এত্ত এত্ত পড়ার চাপে খেলার সুযোগ নেই

এভাবে খেলার মতো সময় নেই আজকের শিশুদের। ছবি: জগলুল পাশা
এভাবে খেলার মতো সময় নেই আজকের শিশুদের। ছবি: জগলুল পাশা

ভোর সাড়ে ছয়টা থেকে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া জামিল হোসেনের দিন শুরু। সকাল ৮টা ৫০ মিনিট থেকে স্কুল শুরু হয়ে শেষ হয় বেলা ১টা ৪০ মিনিটে। শুক্রবারসহ সপ্তাহে চার দিন কোচিং। শুক্রবার ছাড়া অন্য দিন স্কুল থেকেই যেতে হয় কোচিংয়ে। তারপর বাসায় ফেরা। আর কোচিং না থাকলে বেলা দুইটার সময় বাসায় ফিরে গোসল, খাওয়া শেষ করে ল্যাপটপ বা মোবাইলে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর সুযোগ পায়। তারপরই বসতে হয় স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে। সন্ধ্যা সাতটায় গৃহশিক্ষকের কাছে পড়া শুরু, চলে রাত নয়টা পর্যন্ত। গৃহশিক্ষক আসেন সপ্তাহে ছয় দিন। পড়া শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে আবার ল্যাপটপ, টেলিভিশন বা মোবাইল নিয়ে বসা। তারপর রাত সাড়ে ১১টার মধ্যে ঘুম।
জামিল ময়মনসিংহের একটি স্কুলে পড়ছে। স্কুলে বড় একটি মাঠ আছে। টিফিনের সময় বা স্কুল থেকে আনার জন্য ভাড়া করা রিকশা যেতে দেরি হলে তখন মেলে ক্রিকেট খেলা বা একটু দৌড়ানোর সুযোগ। তাতে কি আর মন ভরে?
অন্যদিকে, রাজধানীর শিশুদের তো ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। বেশির ভাগ স্কুলে মাঠ বা খোলা জায়গা না থাকায় স্কুলে গিয়েও চার দেয়ালে বন্দী। রাস্তার গাড়ির হর্ন, জ্যাম, ধুলায় ক্লান্ত হয়ে পড়ে শিশু। আর যাদের পড়াশোনার বাইরে গান, নাচ বা অন্য কোনো প্রতিযোগিতায় নামতে হয়, তাদের ছুটির দিনগুলোও নিমেষেই উধাও। এর বাইরে বাড়িতে গৃহশিক্ষক ও ধর্মীয় শিক্ষক তো আছেই।
শ্রমজীবী শিশু, পথশিশু, দলিত শিশুসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া শিশুদের ছোট মাথায় পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়। প্রতিবন্ধী শিশুদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাদের কাছে বিনোদন বা অবসর বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।
দেশের শিশুদের রোজনামচায় বিশ্রাম, অবকাশযাপন, বিনোদন এবং সাংস্কৃতিক ও শিল্পচর্চা কার্যক্রম না থাকায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটি। কমিটি গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি) বাস্তবায়ন নিয়ে বাংলাদেশের পঞ্চম নিয়মিত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে যে সমাপনী পর্যবেক্ষণ দেয়, তাতেই এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। কমিটি এর আগেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
শিশুরা চায় বিনোদন: তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি যৌথ প্রকল্পের আওতায় ‘শিশু মতামত জরিপ ২০১৩: বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কাছে শিশুদের প্রত্যাশা’ শীর্ষক জরিপ পরিচালিত হয়।
মাঠপর্যায়ে ৪ হাজার ২০০ শিশুর মধ্যে শহরের শিশু ছিল ১ হাজার ৪০০ এবং গ্রামের শিশু ২ হাজার ৮০০। অনলাইনে চালানো জরিপে ৩৩৩ জন শিশু অংশ নেয়। ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে দুই ধরনের জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের গড় বয়স ছিল ১৪ বছর।
জরিপে অংশ নেওয়া শিশুরা এমন একটি পার্ক তৈরি করতে বলে, যেখানে ঢুকতে গেলে কোনো টাকা লাগবে না। জরিপে ৮৩ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা চায় এলাকায় একটি খেলার মাঠ তৈরি করে দেওয়া হোক। ৭৩ শতাংশ শিশু বলেছে, তারা চায় এলাকায় সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে উঠুক। ৭৬ শতাংশ শিশু বলেছে, এলাকায় শিশুপার্ক গড়ে তোলা হোক। ৬৭ শতাংশ শরীরচর্চাকেন্দ্র, ৩ শতাংশ পাঠাগার ও ২ শতাংশ চিড়িয়াখানা গড়ে তোলার কথা বলেছে।
চলতি বছরের মার্চ মাসে খুলনায় ‘‌স্কুলগুলোয় খেলার মাঠ নেই কেন? মেয়েদের জন্য আলাদা খেলার মাঠ নেই কেন?’—এ প্রশ্নগুলো শিশুরা ছুড়ে দেয় প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দিকে।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমী খুলনায় অনুষ্ঠিত ‘শিশুদের মুখোমুখি-২০১৫’ অনুষ্ঠানে এসব প্রশ্ন করে শিশুরা। ন্যাশনাল চিলড্রেনস টাস্কফোর্স (এনসিটিএফ) খুলনা এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন খেলাধুলা করা। ছবি: জগলুল পাশা
শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশের জন্য প্রয়োজন খেলাধুলা করা। ছবি: জগলুল পাশা

যান্ত্রিক বিনোদনের প্রভাব: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সহায়তায় পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ২০১২ সালে ঢাকা শহরে একটি জরিপ চালায়। এতে ঢাকার জনগণের অবসর কাটানো প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ৮৯ দশমিক ২ শতাংশই টেলিভিশন দেখে। ২২ শতাংশ জাদুঘর, চিড়িয়াখানা ও পার্কে ঘুরতে যায়। ১২ দশমিক ৩ শতাংশ শিশুপার্কে যায়। ঘরের বাইরে গিয়ে খেলাধুলা করে ২ দশমিক ১ শতাংশ। ৯ দশমিক ৪ শতাংশ ভিডিও গেম বা কম্পিউটারে সময় কাটায়।
চলতি বছরে পিপিআরসি চট্টগ্রামে জরিপ চালায়। এতে দেখা যায় ৮৮ দশমিক ৯ শতাংশ টেলিভিশন দেখে অবসর কাটায়।
পিপিআরসির দুটি জরিপে শিশুদের বিষয়টি আলাদাভাবে দেখানো হয়নি। তবে শিশু অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনের কর্মরতরা বলছেন, বর্তমানে শিশুরাও টেলিভিশন দেখে ও যান্ত্রিক বিনোদনের মধ্য দিয়েই বড় হচ্ছে।
২০০৭ সালে ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েটেড উইথ ওভারওয়েট অ্যান্ড ওবেসিটি অ্যামাং আরবান স্কুল চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস ইন বাংলাদেশ: আ কেস কন্ট্রোল স্টাডি’ শীর্ষক গবেষণায় ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও সিদ্ধেশ্বরীর নামকরা সাতটি স্কুলের শিশুদের ওপর জরিপ চালানো হয়। দেখা গেছে, এসব স্কুলের শিশুরা দিনে চার ঘণ্টা পর্যন্ত টেলিভিশন দেখছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বলছে, ৫ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের দিনে অন্ততপক্ষে ৬০ মিনিট খেলাধুলা বা অন্যান্য শারীরিক কসরত করতে হবে।
ওয়ার্ক ফর আ বেটার বাংলাদেশের (ডব্লিউবিবি ট্রাস্ট) ২০০৭ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত ‘টেলিভিশনের নেতিবাচক প্রভাব ও আমাদের শিশু’ শীর্ষক গবেষণায় বলা হয়েছে, ৪৮ শতাংশ শিশুর অবসর কাটে টেলিভিশন দেখে। অভিভাবকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৩ শতাংশ শিশু দিনে গড়ে চার ঘণ্টা বা এর বেশি সময় টেলিভিশন দেখে। ৬৭ শতাংশ শিশুর বাড়ির কাছাকাছি খেলাধুলার কোনো সুযোগ নেই। ২৯ শতাংশই জানায়, তারা কোনো ধরনের খেলাধুলা করে না। এ গবেষণায় ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন স্কুলের ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী শিশুদের কাছ থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়।
যান্ত্রিক বিনোদনের প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ‌শিশু-কিশোরদের পরিবেশ, জীবনচর্চা ও রোগ সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর দুটি সরকারি এবং দুটি বেসরকারি স্কুলের ১ হাজার ৪৫৭ জন শিক্ষার্থীর ওপর সমীক্ষা চালানো হয়। এই শিশুদের বয়স ছিল ৭ থেকে ১৫ বছর। এতে দেখা যায়, সময়মতো খাবার খায় না ৭৪ শতাংশ শিশু। শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করে না ৫৯ শতাংশ। একাকী থাকতে চায় শূন্য ৮ শতাংশ। মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করে না ১৮ শতাংশ। মা-বাবার মতে সন্তানের ওজন কম বা বেশি ৩৩ শতাংশ শিশুর। রোগাক্রান্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০ শতাংশ।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু-কিশোর ও পারিবারিক মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘‌আমার কাছে সাত থেকে আট বছর বয়সী এক শিশুকে অভিভাবকেরা নিয়ে আসেন। শিশুর সমস্যা মন খারাপ। কম কথা বলে। মা-বাবা কর্মজীবী। স্কুলের পরে ও সারা দিন বাসায় গৃহকর্মীর সঙ্গে থাকে। কী করতে তোমার ভালো লাগে এ প্রশ্নের উত্তরে শিশুটি জানায়, ওরা যে ভবনে থাকে, তা অনেক উঁচু। বাসার বারান্দা থেকে নিচে তাকিয়ে মানুষ দেখতে তার ভালো লাগে। তার কাছে এটিই বিনোদন।’
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শিশুদের বিনোদনের পথ সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। শিশুরা টেলিভিশন দেখে, কিন্তু তাতে শিশুতোষ অনুষ্ঠান নেই। ভিডিও গেমস বেশির ভাগই শিশুবান্ধব না। এ ধরনের বিনোদনে শিশুর সামাজিক দক্ষতা কমে যাচ্ছে।
শিশু মনোবিজ্ঞানী মনোয়ারা পারভীন জাহাঙ্গীরী প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমানে বিনোদন ও অবসরের অভাব এবং পড়াশোনার চাপে শিশুদের আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা দেখা যাচ্ছে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক শিশুকে অভিভাবক নিয়ে আসেন। তার পড়া মুখস্থ থাকছে না। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত খুব ভালো ফল তার। জীবনটা এঁকে দেখাতে বললে শিশুটি ছবি আঁকে। ছবিতে সে প্রথমে প্রাইজ নিচ্ছে, চেক নিচ্ছে। এ ছাড়া আর কিছু নেই। তার জীবনে বিনোদনের কোনো জায়গা নেই।
সরকারি পর্যায়ের উদ্যোগ: সরকারের জাতীয় শিশুনীতিতে খেলাধুলা, শারীরিক ব্যায়াম, সাংস্কৃতিক, বিনোদন ও অবকাশযাপনে সবার সমান সুযোগের বিধান রাখা হয়েছে। এটি শুধু কাগুজে বিধান হিসেবেই বিবেচ্য।
মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের শিশু একাডেমী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান, যারা শিশুর মানসিক, শারীরিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ নিয়ে কাজ করছে। একাডেমীর কার্যক্রম ৬৪ জেলা এবং মাত্র ছয়টি উপজেলায় পরিচালিত হচ্ছে। তৃণমূলের বিরাট একটি অংশ একাডেমীর কার্যক্রমের আওতার বাইরে রয়ে গেছে। তবে ৫০টির বেশি বিষয়ে একাডেমী জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। তাতে থানা পর্যায় থেকে শিশুরা অংশ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আসে। প্রতিযোগিতার চাপে তা আর শিশুদের কাছে বিনোদন থাকে না বলেই সংশ্লিষ্টদের অভিমত।
শিশু একাডেমীর গ্রন্থাগার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজিনা আখতার বলেন, একাডেমীর কার্যক্রমে অংশ নেওয়া শিশুদের প্রায় ৮০ শতাংশ অভিভাবকই সন্তান গান, নাচ না অন্য কোনো বিষয় শিখতে আগ্রহী, তা নিয়ে মাথা ঘামান না। তাঁরা তাঁদের নিজেদের মতামত চাপিয়ে দেন। সন্তান ছবি আঁকতে পছন্দ করে, কিন্তু তাকে গান বা নাচে ভর্তি করে দিয়েছেন অভিভাবক। রাজধানীতে একাডেমীর কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে বর্তমানে চার হাজার শিশু-কিশোর তাদের মনমতো বই পড়ার সুযোগ পাচ্ছে।
করণীয়: নগর উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামীণ শিশুরা এখন পর্যন্ত তবু কিছুটা নিজেদের মতো করে বিনোদনের পথ খুঁজে নিতে পারে। শহুরে শিশুদের সে সুযোগ নেই। শহরে শিশুপার্ক, খোলা জায়গা বা বিনোদনের জায়গার অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ নেই। পাড়া-মহল্লায় শিশুদের বিনোদনের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। বিষয়টি উদ্বেগের বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এ বিষয়ে যথেষ্ট গবেষণারও ঘাটতি রয়েছে।
জাতিসংঘের শিশু অধিকার কমিটি সমাপনী পর্যবেক্ষণে বাড়ি, শিশুদের সংগঠন, বিদ্যালয় ও উন্মুক্ত স্থানে শিশুদের খেলতে এবং স্ব-সংগঠিত কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত ও সহায়তা করে—এমন উদ্যোগে পর্যাপ্ত অর্থ, কারিগরি ও মানবসম্পদ বরাদ্দ করতে সরকারকে সুপারিশ করেছে।
হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মা-বাবা শিশুকে যতটুকু সময় দেবেন, সেটার পুরো মনোযোগ শিশুটিকেই দিতে হবে।