন্তু ট্রেনটি টঙ্গীতে না থেমে চলে যায় খুলনায়। স্টেশনে নামার পর কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে সেখান থেকে ঢাকায় ফেরার ট্রেন মনে করে আবারও ভুল ট্রেনে উঠে পড়ে সে। এবার গিয়ে পৌঁছায় যশোরের বেনাপোলে।
ইয়ামিন বলে, স্টেশনে নেমে একটি টমটমে চেপে আরও কয়েকজনের সঙ্গে সে পৌঁছে যায় বেনাপোল সীমান্তে। এরপর অন্যদের সঙ্গে কোনো বাধা ছাড়াই সীমান্ত পার হয়। বেশ খানিকটা হাঁটার পর আরেকটি ট্রেন পেয়ে যায়। সে ট্রেনটি গিয়ে থামে কলকাতায়। সেখানে নেমে বাংলার পাশাপাশি হিন্দি ভাষা শুনে কিছুটা ঘাবড়ে যায় সে। লোকজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারে ভারতে পৌঁছে গেছে সে। প্রথমে কিছুটা ভয় পেলেও পরে ভাবে, ভারতে যখন পৌঁছেই গেছে তাহলে দিল্লিটাও ঘুরে দেখা যাক। পকেটে খেলনা বিক্রির টাকা ছিল আর টেলিভিশনের কল্যাণে দিল্লি নামটাও তার পরিচিত ছিল। দিল্লিতে যাওয়ার আগে কলকাতা থেকে অন্যদের সহায়তায় টাকা ভাঙিয়ে ভারতীয় রুপি করে নেয় সে। তারপর সেই টাকাকে সম্বল করে ট্রেনে বাদাম বিক্রি করতে করতে দিল্লিতে পৌঁছে যায় ইয়ামিন।
দিল্লিতে যেদিন পৌঁছায় সেদিন রাতেই হজরত নিজামউদ্দিন রেলস্টেশনে ইয়ামিনকে খুঁজে পায় বাটারফ্লাই নামের একটি সংগঠন। তার কাছে সব শুনে সংগঠনটি তার বড় বোনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করে। ইয়ামিনকে নেওয়া হয় ওই সংগঠনের আশ্রয়কেন্দ্রে। এরপর সংগঠনটি যোগাযোগ করে বাংলাদেশের সংগঠন ‘অপরাজেয় বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে। কাজের সূত্রে অপরাজেয় বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ রয়েছে। অপরাজেয় বাংলাদেশের সহযোগিতায় ৩ জানুয়ারি ঢাকায় পৌঁছায় ইয়ামিন। চট্টগ্রামে আসে বুধবার রাতে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মাধ্যমে মায়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় ইয়ামিনকে।
সিটি করপোরেশনের কে বি আবদুচ ছত্তার মিলনায়তনে গতকাল ইয়ামিনের মা শামসুন্নাহার ছেলেকে ফিরে পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইয়ামিনের মা প্রথম আলোকে বলেন, ছয় বছর আগেও একবার ইয়ামিন হারিয়ে গিয়েছিল। তখন ঢাকায় একটি পরিবার তাকে নিজেদের কাছে রাখে। সেখানে সে কাজ করত। একদিন কাজে ভুল হওয়ায় ইয়ামিনকে মারে তারা। তাতে ইয়ামিনের একটি চোখ নষ্ট হয়ে যায়।
অপরাজেয় বাংলাদেশ চট্টগ্রামের প্রকল্প সমন্বয়কারী মাহবুবুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইয়ামিনের নষ্ট হয়ে যাওয়া চোখে আলো ফিরিয়ে দেওয়া যায় কি না তা আমরা দেখব। এ ছাড়া আগামী ১৮ মাস শিশুটির সুরক্ষার জন্য যা যা করণীয়, সেটি করা হবে।’
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ইয়ামিনের পড়াশোনার দায়িত্ব নেওয়ার ঘোষণা দেন মেয়র। একই সঙ্গে তিনি ইয়ামিনের আরও যত্ন নিতে মায়ের প্রতি আহ্বান জানান।
এখন কী করতে চাও এ প্রশ্ন করা হলে লাজুক হেসে ইয়ামিন প্রথম আলোকে বলে, ‘পড়াশোনা শুরু করতে চাই। বড় হয়ে “সায়েন্টিস” (বিজ্ঞানী) হব। আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরব না।’
ইয়ামিনকে মায়ের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর তারেক সোলেমান, প্রধান প্রকৌশলী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ, জেলা শিশুবিষয়ক সংগঠক নারগিস সুলতানা, সমাজসেবা কর্মকর্তা ওয়াহিদুল ইসলাম, বেসরকারি সংগঠন ব্রাইট বাংলাদেশ ফোরামের নির্বাহী পরিচালক উৎপল বড়ুয়া, অপরাজেয় বাংলাদেশের শিশু উন্নয়ন ব্যবস্থাপক ঝুমরি বড়ুয়া, আইনজীবী তুতুল বাহার প্রমুখ।