একজনও পাস করেন না, তবু চলে কলেজ-মাদ্রাসা!
একটি কলেজ থেকে এক যুগেও পাস করেননি কেউ। তবু প্রতিবছর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে কলেজটি। আরেকটি কলেজ থেকে দুজন পরীক্ষা দিয়ে দুজনই অনুত্তীর্ণ। সেই কলেজ হচ্ছে সরকারি। এমপিওভুক্ত হয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের কাছ থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন, কিন্তু একজন শিক্ষার্থীও পাস করতে পারেননি একটি মাদ্রাসা থেকে।
১৮ আগস্ট এইচএসসি ও আলিম পরীক্ষার ফলাফলে এ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। সারা দেশে এ রকম ২৫টি কলেজ ও মাদ্রাসা থেকে কেউ পাস করতে পারেননি। এর মধ্যে একটি পুরোপুরি আর দুটি আংশিক এমপিওভুক্ত। বাকি কলেজগুলো এমপিওভুক্ত নয়। বেশির ভাগ কলেজের শিক্ষকেরা নিয়মিত বেতন পান না বলে অভিযোগ আছে। এর মধ্যে একটি কলেজ সরকারি হওয়ার প্রক্রিয়াধীন।
যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আমিরুল আলম খান গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠান অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত। যেখানে কেউ পাস করে না, সেসব প্রতিষ্ঠান রাখার মানে নেই। কিন্তু মুশকিল হলো, এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন পেয়ে থাকে একেবারেই রাজনৈতিক বিবেচনায়। অনেক সময় নির্ধারিত শর্ত পূরণ না করায় বোর্ড অনুমোদন দিতে না চাইলেও মন্ত্রণালয় থেকে শর্ত শিথিল করা হয়। তাঁর ভাষায়, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী না থাকলেও শিক্ষক নিয়োগ করে লাখ লাখ টাকার বাণিজ্য হয়।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, শতভাগ অনুত্তীর্ণ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো কোনোটিতে শিক্ষার্থীর চেয়ে শিক্ষক-কর্মচারী বেশি। লেখাপড়ার পরিবেশ না থাকায় শিক্ষার্থীরা এসব কলেজে ভর্তিও হতে চায় না।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যাচাই-বাছাই হচ্ছে।
কিন্তু অনেক সময় আইনের সমস্যার কারণে ব্যবস্থা নিলেও সমস্যায় পড়তে হয়। তাই যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্র ভর্তি হয় না, হলেও থাকে না বা পাস করে না, সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইনকানুন সংশোধন করা হবে।
চলতি বছর মাদ্রাসা, কারিগরি ও আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৮ হাজার ৩৪৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ১২ লাখ ৩ হাজার ৬৪০ জন পরীক্ষা দিয়ে পাস করেছেন ৮ লাখ ৯৯ হাজার ১৫০ জন। ৮৪৮টির সব শিক্ষার্থীই পাস করেছেন। অবশ্য একজন পরীক্ষা দিয়ে একজন পাস করেছেন, এমন কিছু প্রতিষ্ঠানও এই তালিকায় রয়েছে।
যে ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেননি, তার মধ্যে তিনটি ঢাকা বোর্ডের, আটটি রাজশাহী বোর্ডের, আটটি দিনাজপুর বোর্ডের, একটি যশোর বোর্ডের ও পাঁচটি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, যেসব প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ পাস করেননি, সেগুলোর প্রায় সব কটিতে পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ থেকে ১০-এর মধ্যে।
দিনাজপুর বোর্ডে আট কলেজ: লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের দুহুলি এসসি উচ্চবিদ্যালয় অ্যান্ড কলেজ থেকে তিনজন পরীক্ষা দিলেও সবাই অনুত্তীর্ণ। সরেজমিনে জানা যায়, কয়েক বছরে কলেজটি থেকে কখনো ১১ জনের ওপরে শিক্ষার্থী পরীক্ষা দেননি। অথচ প্রতিষ্ঠানটির কলেজ শাখাতেই ১৪ জন শিক্ষক ও চারজন কর্মচারী। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও ২০০২ সালে কলেজ শাখা পাঠদানের অনুমতি পায়। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এনামুল হক বলেন, এবার অনুত্তীর্ণ তিন পরীক্ষার্থীর মধ্যে দুজন ছাত্রী বিবাহিত, নিয়মিত ক্লাস করেননি।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের শালমারা ইউনিয়নের বুড়াবুড়ি আজিতুল্লাহ সরকার হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে শুধু এবারই নয়, এক যুগ ধরে এইচএসসি পরীক্ষায় কেউ পাস করেননি। এবার একজন পরীক্ষা দিলেও পাস করতে পারেননি। এ রকম পরিস্থিতিতে চলতি শিক্ষাবর্ষে একাদশ শ্রেণিতে কেউ ভর্তিই হয়নি। অথচ কলেজ শাখায় মানবিক, বাণিজ্য ও বিজ্ঞান শাখায় ১০ জন শিক্ষক ও ছয়জন কর্মচারী রয়েছেন। ১৯৭৩ সালে হাইস্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজ শাখায় উন্নীত হয় ২০০৩ সালে। বিদ্যালয় শাখার একজন শিক্ষক বললেন, কলেজ শাখার কোনো শিক্ষক-কর্মচারী বেতন-ভাতা পান না। তাই কোনো শিক্ষক কলেজে আসেন না।
নীলফামারী সদরের নগর দারোয়ানী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে চারজন ও জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে মাত্র একজন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছেন। বগুলাগাড়ি স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মনোয়ারা বেগম বলেন, ২০১৪ সালে পাঠদানের অনুমতি পাওয়ার পর একজন ছাত্রী ভর্তি হয়। ওই একজনই পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হয়েছে। জানা গেছে, নগর দারোয়ানী কলেজে অধ্যক্ষসহ দুজন শিক্ষক ও বগুলাগাড়ি কলেজে পাঁচজন শিক্ষক আছেন।
রংপুরের পীরগাছার সাত দরগা স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ছয়জন পরীক্ষা দিয়ে সবাই অনুত্তীর্ণ। দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর উত্তর লক্ষ্মীপুর হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকেও কেউ পাস করতে পারেননি। ঠাকুরগাঁওয়ের রানীশংকৈল উপজেলার রামপুর কলেজ থেকে এবার পাঁচজন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছেন। ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত কলেজের অধ্যক্ষ জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এত দিন নিজেরাই চালিয়েছেন, আর পারছেন না।
রাজশাহী বোর্ডের আট কলেজ: সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার ছোনগাছা উইমেনস কলেজ থেকে একজন এবং তাড়াশ উপজেলার সগুনা ইউনিয়নের জহির উদ্দীন বিজ্ঞান ও কারিগরি স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাধারণ শাখা থেকে তিনজন পরীক্ষা দিলেও কেউ পাস করেননি। সবাই ইংরেজি বিষয়ে অকৃতকার্য। উইমেনস কলেজের অধ্যক্ষ লুৎফর রহমান তালুকদার বলেন, কলেজে ইংরেজির শিক্ষক নেই। বর্তমানে ২৪ জন শিক্ষার্থী ও ১১ জন শিক্ষক রয়েছেন। জহির উদ্দীন কলেজেও ইংরেজির শিক্ষক নেই।
নওগাঁর আত্রাই উপজেলার শিবগঞ্জ কারিগরি কলেজ থেকে পাঁচজন, বদলগাছি উপজেলার মিঠাপুর আদর্শ কলেজ থেকে পাঁচজন ও ধামুইরহাট উপজেলার পোড়ানগর কলেজ থেকে সাতজন পরীক্ষা দিলেও সবাই অনুত্তীর্ণ। শিবগঞ্জ কারিগরি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুস সাদেক বলেন, কলেজটির সাধারণ শাখাটি নন-এমপিও হওয়ায় ভালো ছাত্ররা ভর্তি হয় না। বেতন না হওয়ায় শিক্ষকদেরও ক্লাস নিতে অনীহা।
নাটোরের লালপুর উপজেলার ধুপইল কলেজ থেকে একজন পরীক্ষা দিলেও পাস করেননি। গুরুদাসপুর উপজেলা সদরের চাঁচকৈড় নাজিম উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে দুজন পরীক্ষা দিলেও পাস করেননি।
ঢাকা বোর্ডের তিন কলেজ: গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার নয়ানগর মহিলা কলেজ থেকে দুজন পরীক্ষা দিয়ে দুজনই অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। সরেজমিনে জানা যায়, কলেজটি ২০০৪ সালে স্থাপিত হলেও নিজস্ব অফিস নেই। পাশের উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অফিসে বসেই কলেজের দাপ্তরিক কাজ করা হতো। বর্তমানে কলেজের কার্যক্রম বন্ধ প্রায়। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে কোনো শিক্ষার্থী ভর্তি হয়নি। যে দুজন পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁরা অনিয়মিত পরীক্ষার্থী।
ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলার চর যশোরদী ইউনিয়নে অবস্থিত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে নয়জন পরীক্ষা দিয়ে সবাই অনুত্তীর্ণ হয়েছেন। কলেজের অধ্যক্ষ আফতাব হোসেন বলেন, ১৯৯৮ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হলেও কলেজ শাখা চালু হয় ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে। এবারই প্রথম এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন এই কলেজের শিক্ষার্থীরা। কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার আবুল কাসেম কলেজ থেকে দুজন পরীক্ষা দিয়ে দুজনই ফেল করেছেন।
যশোর বোর্ডের এক কলেজ: যশোর শিক্ষা বোর্ডের অধীন কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা কলেজ থেকে দুজন পরীক্ষা দিলেও পাস করেননি। এর আগেও এ কলেজ থেকে দুজন পরীক্ষা দিয়ে অকৃতকার্য হওয়ার ঘটনা আছে। কলেজটি এবার জাতীয়করণের জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কলেজের অধ্যক্ষÿমফিজুল ইসলাম বলেন, আশপাশের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় তাঁদের কলেজে ‘দুর্বল’ ছাত্রীরা ভর্তি হতো। যে দুজন ছাত্রী পরীক্ষা দিয়েছিলেন, তাঁদের পরীক্ষা শুরুর মাস খানেক আগে বিয়ে হয়।
শূন্য পাস করা পাঁচ মাদ্রাসা: গাজীপুরের বেলাশি মদিনাতুল উলুম গার্লস আলিম মাদ্রাসাটি এমপিওভুক্ত বলে জানালেন মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে এম ছায়েফ উল্ল্যা। অর্থাৎ, মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা মূল বেতনের শতভাগ সরকার থেকে পান। অথচ এই মাদ্রাসা থেকে পাঁচজন পরীক্ষা দিয়ে সবাই ফেল করেছেন।
ময়মনসিংহের ভালুকার পুনাশাইল এসএম আলিম মাদ্রাসা থেকে দুজন পরীক্ষা দিলেও পাস করেননি। এটি দাখিল স্তর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত। ভোলার বোরহানউদ্দিনের খানকা-ই-বশিরিয়া দারুস সুন্নাত আলিম মাদ্রাসা থেকে একজন পরীক্ষা দিলেও পাস করেননি। এটিও দাখিল স্তর পর্যন্ত এমপিওভুক্ত। মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার কাশিমপুর হোসানিয়া আলিম মাদ্রাসা থেকে তিনজন ও দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার সাকরপাড়া আকবর আলী শাহ আলিম মাদ্রাসা থেকে তিনজন পরীক্ষা দিলেও পাস করেননি। মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছায়েফ উল্ল্যা বললেন, এই মাদ্রাসাগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
{প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মোশতাক আহমেদ, ঢাকা; আরিফুল হক, রংপুর; আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ, রাজশাহী; আসাদুল্লাহ সরকার, দিনাজপুর; শাহাবুল শাহীন, গাইবান্ধা; তৌহিদী হাসান, কুষ্টিয়া; আবদুর রব, লালমনিরহাট; এনামুল হক, সিরাজগঞ্জ; পান্না বালা, ফরিদপুর; মীর মাহমুদুল হাসান, নীলফামারী; মুক্তার হোসেন, নাটোর; মাসুদ রানা, গাজীপুর; ওমর ফারুক, নওগাঁ}