একরামুল হত্যাকাণ্ডে মামলা হয়নি, জানেন না মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগমছবি: প্রথম আলো

কক্সবাজারের টেকনাফে পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি, তা জানেন না জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১৮ সালের মে মাসে।
আজ রোববার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয়ে কমিশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নাছিমা বেগম বলেন, টেকনাফের একরামুল হকের ঘটনায় মামলা হয়েছে, তাই কমিশন সে জায়গা থেকে সরে এসেছে। তবে তখন গণমাধ্যমকর্মীরা যখন জানান এ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি, তখন কমিশনের চেয়ারম্যান তাঁর কর্মীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে কে যেন বললেন যে মামলা হয়েছে?’ এ সময় গণমাধ্যমকর্মীরা চেয়ারম্যানকে আবার বলেন, ‘আপনাকে মনে হয় ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে।’

কমিশনের গত দুই বছরের কার্যক্রম তুলে ধরার জন্য এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গত দুই বছরে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে কমিশনের নজরদারির মধ্যেই ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এই বাহিনীর সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা কতটুকু যৌক্তিক, গণমাধ্যমকর্মীদের এ প্রশ্নেই টেকনাফের পৌর কাউন্সিলর একরামুল হকের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটি আসে। তবে চেয়ারম্যান নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দেওয়ায় একাধিক সাংবাদিক এ বিষয়েই প্রশ্ন করতে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে সরাসরি উত্তর চাইলে চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ‘আপনারা যে প্রশ্ন বারবার করছেন, সাতজনের বিরুদ্ধে যে নিষেধাজ্ঞা, তা আরও সুনির্দিষ্ট হলে আমরা আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারব। মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে আমরা সমর্থন করব না।’

তখন একজন গণমাধ্যমকর্মী জানান, টেকনাফের পৌর মেয়রের ঘটনাটি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর সুনির্দিষ্ট করেছে। আগের কমিশনের প্রতিনিধিরা তখন ঘটনাস্থলে গিয়ে আইনগত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। বর্তমান কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এটার ‘ফলোআপ’ করেছেন কি না। চেয়ারম্যান তখন জানান, তাঁর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। মামলা হয়ে গেছে বলে কমিশন সেখান থেকে সরে এসেছে।

সংবাদ সম্মেলনের পর মুঠোফোনে প্রথম আলো কথা বলে একরামুল হকের স্ত্রী আয়েশা একরামের সঙ্গে। তিনি বলেন, মামলা করতে গেলেও তাঁরা মামলা করতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় মামলা হয়নি। আগের মানবাধিকার কমিশনের সদস্যরা ঘটনার পর গিয়ে সবকিছু দেখে এসে আইনি সহায়তারও আশ্বাস দিয়েছিলেন। তারপর আর কিছু হয়নি।

২০১৯ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে বর্তমান কমিশন কাজ করেছে। ২০১৮ সালের ২৬ মে একরাম নিহত হন। তখন একরামের বিরুদ্ধে ইয়াবা কারবারে জড়িত থাকার অভিযোগ তোলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

আজ সংবাদ সম্মেলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগমের সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের মতপার্থক্য হতেই থাকে। চেয়ারম্যান বলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা যৌক্তিক কি না, তা নিয়ে এখন মন্তব্য না করে আরেকটি প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এই রাষ্ট্রের কাছে মিয়ানমারের এত বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন, তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কী ভূমিকা ছিল?’ তখন গণমাধ্যমকর্মীরা জবাব দেন, মিয়ানমারের বিষয়েও আলাদা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে।

নাছিমা বেগম বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনায় সুস্পষ্টভাবে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল থেকে অবস্থানপত্র দেয়। সেটা দেওয়ার পর আমরা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাই। আমরা এখন পর্যন্ত কাউন্সিল থেকে কিছু পাইনি। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার বিষয়টিতেও আমরা ওয়েট করছি।’

তারপরও গণমাধ্যমকর্মীদের যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন অব্যাহত থাকলে কমিশনের মতামত জানাতে চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য কামাল উদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেন। তখন কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, কমিশন যেকোনো গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যার বিরুদ্ধে। প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে কে ঘটনা ঘটাল, তা দেখবে না কমিশন। কমিশন কখনোই তা সমর্থন করবে না।
কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কোনো একটি দেশ আরেকটি দেশকে সিদ্ধান্ত নিয়ে জানিয়েছে। এ ধরনের সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে অতীতের বিভিন্ন ঘটনা থেকে দেখেছি, রাজনৈতিক একটা উদ্দেশ্য থাকতে পারে। ৪০০ বা ৬০০ অভিযোগ বা যাদের কাছ থেকে এ ধরনের রিপোর্ট পাওয়া যায়, তা দেয় কিছু ফলভোগী সংগঠন। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু সংগঠনের সঙ্গে আগেও বসেছিলাম। তারা তখন বলে, পত্রিকা থেকে প্রতিবেদন দিয়েছে। পত্রিকা ফোর্থ পিলার, তবে কখনো কি ভুল, ভিত্তিহীন রিপোর্ট আসে না পত্রিকায়? ধারণা হচ্ছে, সম্ভবত এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হতে পারে। ২০০৪ সালে র‌্যাব প্রতিষ্ঠিত। অন্য সময় অনেক অভিযোগ এসেছে। এর আগে কিছু করা হয়নি। আমরা যাচাই করার জন্য অপেক্ষা করছি।’

নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব বিভাগের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অংশ হিসেবে র‌্যাবের যে কার্যক্রম, তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) বরাত দিয়ে বলা হয়, র‌্যাবের বিরুদ্ধে ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৬০০টির বেশি গুম, ২০১৮ সাল থেকে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে।