একটি উদ্বেগজনক প্রশ্ন, ‘মালাডা কুহানে’

বর্তমান জনসংস্কৃতিতে সহিংসতা, দুর্বলের ওপর অত্যাচার নিয়ে কোনো গ্লানি নেই, অনুশোচনা নেই।

  • যে হাজার হাজার মানুষ তাণ্ডবে অংশ নেয়, তাদের চোখ-মুখ একটু খুঁটিয়ে দেখুন। কোথাও এতটুকু গ্লানি দেখবেন সেই চোখে-মুখে? একদমই নয়।

  • স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে যে সরকারগুলো ক্ষমতায় ছিল, এই জনসংস্কৃতি নির্মাণে ধারাবাহিকভাবে তারা অবদান রেখে গেছে।

নড়াইলে কলেজশিক্ষককে লাঞ্ছনার প্রতিবাদে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে সমাবেশ। গত মঙ্গলবার রাজধানীর শাহবাগে
ছবি: প্রথম আলো

তিনি ওখানটাতেই ছিলেন। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে। যখন প্রিন্সিপাল স্বপন কুমার বিশ্বাসকে তাঁর অফিস থেকে বের করা হয়, ঠিক তার আগে তিনি তালাশ করছিলেন, ‘ও শাহিনুর ভাই, মালাডা কুহানে?’ মালা মানে জুতার মালা, যা প্রিন্সিপালকে পরানো হবে। কণ্ঠটি বেশ স্পষ্ট। উচ্চারণে কোনো আরোপিত নাগরিক পরিশীলন নেই। বয়সও হয়তো চল্লিশের কম হবে না।

তাতে করেও হয়তো এই পুরো ঘটনায় তাঁর ভূমিকাটি খানিকটা নির্ধারিত হয়। তিনি দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটি দেখবেন। যে ছেলেগুলো রেলিং ডিঙিয়ে গিয়ে প্রিন্সিপালের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দেবেন, তিনি তাঁদের সঙ্গে শামিল হবেন না। কিন্তু ঘটনাটিতে তাঁর সমর্থন থাকবে। যে গুজব বা তথ্য ছড়ানো হয়েছে, তিনি তা সহজে বিশ্বাস করেন। তাঁর মন তৈরি হয়ে আছে সেটি বিশ্বাস করার জন্য।

তিনি ঘটনায় নিজে তৎপর নন, কিন্তু যে জনরোষের ঘটনায় জনসমাগম একটি প্রয়োজনীয় উপাদান, তিনি সেখানে উপস্থিত থেকে মানুষের জোগান দেবেন। আমাদের এই মানুষটিকে বোঝা দরকার। দশকের পর দশক ধরে কীভাবে তিনি নির্মিত হয়েছেন, সেটিও বোঝা দরকার। কারণ, এই মানুষটির নির্মাণ কৃৎকৌশল, তাঁর বিশ্বাস, বৃহত্তর সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরে তাঁর সম্ভাব্য ভূমিকা—এ সবই আমাদের পরিবর্তমানজনসংস্কৃতির অংশ।

ধরা যাক, তাঁর নাম করিমুদ্দীন। করিমুদ্দীন শৈশবে যে গ্রামে বড় হয়েছেন, সে গ্রাম হয়তো ছিল জসীমউদ্‌দীনের সোজন বাদিয়ার ঘাট-এর সেই গ্রাম:

সরস্বতী পূজার লাড়ু গড়িয়ে দু-চার জোড়া

মুসলমানের ঠোঁট ছুঁয়েছে তাও দেখেছি মোরা।

ছোঁয়াছুঁয়ির এতই যে বাড়, পীরের পড়া জল,

নমুর পোলার পীড়ার দিনে হয়নি তা বিফল।

দরগাতলায় করতে প্রণাম ভালের সিন্দুর দিয়ে

নমুর মেয়ে লাল করে যায় শুকনো মাটির হিয়ে।

করিমুদ্দীন শৈশবে দেখেছেন দরগাহ-মাজারকে ঘিরে মাসব্যাপী চৈত্রসংক্রান্তির মেলা। বাগ-দত্তা যাত্রাপালায় আলীমের অভিনয় দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। সেসব আর নেই। গ্রামে যে হিন্দুরা ছিল, তাদের অনেকেই চলে গেছে। নড়াইলের যে গাসসি উৎসবে তিনি নিজেও হয়তো যোগ দিয়েছেন শৈশবে, কুলা-ঝাঁঝর হাতে, সে উৎসব আর তেমন দেখা যায় না।

গ্রামের পূজাপার্বণ আর নেই, সেসবের স্মৃতিও তাঁর কাছে ধূসর। সত্যি কথা বলতে কি, খুব বেশি হিন্দুকে তিনি কাছ থেকে চেনেনও না। তবে হ্যাঁ, তাদের কথা তিনি শোনেন। সেখানে ধর্মীয় বয়ানের নামে বিভিন্ন সময় অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানো হয়। ধর্মালোচনার পাশাপাশি তিনি কখনো কখনো এ-ও শোনেন যে হিন্দুরা কাফের, তাদের সঙ্গে মেলামেশা করতে নেই।

এই হিন্দু তাঁর গ্রামের কেউ নয়, তাঁর নিজস্ব প্রতিবেশের কেউ নয়। তার প্রতি কোনো মমত্ব আর গড়ে ওঠে না। সে ‘অপর’। পাশাপাশি তিনি এ-ও শুনেছেন, টাঙ্গাইলের মির্জাপুরের বাউলশিল্পী শরিয়ত সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে গানে ধর্ম নিয়ে ‘বেশরিয়তি’ কথা বলার জন্য। ঢাকায় লালনের ভাস্কর্য ভেঙে দিয়েছে ‘তৌহিদি’ জনতার নামে। এ সবকিছু আকীর্ণ করে থাকে করিমুদ্দীনের বিশ্বাসের জগৎ।

এসব উপাদান দিয়েই গঠিত হতে থাকে তাঁর মনোজগৎ, তাঁর সামাজিক-রাজনৈতিক পক্ষপাত, যা করিমুদ্দীনের জন্য হয়ে ওঠে যাপিত জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সবকিছু মিলিত হয়ে করিমুদ্দীনকে উৎসাহিত করে প্রশ্ন করতে, ‘ও শাহিনুর ভাই, মালাডা কুহানে?’ তিনি চান স্বপন কুমার বিশ্বাসকে জুতার মালাটি পরানো হোক। প্রশ্ন করেন না, স্বপন কুমার বিশ্বাস সত্যি কোনো অপরাধ করেছেন কি না। তিনি বিশ্বাস করেন, স্বপন কুমার বিশ্বাস তাঁর মতো কেউ নন। অপর।

২.

যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরা খেয়াল করেন না এমন কোটি কোটি করিমুদ্দীনের সমষ্টিতেই গড়ে ওঠে জনসংস্কৃতি। এই করিমুদ্দীনকে পাঠ করলেও আমরা খানিকটা বুঝতে পারি বাংলাদেশের আজকের জনসংস্কৃতির শক্তিশালী ধারাটি কী। আজকাল তো সিসিটিভিতে অনেক কিছুই পাওয়া যায়। গেল ১০ বছরে যতগুলো তাণ্ডব ঘটে গেছে, সেগুলো দেখে শুধু জনাকয়েক অপরাধী শনাক্তকরণ নয়, বরং যে হাজার হাজার মানুষ সেসব তাণ্ডবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের চোখ-মুখ একটু খুঁটিয়ে দেখুন। কোথাও এতটুকু গ্লানি দেখবেন সেই চোখে-মুখে? একদমই নয়। এসবে অংশগ্রহণ করা কিশোরদের কাছে এ যেন এক উৎসব। এখান থেকেই বুঝতে হবে আমাদের বর্তমান জনসংস্কৃতির প্রকৃতি।

এই জনসংস্কৃতিতে সহিংসতা, দুর্বলের ওপর অত্যাচার নিয়ে কোনো গ্লানি নেই, অনুশোচনা নেই। এই জনসংস্কৃতি আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে, আমরা কি ভেবে দেখেছি? একজন রনি, একজন জিতুকে গ্রেপ্তার করে এর সমাধান নেই। এমনকি তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়েও ভয়ংকরভাবে বদলে যাওয়া একটি জনসমাজকে সতর্ক করা যায় না। উপর্যুপরি অনেকগুলো একই রকম ঘটনা থেকে তা প্রমাণিত। সমস্যাটি আরও গভীরে প্রোথিত। সেই গভীর থেকে মূলোৎপাটনের কোনো চেষ্টা কি আমাদের আদৌ আছে?

স্বাধীনতার পর থেকে বিভিন্ন সময়ে যে সরকারগুলো ক্ষমতায় ছিল, এই জনসংস্কৃতি নির্মাণে ধারাবাহিকভাবে তারা অবদান রেখে গেছে। আর বর্তমানে যারা ক্ষমতায়, এই জনসংস্কৃতি নির্মাণের দায় তারাও কোনোভাবে এড়াতে পারে না। এই জনসংস্কৃতিই যে একদিন তাদের সর্বনাশ ডেকে আনবে, সেটি তারা বোঝে তো? জন ডানের সেই বিখ্যাত উক্তিটি স্মর্তব্য, ‘(গির্জায়) ঘণ্টা বাজলে জানতে পাঠিয়ো না কার জন্য (কার মৃত্যুতে) ঘণ্টা বাজছে, ওটা তোমার জন্যই বাজছে।’

৩.

২০১৩ থেকেই আমরা দেখছি বর্তমান সরকার ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের কাছে টানার চেষ্টা করে যাচ্ছে। খুব কম ছাড় দেয়নি। ক্ষণিক বিভ্রান্তিতে মিক্সড সিগন্যালও দিয়েছে অনেকবার। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশকে স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া একটি দল। আওয়ামী লীগের এই পরিচয় কোনো মিক্সড সিগন্যালে ঘুচে যাওয়ার নয়। তা ছাড়া নিজের ভিত ঠিক রাখতে আওয়ামী লীগকে ঘুরেফিরেই অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলতে হয়। অন্তর্গত অনেক সমস্যা সত্ত্বেও এই পরিচয় ধরে না রাখলে আওয়ামী লীগ আর আওয়ামী লীগ থাকে না। আওয়ামী লীগ সাম্প্রদায়িক দল হয়ে গেলেও তার ওপর সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্থা থাকবে না।

এটিও আওয়ামী লীগের বুঝতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তান ভাঙা, অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের মাধ্যমে বড় বড় মৌলবাদী নেতাকে ফাঁসিতে ঝোলানো—মৌলবাদী শক্তির কাছে এসব ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। কৌশলগত কারণে তারা হয়তো কাছে থাকার ভান করে যাবে, কিন্তু সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে। সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গার পানিতে ফেলে দিতে চাইবে। তার চেয়েও বড় সুযোগ পেলে তারা কী করবে? ইউটিউবে অজস্র ভিডিও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সেই ২০১৩ সাল থেকে। একটু দেখে আসুন।

যে সাম্প্রদায়িকতার জনসংস্কৃতি বিস্তৃত হচ্ছে, যেখানে কোটি কোটি করিমুদ্দীন বদলে যাচ্ছেন, সেই জনসংস্কৃতিতে আওয়ামী লীগের জনভিত্তিটি কীভাবে তৈরি হবে? আর জনভিত্তি না থাকলে আওয়ামী লীগকে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় থাকতে হবে, পুলিশ দিয়ে, আমলা দিয়ে, অপরাপর শক্তিগুলোকে কাজে লাগিয়ে। একটা অবাধ নির্বাচন দিয়ে ক্ষমতায় থাকার উপায় তার থাকবে না। হ্যাঁ, সেভাবে বিশ্বের কিছু দেশে অনেকেই ক্ষমতায় আছেন।

কিন্তু সেখানেও জনসংস্কৃতি যাঁদের সহায়ক নয়, তাঁরা বিশেষ স্বস্তিতে নেই। তাহলে কি আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার ‘আশঙ্কা’র কথাও ভাবে? সম্ভবত না। কারণ, তার শাসনামলে রয়েছে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারের ইতিহাস। এই আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পরিণতির কথা ভাবলে নিশ্চয়ই শিউরে উঠবে। একটা স্ট্যাটাস কো (স্থিতাবস্থা) অন্তত ধরে রাখতে চাইবে আওয়ামী লীগ। সেটাও কি সম্ভব?

৪.

জনসংস্কৃতি বদলে গেলে সবই বদলে যায়। আজ যাঁরা আমলা, পুলিশ তাঁদের দলানুগত্যের কথা সর্বজনবিদিত। একসময় তাঁরা অবসরে যাবেন। আসবেন নতুন আমলা, পুলিশ।

কোত্থেকে? ওই জনসংস্কৃতি যাঁদের তৈরি করে পাঠাবে, তাঁদের মধ্য থেকেই তো? আমরা তো এখনো দেখছি। এই যে স্বপন কুমার বিশ্বাসের পাশে পাশে পুলিশ হাঁটল, তাঁর গলা থেকে জুতার মালাটা খুলে নিল না, কিংবা যখন তাঁকে জুতার মালাটা পরিয়ে দেওয়া হয়, তখন বাধা দিল না, সেই পুলিশ কোত্থেকে এসেছে? ‘বাংলাদেশে মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস তদন্তে গণকমিশন’ জানিয়েছে, গেল কয়েক বছরে সহিংসতায় বেশ কিছু আমলার ইন্ধন ছিল। এই আমলারাও এসেছেন সাম্প্রদায়িক জনসংস্কৃতি থেকে।

তাঁদের সংখ্যা বাড়তে থাকবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের চেহারা আরও বদলে যাবে। একটা সময় আসবে যখন সেই রাষ্ট্রযন্ত্রে অসাম্প্রদায়িকতার বয়ান জারি রাখা আওয়ামী লীগের কোনো বৈধতা আর থাকবে না। আর আওয়ামী লীগ খোলনলচে বদলে সাম্প্রদায়িক হতে চাইলেও সে গ্রহণযোগ্য হবে না।

কারণ, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে পাকিস্তান ভাঙা এবং মানবতার বিরুদ্ধের অপরাধের বিচার করেছে দলটি। এক করিমুদ্দীন হয়তো আবারও প্রশ্নটা করবেন, ‘ও শাহিনুর ভাই, মালাডা কুহানে?’ তখন লাখ লাখ করিমুদ্দীন কে কী করবেন, তার সবটুকু আমরা কল্পনাও করতে পারব না। কিংবা কল্পনা করতে চাইব না। ভয়ে।

সুব্রতশংকর ধর: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক, বর্তমানে একটি বিশ্ব সংস্থায় কর্মরত।