উত্তরায় আগুনে ৩ ভবন ক্ষতিগ্রস্ত, দুজনের মৃত্যু

রাজধানীর উত্তরায় ভয়াবহ আগুনে একটি রেস্তোরাঁ, একটি আবাসিক হোটেল ও একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষ থেকে এক নারীসহ দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার ভোরে সি শেল গ্রুপের রেস্তোরাঁটিতে আগুনের সূত্রপাত হয়। নিহত দুজনের মধ্যে একজন মো. রাসেল মিয়া (৩৫), অপরজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
ফায়ার সার্ভিস বলেছে, দুর্বল অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা এবং রেস্তোরাঁয় অতিরিক্ত ডেকোরেশন ও ফলস সিলিং থাকায় আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। তবে রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিস দেরিতে কাজ শুরু করায় এবং পর্যাপ্ত পানি না থাকায় আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক-সংলগ্ন উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টরে এই রেস্তোরাঁ ও আবাসিক হোটেল।
রেস্তোরাঁ ভবনটি চারতলা। এর নিচতলায় রয়েছে রান্নাঘর ও খাবার পরিবেশনের চেয়ার-টেবিল। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত হলরুম। ফায়ার সার্ভিস বলছে, রেস্তোরাঁর নিচতলার রান্নাঘর থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
ওই আবাসিক হোটেলের অনুমোদন আছে কি না, জানতে চাইলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, অনুমোদনের বিষয়টি তাঁরা তাৎক্ষণিক জানাতে পারেননি। আজ মঙ্গলবার বিষয়টি ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ ও রাজউকের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।
রেস্তোরাঁ ভবনের লাগোয়া উত্তর ও দক্ষিণ পাশে আছে দুটি ছয়তলা ভবন। উত্তর পাশের ভবনটির তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ‘সি শেল রেসিডেন্স’ নামের আবাসিক হোটেল। ছয়তলায় হলরুম, দ্বিতীয় তলায় একটি বেসরকারি ব্যাংকের কার্যালয়, নিচতলায় সি শেলের মালিকানাধীন একুশে সুইটস অ্যান্ড বেকারি এবং একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কেন্দ্র। এই ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা রেস্তোরাঁ ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার সঙ্গে সংযুক্ত। রেস্তোরাঁ ভবন থেকে আগুন আবাসিক হোটেলে ছড়িয়েছে। আগুনে রেস্তোরাঁর দক্ষিণের এ কে টাওয়ার নামের ছয়তলা ভবনের তৃতীয় থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
হোটেলের কর্মকর্তা এমরান খান বলেন, গত রোববার দিবাগত রাত ১১টার দিকে তাঁদের রেস্তোরাঁ বন্ধ হয়। রাত পৌনে ১২টার দিকে চুলা, বিদ্যুতের লাইনসহ সব বন্ধ করে তাঁরা বের হয়ে যান। রাতে পাশের আবাসিক হোটেলে দুজন কর্মচারী ছিলেন। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন ছয়জন। ভোর চারটার দিকে তাঁরা জানতে পারেন, রেস্তোরাঁয় আগুন লেগেছে। সকালে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় আবাসিক হোটেলের তিনটি কক্ষ থেকে তিনজন বিদেশিকে নিরাপদে বের করে আরেক হোটেলে পাঠানো হয়। পরে সকাল ১০টার দিকে আবাসিক হোটেলের একটি কক্ষে দুজনের লাশ পাওয়া যায়।
ফায়ার সার্ভিসের দায়িত্বরত কর্মকর্তা পলাশ চন্দ্র মোদক জানান, ভোর পাঁচটার দিকে তাঁরা অগ্নিকাণ্ডের খবর পান। ১৫টি ইউনিট প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
উত্তরা পূর্ব থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শফিকুল গণি প্রথম আলোকে বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণের পর হোটেলে কেউ আটকা পড়েছেন কি না, তা নিশ্চিত হতে তল্লাশি চালানোর সময় ৩০২ নম্বর কক্ষে এক নারী ও এক পুরুষের লাশ পাওয়া যায়। পুরুষের সঙ্গে থাকা মুঠোফোনের মাধ্যমে তাঁর নাম মো. রাসেল মিয়া (৩৫) বলে জানা যায়। তিনি প্রাণ-আরএফএল গ্রুপে চাকরি করতেন। গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরের হাইমচরে। ঢাকায় পল্লবীতে থাকতেন। আনুমানিক ২৫-৩০ বছরের ওই নারীর পরিচয় পাওয়া যায়নি। রাসেলের পরিবারের সদস্যরাও তাঁকে চেনেন না।
হোটেল কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, নিহত দুজন স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে রোববার দিবাগত রাত দুইটার দিকে হোটেলের ৩০৯ নম্বর কক্ষে উঠেছিলেন। আগুন লাগার পর হোটেলকর্মীরা দুজনকেই কক্ষ থেকে বের করে এনেছিলেন। কিন্তু ফেলে আসা কিছু আনতে তাঁরা আবার ওপরে উঠলেও আগুন ও ধোঁয়ার কারণে কক্ষ পর্যন্ত যেতে পারেননি; ৩০২ নম্বর কক্ষে আটকা পড়েন এবং মারা যান। তাঁদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
মর্গ সূত্র বলেছে, দম বন্ধ হয়ে ওই দুজন মারা গেছেন।
হোটেলের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সোহেল গণি বলেন, হোটেলের মোট কক্ষ ৩১টি। এর মধ্যে চারটি কক্ষে মোট পাঁচজন অতিথি ছিলেন। আগুন নেভাতে গিয়ে হোটেলের চার-পাঁচজন কর্মচারী অসুস্থ হয়েছেন। তাঁর অভিযোগ, ফায়ার সার্ভিস দেরিতে কাজ শুরু করে এবং শুরুতে যে কয়টি ইউনিট এসেছিল, সেগুলোতে পানিও কম ছিল।
ফায়ার সার্ভিসের উত্তরা স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার শফিকুল ইসলাম বলেন, হোটেলটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা তেমন ছিল না। দু-একটি অগ্নিনির্বাপণযন্ত্র থাকলেও তা ছিল অপর্যাপ্ত। নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা গড়ে তুলতে এক মাস সময় দিয়ে গত ২০ ফেব্রুয়ারি হোটেল মালিককে চিঠি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তা হয়নি। তিনি বলেন, আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে জানতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) মেজর শাকিল নেওয়াজ বলেন, পুলিশের মাধ্যমে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে রেস্তোরাঁর কোনো কর্মচারীকে পাননি। কর্মচারীরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করেননি।
ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, রেস্তোরাঁয় রান্নায় ব্যবহৃত গ্যাস কিংবা বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে দুর্ঘটনাটি ঘটে থাকতে পারে।
স্থানীয় লোকজন বলেন, সি শেল রেস্তোরাঁ ও ভবনটির মালিক আমান উল্লাহ। তিনি প্রায় ২৬ বছর আগে রেস্তোরাঁ চালু করেন।
২০১৩ সালে রেস্তোরাঁর উত্তর পাশের ভবনের কয়েকটি তলা ভাড়া নিয়ে আবাসিক হোটেল চালু করা হয়।