একসময় নারী অধিকারের কাজে বাধা দিতেন, এখন ‘চেঞ্জমেকার’
মো. দেলোয়ার হোসেন ২০০৮ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় নারীর সমতার বিরুদ্ধে ছিলেন। যে সংগঠনটি করতেন, সেখানে ‘পাখি পড়ানোর’ মতো শেখানো হতো, নারীর ক্ষমতায়নের জায়গা নেই। গ্রামে নারী অধিকার নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠন নারীদের নিয়ে সভা করলে তিনি বাধা দেওয়া শুরু করেন। তবে সেই দেলোয়ার এখন তেমন নেই। এখন তিনি নিজেই নারী অধিকার নিয়ে সোচ্চার। উগ্রবাদ ও নারীবিদ্বেষী মনোভাব থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে এনে নারী নির্যাতন ও মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে উদ্বুদ্ধ করেন।
দেলোয়ার হোসেন বাস করেন রংপুর সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের রণচণ্ডীপুর শেখপাড়ায়। বাবা-মা, স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তাঁর পরিবার।
গত বছর আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ (২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর) পালন উপলক্ষে ‘আমরাই পারি পারিবারিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোট (উই ক্যান)’ সংক্ষেপে ‘আমরাই পারি জোট’ গত ২৭ নভেম্বর রাজধানীতে আয়োজিত এক সম্মেলনে নারীর অধিকার রক্ষায় অবদান রাখার জন্য যে পাঁচজনকে ‘চেঞ্জমেকার পদক–২০২১’ দিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে দেলোয়ারও একজন।
যেভাবে বদলে গেলেন দেলোয়ার
নিজেকে বদলে ফেলার গল্পটি প্রথম আলোকে বলতে গিয়ে দেলোয়ার (২৬) বলেন, অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় যে সংগঠনটিতে ছিলেন, সেখানে শুধু নারীবিদ্বেষী আলোচনা হতো। জিহাদের কথা বলা হতো। ২০১০ সালে গ্রামে পল্লীশ্রী নামের বেসরকারি একটি সংগঠন নারী অধিকার বিষয়ে কাজ করতে আসে। তারা নারীদের নিয়ে সভা করতে গেলে তিনি বাধা দিতেন। বলতেন, ‘আপনারা দেশকে ধ্বংস করছেন’। ওই সংগঠনের কর্মসূচি সমন্বয়কারী শাহনাজ পারভিন তাঁকে নানাভাবে বোঝানো শুরু করেন। পাড়ায় পাড়ায় বিভিন্ন সভায় তাঁকে নেওয়া শুরু করলেন। একদিন পবিত্র কোরআনের বঙ্গানুবাদসহ পড়তে অনুরোধ করলেন। পরে পল্লীশ্রীর মাধ্যমে যুক্ত হন আমরাই পারি জোটের কার্যক্রমে।
দেলোয়ার বলেন, ‘কোরআন শরিফের বঙ্গানুবাদ পড়ে নিজের ভুল ভেঙে গেল। ইসলাম ধর্ম উগ্রবাদকে কখনো প্রশ্রয় দেয় না। নারীকে পূর্ণ মর্যাদা দেয়। আরও দুই বছর বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রম খেয়াল করি। একসময় নারীর অধিকারের বিষয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে শুরু করে।’ এরপর নিজেকে আরও তৈরি করতে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে রেড ক্রিসেন্টের ইয়ুথ ভলান্টিয়ার, ব্রিটিশ কাউন্সিলের অ্যাকটিভ সিটিজেন, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনসহ বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত হন।
দেলোয়ার ২০১৭ সালে কামিল পাস করেন। একই সঙ্গে তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৮ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে রংপুরের কারমাইকেল কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেন। এখন ফিল্ড ফ্যাসিলেটর হিসেবে কাজ করছেন পল্লীশ্রীতে।
দেলোয়ার প্রসঙ্গে আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী জিনাত আরা হক বলেন, সংগঠনের কাজে যুক্ত হওয়ার পর দেলোয়ার বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজেকে বদলাতে শুরু করেন। তাঁর বাবা-মায়ের বিয়ের নিবন্ধন ছিল না, সেটা জানতে পেরে বিয়ে নিবন্ধন করান। একমাত্র ছেলে হিসেবে দেলোয়ারের বিয়ের সময় পরিবার থেকে যৌতুক চাওয়া হয়েছিল। দেলোয়ার তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। তিনি জানান, যৌতুক নিয়ে বিয়ে করবেন না। শেষ পর্যন্ত দেলোয়ারের বিয়েটা যৌতুক ছাড়াই হয়। তিনি সমাজের পরিবর্তন আনার কাজে যুক্ত হওয়ার আগে নিজেকে পাল্টেছেন। দেলোয়ার অনেকের জন্য একটি বড় উদাহরণ।
তৈরি করছেন আরও চেঞ্জমেকার
নিজ পরিবার থেকেই নারী অধিকার রক্ষা ও নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ শুরু করতে হবে— এই ভাবনা নিয়ে তরুণ-তরুণীদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন দেলোয়ার। বললেন, রংপুরের আটটি উপজেলায় চেঞ্জমেকার তৈরিতে প্রচারাভিযান চালান। ৩৪টি স্কুল-কলেজে ৩৪টি চেঞ্জমেকার ফোরাম তৈরি হয়েছে। একেকটি ফোরামে ৫১ জন করে সদস্য। রংপুরে তাঁর মতো ১৪ হাজার চেঞ্জমেকার আছে। যাঁরা বাল্যবিবাহ, যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, নারী নির্যাতন, মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করেন। দেলোয়ার বলেন, ‘অনেকে নারীর অধিকার নিয়ে সচেতন হয়েছেন। তবে কেউ কেউ আছেন, যাঁরা নারীর সমতার বিষয়টি মেনে নিতে চান না। এ ধরনের মানুষেরা দোকানে চায়ের আড্ডায় বসলে বিদ্রূপ করে আমাকে বিদেশি দালাল ডাকেন। তবে সময়ে আরও পরিবর্তন আসবে আশা করি।’
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের রংপুর জেলা সভাপতি ফখরুল আনাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেলোয়ার একসময় উগ্রবাদী আদর্শ লালন করত। তবে ওর মধ্যে কিছু ইতিবাচক বিষয় খেয়াল করে স্থানীয় নারী সংগঠনের বিভিন্ন কাজে সম্পৃক্ত করি। কাজের প্রতি খুব নিবেদিত প্রাণ। ধীরে ধীরে ওর মধ্যে পরিবর্তন আসে। এখন সে নারী অধিকার বিষয়েই শুধু নয়, এলাকার যেকোনো রাস্তা নির্মাণ, বিদ্যুৎ সংযোগ আনা ইত্যাদি সমাজকল্যাণমূলক কাজেও যুক্ত।’