ই-কমার্স প্রতারণায় গ্রেপ্তার মালিক-কর্মকর্তা, কার দায় কতটা

ই–কমার্স
প্রতীকী ছবি

ই-কমার্সের নামে প্রতারণায় এখন পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪০ জন। গ্রেপ্তার আসামিদের ৩২ জনই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মী। মালিকদের কেউ কেউ বিদেশে বসে কর্মীদের ওপর দায় চাপাচ্ছেন। কর্মীদের পক্ষ নিয়ে পাল্টা বক্তব্যও আসছে।
এই প্রেক্ষাপটে পুলিশ বলছে, ঢালাওভাবে আসলে কোনো পক্ষকেই দোষী বা নির্দোষ বলার সুযোগ নেই। তদন্তে যুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের কয়েকজন অনানুষ্ঠানিক আলোনায় বলেছেন, কোথাও মালিকপক্ষ দোষী, কোথাও বেতনভুক কর্মকর্তারা মালিকপক্ষকে প্রভাবিত করেছেন। আবার কোথাও মিলেমিশে লুটপাটের চেষ্টা করেছেন। কার দায় কতটুকু, নিশ্চিত হতে আরও সময় লাগবে। তাঁরা বেশ কিছু মামলার দৃষ্টান্তও দিয়েছেন।

এখন পর্যন্ত ১২টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালায়। এদের প্রতিটির বিরুদ্ধেই ‘অস্বাভাবিক’ ছাড়ে পণ্য বিক্রির প্রতিশ্রুতির অভিযোগ বা বিনিয়োগ করা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

এর মধ্যে ই–কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির বিরুদ্ধে তিনটি, রিং আইডির বিরুদ্ধে দুটি, ই-অরেঞ্জের বিরুদ্ধে নয়টি, ধামাকার বিরুদ্ধে তিনটি, ২৪ টিকিটের বিরুদ্ধে পাঁচটি, সহজ লাইফের বিরুদ্ধে দুটি, এসপিসি ওয়ার্ল্ড লিমিটেডের বিরুদ্ধে চারটি, সিরাজগঞ্জ শপের বিরুদ্ধে একটি, কিউকমের বিরুদ্ধে তিনটি, নিরাপদ শপের বিরুদ্ধে একটি, র‌্যাপিড ক্যাশের বিরুদ্ধে একটি, থলে ও ইউকম ডটকমের বিরুদ্ধে একটি করে মামলা রয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে মালিকদের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাসেল; তাঁর স্ত্রী ও প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন; ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন; এসপিসি ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. আল আমীন; তাঁর স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শারমীন আক্তার; কিউকমের সিইও রিপন মিয়া এবং রিং আইডির পরিচালক সাইফুল ইসলাম।

২৪ টিকিটের পরিচালক মিজানুর রহমান সোহেলকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া সীমা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামীই ভুক্তভোগী। তিনি জালিয়াতির বিষয়টি টের পেয়ে আইনি নোটিশ দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান ও অন্য পরিচালকদের বিরুদ্ধে। হিসাব চাইলে তাঁকে ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছিল।

সুমাইয়া আরও বলেন, গত মে মাসে এ নিয়ে তিনি কাফরুল থানায় মামলাও করেছিলেন। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনে (পিবিআই) মামলাটির তদন্ত চলার সময়ই মিজানুর গ্রেপ্তার হন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ পর্যন্ত হওয়া ৩৫টি মামলার ২৪টির তদন্ত করছে।

সিআইডির সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, যাচাই-বাছাইয়ের পরই অভিযুক্ত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্তে যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে, কেবল তাঁর বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ই-কমার্সবিরোধী নয়; বরং এর বিকাশের পক্ষে।

মালিক, কর্মকর্তারা কে কী বলছেন

টঙ্গী পশ্চিম থানায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর শামীম খান নামের এক ব্যক্তি ধামাকাশপিং ডটকমের চেয়ারম্যান, পরিচালকসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
মামলায় বাদী লিখেছেন, তিনি ১১ লাখ ৫৫ হাজার টাকার পণ্য চেয়েছিলেন। ৪৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ করা হবে, ধামাকা এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। পণ্য না পাওয়ায় টাকা ফেরতের চেক দেওয়া হয়। কিন্তু অ্যাকাউন্টে কোনো টাকা ছিল না। পরে তিনি ধামাকাশপিংয়ের অফিসে গিয়ে দেখেন সেটি বন্ধ।

ওই মামলায় প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) সিরাজুল ইসলাম, সিস্টেম ক্যাটাগরি হেড ইমতিয়াজ হাসান, ভাইস প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম স্বপনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। এরপর আমেরিকা থেকে ফেসবুক লাইভ করেন প্রতিষ্ঠানটিন ব্যবস্থাপনা পরিচালক জসিমউদ্দিন চিশতী।

জসিমউদ্দিন চিশতী বলেন, ‘তথাকথিত সিওও সিরাজুল ইসলাম র‌্যাবের হাতে আটক হয়েছেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে র‌্যাবের পক্ষ থেকে অনেক কিছু বলা হয়েছে। ব্রিফিংয়ে যেটা বলা হয়েছে, আমরা টাকা আত্মসাৎ করেছি। এ শব্দটির সঙ্গে আমি একমত নই। টাকা সরাইনি। দেনাপাওনা সবচেয়ে কম। আমাদের সম্পত্তি আছে। অন্যান্য ব্যবসা আছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’ এরপর কীভাবে সিরাজুল প্রতারণা করেছেন, এর বিশদ বর্ণনা দেন প্রতিষ্ঠানটির মালিক।

জসিমউদ্দীন চিশতী বলেন, সিরাজুল যে টাকা নয়ছয় করছেন, সেটা তিনি জানতেন। তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে চেয়েছেন। সিরাজুলকে প্রথম দফায় ১০ কোটি টাকা দিয়েছেন। এরপর তিনি জানতে পেরেছেন, ৩৫-৩৮ কোটি টাকা সিরাজুল ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা সরিয়েছেন। একপর্যায়ে তিনি সিরাজুলকে প্রতিষ্ঠানটির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে দেন। এভাবে তিনি ধরা খেয়েছন। তাঁর ব্যাংক হিসাব জব্দ করে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। খুলে দিলেই ধীরে ধীরে সব শোধ করবেন।

জসিমউদ্দীন চিশতীর এই লাইভের নিচে কেউ কেউ ইতিবাচক মন্তব্য করেছেন, অনেকেই করেছেন নেতিবাচক মন্তব্য।

রিয়াদ হোসেন নামের একজন লিখেছেন, ‘স্যারের কথা সবই ঠিক আছে, কিন্তু একটা কথা বুঝলাম না, যেই লোকটা এত কিছু করল, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ১০ কোটি টাকা দিলেন। তারপর ভুল করার পর আবার তাকে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে দিলেন। এটা তো ওনার ভুল ছিল। এখন যখন সিরাজুল ধরা পড়েছে, তখন উনি কথাগুলো বলছেন।’

কিউকমের বিপণন ও জনসংযোগ কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির ওরফে আরজে নীরব গ্রেপ্তারের পর কর্মচারীরা কেন সাজা পাবেন, সে প্রশ্ন ওঠে। সুজন মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি ফেসবুকে লেখেন, ‘আমরা সবাই “নীরব” কেন? প্রাতিষ্ঠানিক অপকর্মের কারণে কর্মচারীরা কোন যুক্তিতে শাস্তি পাবেন? কিছুদিন আগে হাসেম ফুডস ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। মালিকদের সঙ্গে জেলে যেতে হয়েছিল কোম্পানির সদ্য নিয়োগ পাওয়া প্রধান নিবার্হী শাহানশাহ আজাদ। অথচ ওনার আগে জামিন লাভ করে প্রতিষ্ঠানটির মালিকপক্ষ।’

সুজন আরও লেখেন, ‘...ই-কমার্সের পণ্য যথাযথভাবে সরবরাহ না করার অপরাধে কিছুদিন আগে কিউকম নামের প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিপন মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। যদি আইনের চোখে রিপন মিয়া অপরাধী হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তার শাস্তি হওয়া উচিত। কিন্তু সে প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিং বিভাগের কর্মকর্তা সাবেক রেডিও জকি (আরজে) নীরবকে কোন অপরাধে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেটা আমার কাছে পরিষ্কার নয়। একজনের অপরাধ ঢাকতে শাস্তি পাচ্ছে আরেকজন, অথচ মুক্তচিন্তার যুগে আমরা কতটাই না “নীরব”।’

দায় বিবেচনায় ব্যবস্থা নেবে পুলিশ

সর্বশেষ ১০ অক্টোবর গ্রাহকদের আড়াই কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে থলে ডটকম ও উইকম ডটকমের ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। ওই ছয়জন প্রতিষ্ঠান দুটির হেড অব অপারেশনস নজরুল ইসলাম, হিসাবরক্ষক সোহেল হোসেন, ডিজিটাল কমিউনিকেশন কর্মকর্তা তারেক মাহমুদ, সেলস এক্সিকিউটিভ মুন্না পারভেজ ও সুপারভাইজার মাসুম হাসান।

সিআইডির অতিরিক্ত উপপুলিশ মহাপরিদর্শক ইমাম হোসেন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রতিষ্ঠান দুটির মালিক একজনই। তিনি পলাতক। নাম–পরিচয় জানতে চাইলে তিনি সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ব্যক্তিগত তথ্য এভাবে প্রকাশ করা ঠিক হবে না। গ্রেপ্তার হলে বিস্তারিত জানাবেন।

এই কর্মকর্তাকে আরও প্রশ্ন করা হয়, কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী গ্রেপ্তার হচ্ছেন। আবার কোনো কোনোটিকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। নামীদামি তারকারা এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

ইমাম হোসেন বলেন, কার কতটুকু দায়, বিবেচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মামলার তদন্তে যুক্ত সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তাদের কারণে নির্দোষ মানুষ আসামি হয়েছেন বলেও প্রাথমিক তদন্তে মনে হয়েছে তাঁদের। উদাহরণ হিসেবে তাঁরা ই-অরেঞ্জের কথা বলছিলেন।

প্রতারণা করে গ্রাহকের ৯ কোটি ৫৩ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিনসহ সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলার অন্য আসামিরা হলেন সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান, ভাই বনানী থানার পরিদর্শক (বরখাস্ত) শেখ সোহেল রানা, খালু জায়েদুল ফিরোজ, প্রতিষ্ঠানটির সিওও আমান উল্লাহ চৌধুরী, নাজনীন নাহার ওরফে বীথি আক্তার ও নাজমুল হাসান।

এ পর্যন্ত ৯ মামলায় প্রতিষ্ঠানের তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ব্যবসার নেপথ্যে বনানী থানার সাবেক পরিদর্শক শেখ সোহেল রানা থাকলেও ট্রেড লাইসেন্স ছিল বোন সোনিয়া মেহজাবিনের নামে। তিনি ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে লেখাপড়া শেষে মালয়েশিয়ায় যান উচ্চশিক্ষায়।

সোনিয়ার স্বামী মাসুকুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে কাজ করতেন। সেই চাকরি ছেড়ে পরে এ ব্যবসায় যুক্ত হন। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তাঁকে না জানিয়েই নাজমুল হাসান গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করেন।

প্রতিষ্ঠানটির সিওও আমান উল্লাহ চৌধুরীর চাকরির বয়স মাস দুয়েক। আমাজনের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও ‘আমাজন বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে জয়েন্ট স্টক এক্সচেঞ্জ রেজিস্ট্রার থেকে নিবন্ধন নিয়েছিলেন। নিজেকে আমাজনের এ–দেশীয় প্রধান বলেও প্রচার করতেন।

এই আমান উল্লাহ গিয়ে যুক্ত হন ই-অরেঞ্জের সঙ্গে। এরপর প্রতিষ্ঠানটির বরখাস্ত হওয়া সিওও নাজমুলসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অভিযোগ ছিল ৬৬৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা হিসাবের গড়বড়ের।

কর্মকর্তারা বলেছেন, তদন্তের সময় তাঁরা আসামিদের কার কী উদ্দেশ্য ছিল, তা–ও দেখবেন। যিনি পণ্যের পক্ষে প্রচার চালিয়েছেন, তিনি প্রতারণার বিষয়টি জেনেও ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছেন কি না, পুলিশ তা খতিয়ে দেখছে।