‘এখনো চোখে ভাসে সবুজ শাড়িতে মায়ের বুকে বাঁধা মৃত শিশু’

ঝড়ের দুই দিন পর বাড়ি ফিরে অবশিষ্ট আসবাব রক্ষার চেষ্টা করছে একটি পরিবার। বরগুনায় ২৭ মে ২০০৯ সালেরছবি: প্রথম আলো আর্কাইভ

ঝোড়ো বাতাস আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই ঘুড়ি ওড়াতে বের হয়েছিল ১০ বছরের ইমরান। পলিথিনের ঘুড়িটা মাত্র আকাশে উঠেছে। এর মধ্যে মাঠঘাট পেরিয়ে ভাইকে ডাকতে দৌড়ে এসেছিল ১৫ বছর বয়সী বড় বোন ইরানি। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা কয়রা ততক্ষণে ঘোর অন্ধকারে ডুবতে বসেছে। এমন গাঢ় অন্ধকার কপোতাক্ষ থেকে উঠে আসছে, না আকাশ থেকে নামছে, তা বোঝা যায় না। দুই ভাই–বোন দৌড়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শুরু হলো বাঁধে পানি আছড়ে পড়ার দানবীয় শব্দ। গ্রামের ভেতরের খাল ভরে উঠেছে। আর কয়েক মুহূর্ত মাত্র! ইমরান প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘ঘুড়ি ধরব, না দৌড়ে বাড়ি আসব, নাকি উল্টো দিকের পথে দৌড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠব—সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো বয়স হয়নি তখন। তবে নদীর পাড়ের ছেলে বলে বয়স অল্প হলেও এটুকু বুঝেছিলাম, যে ঝড় আসছে তা আমাদের বাঁচতে দেবে না।’

কাঠমারচরের বাসিন্দা শেখ আমিরুল ইসলামের পরিবারের সদস্যসংখ্যা পাঁচ। তাঁর ছোট সন্তান ইমরানের একটা শখের গরু ছিল। ওর নানা নাতিকে উপহার দিয়েছিলেন। সে গরুকে আদর করে ডাকা হতো ‘সাদা ময়না’ নামে। ২০০৯ সালের প্রলয়ংকরী ঝড়ের দিন বর্গাচাষি আমিরুল ইসলামের পরিবারের মতো কয়রার অনেক পরিবার শুধু প্রাণে বেঁচে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

আমিরুল নিজের বৃদ্ধ মাকে নিয়ে বড়বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে রওনা হলেন। আগে আগে চলেছিলেন স্ত্রী, কন্যা আর ছেলে ইমরান। কোনোমতেই শখের সেই সাদা ময়নার দড়ি ছাড়েনি ইমরান। ততক্ষণে কোথায় ভেসে গিয়েছে ইমরানের ঘুড়িটা, যেটা কিছুক্ষণ আগেও উড়েছিল কপোতাক্ষের মাথার ওপরের আকাশের বিস্তর জমিনে। বৃদ্ধা মাকে নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার সাঁকোটা কোনোমতে অতিক্রম করেছিলেন আমিরুল। পর মুহূর্তে ভেঙে তলিয়ে গেল সে সাঁকো। গ্রাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথ। এই পরিবারটি তিন মাসের বেশি সময় থেকেছে আশ্রয়কেন্দ্রে। সাদা ময়নাকে ছাড়া গৃহস্থালির কিছুই নিতে পারেনি পরিবারটি। তিন মাস পর যখন বাড়ি ফিরেছে, তখনো উঠানে পানি থই থই। শুরু হলো অভাব। সন্তানের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার আর কোনো উপায়ই ছিল না শেখ আমিরুল ইসলামের। বিক্রি করে দিতে বাধ্য হলেন সাদা ময়নাকে। মাত্র আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছিল দুধেল সেই গরু।

ঘূর্ণিঝড় আইলার পরদিন সকালে আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে মানুষ। খুলনার দাকোপ থেকে ২৬ মে ২০০৯ তোলা
ছবি: প্রথম আলো আর্কাইভ

ইমরান বলছিলেন, ‘সাদা ময়নাকে নিয়ে যাওয়ার সময় শেষবারের মতো এর গলায় বাঁধা দড়িতে হাত রেখেছিলাম। ওই ১০ বছর বয়সে মনে হয়েছিল, আমার নিজের পাঁজরের হাড় ভাঙছে।’ ইমরান এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। ১৩ বছর আগে এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলার অভিঘাত তাঁর মতো উপকূলীয় এ অঞ্চলের মানুষের জীবন থেকে কোনো দিন যায়নি। সেই দিনের ভয়াবহ আতঙ্কের স্মৃতি থেকে বের হতে পারেননি অনেকেই।

একজীবনের সমস্ত স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হলে মানুষকে প্রতি মুহূর্তে পাহাড়সমান বোঝা টানতে হতো। ভাগ্যিস স্বাভাবিক নিয়মেই মানুষ বহু বিষয় বিস্মৃত হয়ে থাকে। কিন্তু এমন দু-একটি ক্ষত থাকে, যা বহু চেষ্টা করলেও বিস্মৃত হওয়া যায় না। উপকূলীয় এলাকায় বড় ঝড়গুলো এখানকার মানুষের তেমন ক্ষত। দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারা গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন লিটন এখন পেশায় মোটরসাইকেলচালক। সুন্দরবনঘেঁষা গ্রামটিকে দিনরাত জোয়ার ভাটায় টানে আড়পাঙ্গাশিয়া নদী। ইউনিয়ন পরিষদের উল্টো দিকে কিছুটা এগোলেই লিটনদের পাকা বাড়ি। ওই এলাকার হাতে গোনা পুরোনো দু-একটা বাড়ির মধ্যে এ বাড়ি একটি। লিটন বলছিলেন, সেদিনের ঝড়ে তাঁদের উঁচু বাড়ির চৌহদ্দিতে পানি উঠতে শুরু করল। প্রায় বুকসমান পানি উঠে গেল মুহূর্তে। কিছুই করতে না পেরে পরিবারের সবাই শাড়ি, গামছা নিয়ে উঠে গেল উঁচু গাছে। সেখানে বেঁধে রাখেন নিজেদের। দুই দিন পর তাঁরা নেমেছিলেন গাছ থেকে।

এ দুদিন বৃষ্টির পানি খাওয়া ছাড়া আর কিছু মুখে দেওয়ার ভাবনাও আসেনি। প্রতি মুহূর্তে ভয় ছিল, পরিবারের ছোট শিশুরা না পিছলে পানিতে পড়ে যায়। এমন স্রোতের ভেতর থেকে তাঁদের উদ্ধার করাও সম্ভব হবে না। এর মধ্যে তাঁরা দেখেছে, পানিতে ভেসে গেছে অনেকের মরদেহ। কোনো মুখ হয়তো তাঁদের খুব চেনা। সবুজ শাড়িতে মায়ের বুকের সঙ্গে বাঁধা ছিল এক শিশু। মা আর সন্তান দুজনেই মৃত। গাছের ডালে বসে সে দৃশ্য দেখতে দেখতে আর্তনাদ করেছেন লিটনদের মতো অনেকেই। ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় আইলার অভিজ্ঞতার কথা প্রথম আলোকে বলছিলেন লিটন। অভিযোগ করলেন, সরকারি হিসেবে মৃতের সংখ্যা নিয়ে। তাঁদের ভাষ্যে, তাঁরাই গাছের ডালে বসে ৩০টির বেশি মরদেহ ভেসে যেতে দেখেছেন। কিন্তু সরকারি হিসেবে কয়েকজনের কথা বলা হয়েছে।

কয়রার কাঠমারচরে একই জনপদে আঘাত আনে ঘূর্ণিঝড় আম্পান
ছবি: সংগৃহীত

লিটনদের বাড়ির কাছাকাছি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন। আংটিহারা গ্রামের গ্রাম পুলিশ সইজুল ইসলাম সে ঝড়ের রাতে পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন পরিষদের ভবনে। প্রথম আলোকে জানালেন, তিন বছর তাঁরা আর বাড়ি ফিরতে পারেননি। এই দীর্ঘ সময় পরিবারটির কেটেছে আশ্রয়কেন্দ্রে। সইজুল ইসলাম আর লিটনের সঙ্গে কথা বলতে বলতে গ্রামের সর্বশেষ সীমানায় চলে যেতে হয়। লক্ষ্য ছিল, কার্তিক প্রামাণিক নামের একজনকে খুঁজে বের করা। ঝড়ের রাতে তিনিও পরিবারসহ গিয়েছিলেন ওই আশ্রয়কেন্দ্রে। বহু খুঁজে জানা গেল, এ গ্রামে একই নামে দুজন ছিলেন। তাঁদের একজনের ঝড়ের পর আর ফেরার কোনো জায়গা ছিল না। তাঁরা যেন কোথায় চলে গিয়েছেন। তাঁদের খবর আর কেউ জানেন না। সইজুল বলছিলেন, দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারার এমন অনেক পরিবার আছে, আইলা ঝড়ের পর আর তাদের কখনো দেখা যায়নি। একসময় যে উঠানে ফসল বা বনের কাঠ রোদে দেওয়া হতো, সে উঠান এখন নদীর বুকের ভেতর। যেমন হারিয়ে গেছে সে বসতির চিহ্ন, তেমনি জনসংখ্যার ভেতর মিশে হারিয়ে গেছে সুন্দরবনঘেঁষা দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলের অনেক মানুষ। তাঁরা আর কখনো ফিরতে পারেননি নিজের জন্মস্থানে।

দক্ষিণ বেদকাশির আংটিহারায় মোয়াজ্জেম হোসেনদের এ বাড়ির ছাদ পর্যন্ত উঠেছিল জলোচ্ছ্বাসের পানি
ছবি: প্রথম আলো

বাগেরহাট সদরের পিটিআই মসজিদের মুয়াজ্জিন মফিজুল ইসলামদের বাড়ি ছিল দাকোপের কালাবগীর দুয়ানিরঘাটের কাছে। ঝড়ের রাতে তাঁদের সব টেনে নিয়েছে শিবসা আর সুতারখালী নদী। সামান্য কোনো চিহ্ন নেই সে বাড়ির। ২০০৯ সালের আইলায় সব হারানোর এক যুগ পর মফিজুল শিশুসন্তানকে নিয়ে গিয়েছিলেন নিজের শৈশবের গ্রাম দেখাতে। মফিজুলের কাছে নদীর পানির ভেতরও অবয়ব পেয়েছে সেই পুরোনো উঠান, ঘরের পাশে বাঁধা লাল গরু বা মায়ের মেলে দেওয়া শাড়ির দৃশ্য। একসময় এসব কিছুই সত্যি ছিল তাঁর জীবনে। শিশুসন্তানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে তিনি যখন বলছিলেন, ওই যে ওখানে ছিল আমাদের বড় ঘর, তখন তাঁর ছেলে নুসাইদ বলেছে পানি, পানি। সত্যি হচ্ছে, এখন সেখানে শুধু শিবসা আর সুতারখালীর অথই পানি।

এই কালাবগির শামিনুর রহমান ছিলেন কয়রার ইমরানের মতো ছোট একটা ছেলে। আইলার স্মৃতিচারণা করে শামিনুর বললেন, সেদিন দুপুরে বাড়ির সবাই মিলে ভাত খেতে বসেছিলেন। তাঁদের খাওয়া শেষ হলেই মা বসবেন ভাত খেতে। ঠিক তখন এক নিমেষে ভেসে গেল সবকিছু। শামিনুরের বাবা পেশায় জেলে। একটা মাছ ধরার নৌকা ছিল। প্রথমে সে নৌকায় আশ্রয় নেয় পুরো পরিবার। কোনোমতে প্রাণে বাঁচতে এরপর তাঁরা আশ্রয় নিতে পেরেছিল কাছাকাছি এক উঁচু বাড়িতে। সারা রাত চলে বৃষ্টি। সকালে একটু ধরে এলে সাঁতরে বাড়ি এসে দেখেছিলেন, ঘরবাড়ির কোনো চিহ্নই নেই। পুরোপুরি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল পরিবারটি। ছোট্ট সেই শামিনুরের খুব কষ্ট হয়েছিল পড়ার বইখাতাগুলো ভেসে যাওয়ায়। ওর শখের বিড়ালটিকে আর কোনো দিন খুঁজে পাওয়া যায়নি। শামিনুর এখন কালাবগি গ্রামের একজন তরুণ স্বেচ্ছাসেবী।

দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের এই ভবনে তিন বছরের বেশি সময় থাকতে হয়েছে আশ্রয় নেওয়া অনেক পরিবারকে
ছবি: প্রথম আলো

২০০৯ সালের ২৫ মে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আয়লা। যার প্রভাবে পুরো উপকূলীয় এলাকা প্লাবিত হয়। খুলনা আর সাতক্ষীরার ৭১১ কিলোমিটার বাঁধ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কয়রা আর দাকোপ অঞ্চলের বহু মানুষ আর কোনো দিন ফিরতে পারেননি তাঁদের জন্মভূমিতে। ১৩ বছর আগের এই দিনের সেই ভয়ংকর ঝড়ের পর আঘাত এনেছে বুলবুল, ফণী, আম্পান, অশনি। এক যুগের বেশি সময় আগে আইলার সে আঘাতের ক্ষত ভুলতে পারেননি ইমরান, সইজুল, লিটন বা শামিনুররা। শামিনুর লিখেছেন, এখন পর্যন্ত তাঁর জীবনে ঘটে যাওয়া সবচেয়ে ভয়ানক বীভৎস ঘটনা আইলা।