উপেক্ষিত স্বাস্থ্যনীতি

স্বাস্থ্যনীতিতে স্বাস্থ্যসেবাকে মানুষে অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃিত দেওয়া হয়েছে

সবকিছুতেই একটা নীতিমালা বা পলিসি থাকে। যেমন সমাজে, রাষ্ট্রে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, সামাজিক সংগঠনে, এমনকি বাসাবাড়িতেও। তবে পাবলিক পলিসি বা লোকনীতির একটি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞাও আছে। পাবলিক পলিসি হলো এমন কিছু সিদ্ধান্ত, যা সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেওয়া হয় এবং সেখানে এমন কিছু মানুষের যুক্ততা থাকে, যাদের ওই বিষয়ের ওপর বিশেষজ্ঞ জ্ঞান রয়েছে এবং যার একটি সুনির্দিষ্ট কর্মক্রম প্রস্তাবিত হয়েছে। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকাও পলিসি বা নীতিরই অংশ। যেমন কোনো কায়েমি স্বার্থের কারণে, ক্ষতির আশঙ্কায়, কোনো বিষয়ে জানা না থাকার কারণে অথবা অন্য যেকোনো কারণেই নীতিনির্ধারকেরা কোনো বিষয়কে নীতিমালার আওতায় আনা থেকে বিরত থাকতে পারেন।

বাংলাদেশে প্রথম স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের কাজ শুরু হয় ১৯৮০–এর দশকের মধ্যভাগে, রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে। তাঁর সময়কালে প্রণীত ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি ছিল বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত নীতিমালাসমূহের পথিকৃৎ, যা দেশের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছিল। ওষুধনীতির মতো ১৯৯০ সালের প্রস্তাবিত প্রথম জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির প্রাণপুরুষও ছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এই স্বাস্থ্যনীতির মূল প্রতিপাদ্য ছিল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, জবাবদিহি সৃষ্টির লক্ষ্যে অডিট ব্যবস্থার উন্নয়ন, দক্ষ ওষুধ সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি। তবে বিভিন্ন মহলের আপত্তি ও এরশাদের পতনের পর প্রক্রিয়াটিই বাতিল হয়ে যায়।

তৌফিক জোয়ার্দার

বাংলাদেশের প্রথম স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীকালে নতুন করে স্বাস্থ্যনীতির কাজ শুরু হয়। শিক্ষাটি হলো যেকোনো পাবলিক পলিসির মতোই স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নেও স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে মতবিনিময় করে তাদের আস্থা অর্জন করাটা জরুরি। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখেই স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৯৯৬ সালে একটি কমিটি করে এবং তাতে সুশীল সমাজ, স্বাস্থ্যপেশাজীবীদের সংগঠনসমূহ, টেকনোক্র্যাট ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু স্বাস্থ্যনীতির একটি খসড়ার আলোর মুখ দেখতে ২০১১ পর্যন্ত সময় লাগে। ২০১১ সালে স্বাস্থ্য আন্দোলন নামক একটি সিভিল সোসাইটি প্ল্যাটফর্মসহ অন্যান্য আরও কিছু সংগঠন একটি আধুনিক ও গণমুখী স্বাস্থ্যনীতির জন্য জনসচেতনতা ও সংশ্লিষ্ট মহলে সংবেদনশীলতা সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়।

এভাবে দীর্ঘ সময় ধরে ও নানা ধাপ পেরিয়ে ২০১১ সালের ৩১ মে তারিখে যে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিটি জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে এল, তা স্বভাবত ব্যাপক গণপ্রত্যাশার সৃষ্টি করে। কিন্তু এমন শ্রমসাধ্যভাবে যে স্বাস্থ্যনীতিটি প্রণীত হলো, তা কি আমাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সম্যক বাস্তবায়ন ঘটাতে পারল? বর্তমান কোভিড-১৯ অতিমারি মোকাবিলাতেই–বা এ স্বাস্থ্যনীতির সার্থকতা কতটুকু? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ব্যাপারে আরেকটু তাত্ত্বিক আলোচনা দরকার।

আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিটি প্রকৃত অর্থেই একটি অগ্রসর নীতি এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো রয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া দারুণভাবে ত্রুটিপূর্ণ।

নীতিমালা বা স্বাস্থ্যনীতি বললেই আমরা বুঝি এক টুকরা কাগজ বা ডকুমেন্ট, যেখানে লেখা থাকে একটি রাষ্ট্রে স্বাস্থ্যব্যবস্থা কীভাবে পরিচালিত হবে, কার পাতে কী জুটবে, কীভাবে সেসবের জোগাড়–যন্ত্র হবে ইত্যাদি। কিন্তু স্বাস্থ্যনীতি বিশ্লেষণের যে বহুল প্রচলিত ফ্রেমওয়ার্ক রয়েছে (যা হেলথ পলিসি ট্রায়াঙ্গল নামে পরিচিত), তাতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যনীতিকে বুঝতে হলে কেবল এর কনটেন্ট তথা কাগুজে নথিপত্রকে বুঝলেই চলবে না, সেই সঙ্গে এর কনটেক্সট বা প্রেক্ষাপট এবং প্রসেস বা নীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকেও বুঝতে হবে। এখানে আমাদের স্বাস্থ্যনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ কী আছে, কী বাদ পড়েছে, আর কেনই–বা তার বাস্তবায়নে এত দীর্ঘসূত্রতা আর বারবার হোঁচট খাওয়া, তা নিয়ে কিছু কথা বলব।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যনীতিতে আছে প্রস্তাবনা, প্রেক্ষাপট, রূপকল্প, তিনটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, উনিশটি মূল লক্ষ্য ও ষোলোটি মূলনীতি, আঠারোটি চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো মোকাবিলায় উনচল্লিশটি কর্মকৌশল। স্বাস্থ্যনীতির প্রস্তাবনা শুরু হয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রদত্ত স্বাস্থ্যের বহুল সমাদৃত ও সামষ্টিক সংজ্ঞাটির মাধ্যমে, যেখানে স্বাস্থ্যকে কেবল রোগের অনুপস্থিতি হিসেবে বিবেচনা না করে একটি পরিপূর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থ অবস্থা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবাকে বলা হয়েছে মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। স্বাস্থ্যকে কেবল চিকিৎসার ক্ষুদ্র গণ্ডি থেকে বের করে প্রতিরোধমূলক কর্মকাণ্ড, যেমন বিশুদ্ধ পানি, যথাযথ খাদ্য, দূষণমুক্ত পরিবেশ ইত্যাদির বৃহত্তর পরিসরে স্থাপন করা হয়েছে। আর এসবের ব্যবস্থাপনায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অংশগ্রহণে বহু খাতভিত্তিক সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এসবের বিবেচনায় আমাদের স্বাস্থ্যনীতির প্রস্তাবনাটিকে যথেষ্ট আধুনিক এবং ভবিষ্যৎমুখী হিসেবে স্বীকার না করলে চলে না।

প্রেক্ষাপট অংশেও অকপটে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার নানা অসংগতি ও সীমাবদ্ধতাসমূহকে। যেমন ওষুধ সরবরাহের অপর্যাপ্ততা, জনবলের অভাব, প্রশাসনিক জটিলতা, অসংগঠিত রেফারেল ব্যবস্থা, শিশুপুষ্টিহীনতা, নানা স্বাস্থ্য সূচকে বৈষম্য, প্রসবসেবার অপ্রতুলতা, গ্রামাঞ্চলে প্রাতিষ্ঠানিক স্বাস্থ্যসেবার অভাব, জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত স্বাস্থ্যচাপ, মানহীন সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা, অদক্ষ সেবা প্রদানকারীদের ওপর নির্ভরতা, চিকিৎসা উপকরণের অভাব, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং সর্বোপরি স্বাস্থ্য খাতে মাথাপিছু ব্যয়ের স্বল্পতা। নানা অর্জনের উল্লেখের পাশাপাশি সীমাবদ্ধতাগুলোর এমন বিশদ আলোচনা আমাদের এই মর্মে আশ্বস্ত করে যে এ স্বাস্থ্যনীতির প্রণেতারা অন্তত জনমানুষের অপ্রাপ্তি আর অভিযোগের জায়গাগুলোর ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন।

রূপকল্পটিও যথেষ্ট প্রগতিশীল। সেখানে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকারের পাশাপাশি জনগণের সুস্বাস্থ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সেবাপ্রাপ্তির সাম্য, লিঙ্গসমতা, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্যের উন্নয়নের পূর্বশর্ত হলো সামষ্টিক উন্নয়ন। এ রূপকল্পে সেই দিকটিও স্বাস্থ্যনীতিপ্রণেতাদের নজর এড়ায়নি; তাঁরা দারিদ্র্য নিরসনের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে সবার জন্য প্রাথমিক ও জরুরি চিকিৎসা, সমতা, সেবার মান, সহজপ্রাপ্যতা, রোগ প্রতিরোধ, মানবাধিকার ও মর্যাদার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো। অতি জরুরি কোনো বিষয় বাদ পড়েছে, এমনটি বলা যাবে না।

জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির মূল লক্ষ্য হিসেবে চিকিৎসার পাশাপাশি স্থান পেয়েছে জনস্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, প্রতিস্থাপনযোগ্য জন–উর্বরতা অর্জন, মা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, চিকিৎসাশিক্ষার মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্য তথ্যপ্রাপ্তিতে অগ্রাধিকার, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের সহজলভ্যতা ও মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং বিকল্প চিকিৎসার (ইউনানি, আয়ুর্বেদীয়, হোমিওপ্যাথি) উন্নয়ন। ‘জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সম্পৃক্ত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ এবং বেসরকারি খাতের সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা নিশ্চিত করা’ (চতুর্দশ ধারা)। এসব ধারা থেকে বোঝা যায়, জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা তথা ক্লিনিক্যাল ট্র্যাক যে পৃথক, তার স্বীকৃতি স্বাস্থ্যনীতিতে আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখনকার অনেক ঊর্ধ্বতন স্বাস্থ্য কর্মকর্তাও এটি সম্যক অনুধাবন করেন না। হয়তো সে কারণেই এত বছরেও আমরা আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় জনস্বাস্থ্যের জন্য পৃথক কোনো ট্র্যাক দেখতে পাচ্ছি না, যার তীব্র প্রয়োজনীয়তা এই কোভিড-১৯ অতিমারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।

‘মূলনীতি’ এবং ‘চ্যালেঞ্জসমূহ’ অংশে যে বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে, তা আজ প্রায় এক দশক পরও তামাদি হয়ে যায়নি, বরং সেগুলো দারুণভাবে সাম্প্রতিক। অসংক্রামক রোগ, নতুন রোগের আবির্ভাব ও পুনরাবির্ভাব, জলবায়ুর পরিবর্তন, নগরস্বাস্থ্য, জনমিতিক অবস্থান্তর, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা, স্বাস্থ্য গবেষণা, রোগতাত্ত্বিক পরিবীক্ষণ—এমন অনেক বিষয়কে সংক্ষেপে ছুঁয়ে যাওয়া হয়েছে। ‘কর্মকৌশল’ অংশের প্রথম পয়েন্টটি প্রণিধানযোগ্য। সেখানে বলা হয়েছে, ‘সরকারপ্রধানের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠন করা হবে। এ কাউন্সিল সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ বেসরকারি খাতের স্টেকহোল্ডার এবং এ–সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। কাউন্সিল স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়নে দিকনির্দেশনা প্রদান করবে।’ আজ প্রায় এক দশক পরে, কোভিড অতিমারির মারণযজ্ঞের বিনাশপ্রান্তরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে, কোথায় সেই জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল?

আমাদের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিটি প্রকৃত অর্থেই একটি অগ্রসর নীতি এবং প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো রয়েছে। কিন্তু যে প্রেক্ষাপটে এই বিষয়গুলো বাস্তবায়িত হবে এবং তার বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া দারুণভাবে ত্রুটিপূর্ণ। সেই ত্রুটির সুলুকসন্ধান তাই জরুরি। নিবন্ধের শুরুতেই বলেছিলাম, সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকাও নীতিরই অংশ। কোনো কায়েমি স্বার্থের কারণে আমাদের স্বাস্থ্যনীতির প্রতি এমন স্বেচ্ছাকৃত অবহেলা কি না, তার অনুসন্ধানও আজ সময়ের দাবি। দক্ষিণ এশিয়ার স্বাস্থ্যসেবায় সবচেয়ে অগ্রসর রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় যেখানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে প্রতিকারমূলক এবং প্রতিরোধমূলক (জনস্বাস্থ্য) প্রতিষ্ঠানসমূহ পৃথক ও সমান্তরালভাবে কাজ করে, বাংলাদেশে সেখানে বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্তদের জনস্বাস্থ্য বিষয়ে পূর্ব প্রশিক্ষণকে মূল্যায়নের কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমনকি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের উচ্চ পদগুলো জনস্বাস্থ্য পেশাজীবীদের পদায়ন দাবি করে এলেও বরাবরই সেখানে নিয়োগ পেয়ে আসছেন জনস্বাস্থ্যে অভিজ্ঞতাবিহীন বা প্রশিক্ষণহীন স্বনামধন্য চিকিৎসক অথবা অসংশ্লিষ্ট চিকিৎসা-শিক্ষাবিদেরা।

বিসিএসে (স্বাস্থ্য) নিয়োগ–ত্রুটির কারণে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে প্রায় কখনোই জনস্বাস্থ্য বিষয়ে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যব্যবস্থাপকেরা নিয়োগ পান না; বরং যাঁরা সেখানে ঐতিহাসিকভাবে নিয়োগ পেয়ে আসছেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই স্বাস্থ্য খাত পরিচালনায় না আছে প্রশিক্ষণ, না আছে অভিজ্ঞতা। ফলে কোভিড-১৯-এর মতো অতিমারি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের ব্যর্থতা ছিল অবধারিত এবং এর দায়ভার কোনো একক ব্যক্তি, দপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের নয়; বরং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সামষ্টিক উপলব্ধিহীনতার; বিদ্যমান স্বাস্থ্যনীতির প্রতি সীমাহীন উদাসীনতার।

বাংলাদেশে নিপাহ ভাইরাস, জিকা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গুর মহামারির পর কোভিড-১৯ অতিমারির যে প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে, তা মহামারি হিসেবে প্রথম তো নয়ই, সম্ভবত শেষও নয়। এর থেকে উত্তরণে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার মূলধারায় জনস্বাস্থ্যের সম্পৃক্তকরণের কোনো বিকল্প নেই। এ জন্য পাঁচটি সুস্পষ্ট প্রস্তাব রাখছি: ১) বর্তমান স্বাস্থ্য খাতের কাঠামোতে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক কাজগুলো চিহ্নিত করা। ২) আবশ্যক জনস্বাস্থ্য কর্মকাণ্ডের যে আন্তর্জাতিক তালিকা আছে, সে অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতেও প্রয়োজনীয় পদ সৃষ্টি করা। ৩) জনস্বাস্থ্যের জন্য স্বতন্ত্র কিন্তু অন্তঃসংযুক্ত ক্যারিয়ার ধাপ তৈরি করা, যা শ্রীলঙ্কার মতো স্বাস্থ্য খাতে ঢোকার সময়ই নির্বাচন করে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকবে। ৪) আন্ডারগ্র্যাজুয়েট মেডিকেল কারিকুলামে ও প্রাসঙ্গিক উচ্চশিক্ষায় যথাযথ সংস্কার করে তা প্রস্তাবিত জনস্বাস্থ্য ক্যারিয়ার ধাপের উপযোগী করে তোলা। এবং ৫) জনস্বাস্থ্য ক্যারিয়ার ট্র্যাক বা ক্যারিয়ারের পর্যায়ক্রমিক ধাপকে সুসংহত করতে স্বাস্থ্যব্যবস্থায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন সাধন।

এগুলো বাস্তবায়নে ব্যাপকভিত্তিক ও সমন্বিত স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠন করে বিদ্যমান অধিদপ্তরগুলোর জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত কাজগুলোকে তার অধীনে সময়িত করতে হবে। জাতীয় স্বাস্থ্য কাউন্সিল গঠনের কথা যে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে স্পষ্টভাবে বলা আছে, তা আগেই উল্লেখ করেছি। কাজেই ক্ষুদ্র ব্যক্তি বা গোষ্ঠীস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে স্বাস্থ্যনীতির সঠিক বাস্তবায়নেই রয়েছে কোভিড-১৯–এর মতো অতিমারি মোকাবিলা ও দীর্ঘ মেয়াদে একটি গণমুখী, সুদক্ষ ও শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা পাওয়ার বীজমন্ত্র।

ড. তৌফিক জোয়ার্দার: জনস্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ও পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক