একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে সিডিএ–সিটি করপোরেশন

চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় তলিয়ে গেছে বিভিন্ন সড়ক। শনিবার দুপুরে তোলা
ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে তিনটি সংস্থা। প্রায় পাঁচ বছর ধরে প্রকল্পগুলোর কাজ চলছে। এরপরেও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে রেহাই পাচ্ছে না নগরবাসী। ভারী বৃষ্টি হলেই নগরের বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে যায়। গত শুক্রবারের ভারী বৃষ্টিতে আবার ডুবেছে নগর। এমনকি সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ির উঠান ও সামনের রাস্তাও তলিয়ে গেছে।

এ নিয়ে গত দুই মাসে অন্তত চার দফা জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে নগরে। এই পরিস্থিতির জন্য পরস্পরকে দায়ী করছে সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)।

‘আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে’—বর্ষা মৌসুম শুরুর আগে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তারা এই আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। একেকবার জলাবদ্ধতা হলে পানি জমে থাকে ১ থেকে ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। অন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা দাবি করছেন, পূর্ণাঙ্গ সুফল পেতে হলে প্রকল্পের কাজ সম্পূর্ণ বাস্তবায়িত হতে হবে। এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে। গত পাঁচ বছরে এসব প্রকল্পের বিভিন্ন কাজে ৪ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

‘দোষারোপ’ চলছে

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও সিডিএর প্রকৌশলীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রাম নগরে পানিনিষ্কাশনে ৫৭টি খাল রয়েছে। এসব খালের দৈর্ঘ্য ১৬৫ কিলোমিটার। আর নালা রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটারের। এর মধ্যে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতায় সিডিএ ৯৭ কিলোমিটার দীর্ঘ ৩৬টি খাল এবং ৩০২ কিলোমিটার নালার কাজ করছে।

এদিকে সিডিএর প্রকল্পের আওতার বাইরে থাকা ২১টি খাল পরিষ্কার বা রক্ষণাবেক্ষণে কোনো উদ্যোগ নেয়নি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকির অভাবে এসব খালের কোথাও দখল হয়ে গেছে। কোনো কোনো খাল ময়লা-আবর্জনা জমে ও আগাছার কারণে পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। এতে পানিনিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের আওতার বাইরে থাকা খাল ও নালা-নর্দমাগুলো নিয়মিত পরিষ্কার না হওয়ার কারণে জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে যাচ্ছে বলে দাবি করেছেন সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস। তিনি এ জন্য সিটি করপোরেশনের ভূমিকাকে দায়ী করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নগরে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপাদিত হয়, তার সব সিটি করপোরেশন পরিষ্কার করতে পারে না। ফলে আওতার বাইরে থাকা ময়লা-আবর্জনা খাল ও নালা-নর্দমায় মিশে যাচ্ছে। ফলে বারবার পরিষ্কারের পরেও তা দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। সিটি করপোরেশন প্রকল্পের বাইরে থাকা খাল ও নালাগুলো ঠিকভাবে পরিষ্কার করলে পানি আরও দ্রুত নামত।

তবে সিডিএর দাবি মানতে রাজি নন সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নগরের জলাবদ্ধতার সমস্যা সৃষ্টির পেছনে সিডিএর দায় কম নয়। নগরের প্রাকৃতিক জলাধারগুলো নষ্ট করে বসতি গড়ে উঠেছে। সিডিএ প্রাকৃতিক জলাধারগুলো সংরক্ষণের পরিবর্তে সেখানে ভবন নির্মাণে নকশার অনুমোদন দিয়েছে। আবার প্রকল্পের কাজ চলাকালে খালগুলো থেকে কাদা ও আবর্জনা পরিষ্কার করার কথা। কিন্তু তার পরিবর্তে নির্মাণকাজের জন্য খালগুলোর মধ্যে মাটি ভরাট করে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে।

চট্টগ্রামে ভারী বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতায় তলিয়ে গেছে মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বাড়ির ওঠান ও সামনের সড়ক। শনিবার দুপুরে তোলা
ছবি: সংগৃহীত

৫ বছরে খরচ ৪৩৩৯ কোটি টাকা, সুফল নেই

নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনে সিডিএর ‘চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে খাল পুনঃখনন, সম্প্রসারণ, সংস্কার ও উন্নয়ন’ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ২৭০ কোটি টাকা এবং ‘কর্ণফুলী নদীর তীর বরাবর কালুরঘাট সেতু হতে চাক্তাই খাল পর্যন্ত সড়ক নির্মাণ’ প্রকল্পে ১ হাজার ৭০ কোটি টাকা; চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ‘বহদ্দারহাট বারইপাড়া থেকে কর্ণফুলী নদী পর্যন্ত খাল খনন’ প্রকল্পে ৯১৪ কোটি টাকা এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘চট্টগ্রাম মহানগরীর বন্যা নিয়ন্ত্রণ, জলমগ্নতা/জলাবদ্ধতা নিরসন ও নিষ্কাশন উন্নয়ন’ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৮৪ কোটি টাকা।

এই ৪ হাজার ৩৩৯ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে খালের দুই পাশে প্রতিরোধদেয়াল নির্মাণ, রাস্তার নির্মাণকাজ, কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে যুক্ত খালগুলোর মুখে জলকপাট (স্লুইসগেট), খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার, ব্রিজ-কালভার্ট নির্মাণ, নতুন নালা-নর্দমা নির্মাণে। এসব কাজ হলেও প্রায় কোনোটিই পুরোপুরি শেষ হয়নি। এখনো পর্যন্ত ৪০টি জলকপাটের মধ্যে একটিও চালু হয়নি। অথচ জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের জন্য গঠিত কারিগরি কমিটি ২০১৮ সালে মত দিয়েছিল, জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের সুফল পাওয়ার জন্য ২০২০ সালের জুনের মধ্যে জলকপাটগুলোর নির্মাণকাজ সম্পন্ন করতে হবে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনও এখন পর্যন্ত নতুন খাল খননের কাজ শেষ করতে পারেনি। ফলে জলাবদ্ধতা হচ্ছে।

এই বিপুল টাকা ব্যয়ের পরেও নগরের দুই নম্বর গেট, মুরাদপুর, চান্দগাঁও আবাসিক এলাকা, আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, বাকলিয়া, চকবাজার, ডিসি রোড, শমসের পাড়া, বহদ্দারহাট, কাপাসগোলা, কাতালগঞ্জ, ফিরিঙ্গিবাজার, বারইপাড়া, পাঠানিয়াগোদা এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এমনকি জলাবদ্ধতায় সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীর বহদ্দারহাটের বাড়িতেও পানি জমে থাকে। এসব এলাকায় গোড়ালি থেকে কোমরসমান পর্যন্ত পানি এক থেকে আট ঘণ্টা পর্যন্ত জমে থাকে।

প্রচুর টাকা খরচের পরেও বারবার জলাবদ্ধতা হওয়ার কারণ জানতে চাইলে সবচেয়ে বড় প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী প্রথম আলোকে বলেন, যে টাকা খরচ হয়েছে, তা প্রকল্পের কাজেই ব্যয় হয়েছে। টাকা অপচয় হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ সুফল পাওয়া সম্ভব নয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. শাহ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে চশমা খাল, হিজড়া খাল, চাক্তাই খালসহ বিভিন্ন খালের কিছু কিছু অংশ প্রশস্ত করা যায়নি। কিছু কিছু অংশ আগের মতো সরু থেকে যাওয়ায় পানিপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে। তবে ভূমি অধিগ্রহণ কাজ সম্পন্ন হলে এবং সব কটি স্লুইসগেট চালু হলে পানি অনেক দ্রুত নেমে যাবে। বিশেষ করে মহেশ খালের মুখে স্লুইসগেট চালু হলে বৃহত্তর আগ্রাবাদ এলাকার জলাবদ্ধতা আর থাকবে না।

জানতে চাইলে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রাম নগরের জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য যত টাকা দেওয়া হয়েছে, অতীতে তা পাওয়ার স্বপ্নও দেখেনি কেউ। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, এত টাকা খরচের পরেও জলাবদ্ধতার সমস্যা কমেনি। জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে উপহাস করা হচ্ছে। কেননা প্রতিবছরই বর্ষার আগে কর্তারা জলাবদ্ধতা নিরসনের আশ্বাস দেন। কিন্তু বর্ষায় তার সুফল পাওয়া যায় না। ফলে জলাবদ্ধতায় মানুষের ক্ষয়ক্ষতি ও ভোগান্তি থেকে যাচ্ছে। জলাবদ্ধতার পর একে অপরকে দোষারোপ করে দায় এড়িয়ে যায়।