এত গরু, তবু মাংসের দাম যে কারণে বেশি
২০১৪ সালের আগপর্যন্ত ঈদুল আজহায় ভারতীয় গরু দিয়েই চাহিদার ৮০ শতাংশ মেটানো হতো। ওই বছর থেকে ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়ার পর আশঙ্কা করা হয়েছিল, কোরবানিতে বড় সংকট তৈরি হবে। তবে মাত্র দুই বছরেই দেশি গরু দিয়েই ঈদে সক্ষমতা অর্জন করেছে দেশ। এর পেছনে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি উদ্যোক্তারা বড় ভূমিকা রেখেছেন বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। তাঁদের ভাষায়, আমদানি বন্ধের প্রতিস্থাপক হিসেবে কাজ করেছেন এই উদ্যোক্তারা। তবে সক্ষমতা বাড়লেও দাম কমছে না কেন—এমন প্রশ্নের জবাবে অর্থনীতিবিদ ও খামারিরা বলেছেন, গরু লালন–পালন, পরিচর্যা ব্যয়; বিশেষ করে গরুর খাবারের ব্যয় বেশি হওয়ায় গরুর দাম এখনো অনেক বেশি।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গবাদিপশু গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়ার মোট সংখ্যার অর্ধেকসংখ্যক কোরবানির জন্য ব্যবহৃত হয়। এ বছর কোরবানির লক্ষ্যে ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি গবাদিপশু রয়েছে। এগুলোর মধ্যে গরু ৪৩ লাখ ৭৪ হাজার ৭৯৪টি। তবে এই হিসাবের বাইরে আরও ৫–৬ লাখ গরু কোরবানির জন্য যোগ হতে পারে।
ভারতীয় গরু শুধু চাষের জন্য উৎপাদিত হয়। ফলে তাদের গরু পালনে খরচ অনেক কম। বাংলাদেশে গরু পালা হয় বাণিজ্যিকভাবে। গো–খাবার আমদানি করতে হয়। ফলে পরিচর্যা ব্যয় অনেক বেশি হয় এবং মাংসের দাম বেশি পড়ে। এখন প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০ টাকা বিক্রি হয়।
গরু নিয়ে দেশের সক্ষমতা বাড়ার বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত দিয়ে গরু আনা আগেও অবৈধ ছিল। ভারতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ২০১৪ সাল থেকে গরু আনার বিষয়টিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় দেশের বাজারে দেশীয় গরুর আধিপত্য বেড়েছে। খামারি বা উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। আগের খামারিদের ব্যবসার পরিসর বিস্তৃত হয়েছে। ক্ষুদ্র খামারিরা মাঝারিতে, আর মাঝারি খামারিরা বড় খামারিতে পরিণত হয়েছেন। এভাবে দেশের খামারিরা ভারত ও মিয়ানমার থেকে গরু আমদানির ক্ষেত্রে বড় প্রতিস্থাপক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। গরু নিয়ে সক্ষমতা বাড়ার পেছনে এই খামারিদের বড় ভূমিকা রয়েছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ঈদুল আজহায় গবাদিপশুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোরবানি হয় গরু। দেশে উৎপাদিত গরু দিয়ে চার বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে ৫১ লাখের বেশি গরু কোরবানি হয়েছে। ২০১৭ সালে ১ কোটি ৪ লাখ গরু, ছাগল, মহিষ, ভেড়ার সঙ্গে হাজারখানেক দুম্বা, উট ও গয়াল কোরবানি হয়েছে। এগুলোর মধ্যে গরু ছিল ৪৪ লাখ ৭৩ হাজার। ২০১৮ সালে ১ কোটি ৫ লাখ পশু কোরবানির মধ্যে গরু ছিল ৫৩ লাখ ৯১ হাজার। ২০১৯ সালে ১ কোটি ৬ লাখ কোরবানির মধ্যে গরু ছিল ৫৬ লাখ ৫৯ হাজার। ২০২০ সালে করোনাকালে কোরবানির সংখ্যা কমে যায়। ওই বছর ৯৪ লাখ ৫০ হাজার কোরবানির মধ্যে গরু ছিল ৪৯ লাখ ৯৬ লাখ।
বাংলাদেশ ডেইরি ফার্মারস অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) তথ্য অনুসারে, ২০১৪ সালের আগপর্যন্ত সীমান্ত দিয়ে বছরে এক কোটির বেশি ভারতীয় গরু প্রবেশ করত। এগুলোর মধ্যে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৪০ লাখের মতো গরু ঈদুল আজহায় কোরবানি দেওয়া হতো। এ বছর এ পর্যন্ত ৫/৭ হাজার ভারতীয় গরু অবৈধভাবে আনা হয়েছে। তবে দেশীয় খামারিদের রক্ষায় সরকার এ মাসে কড়াকড়ি আরোপ করায় কোরবানির জন্য বাজারে কোনো ভারতীয় ও মিয়ানমারের গরু নেই।
কোরবানিতে ভারতীয় গরু বন্ধ, দেশি গরুর আধিপত্য যেভাবে
ভারতীয় গরু আসা বন্ধের পরের পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৬ সালে সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম একটি গবেষণা করেন। এর শিরোনাম ছিল ‘বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক গরু বাণিজ্যের অর্থনীতি: পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের চিত্র’। ওই গবেষণায় বলা হয়, ২০১৪ সালের আগপর্যন্ত ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে গরু আমদানি হতো।
ভারত থেকে গরু আসা বন্ধ হওয়ায় দেশের বাজারে দেশীয় গরুর আধিপত্য বেড়েছে। খামারি বা উদ্যোক্তার সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপকভাবে। আগের খামারিদের ব্যবসার পরিসর বিস্তৃত হয়েছে। ক্ষুদ্র খামারিরা মাঝারিতে, আর মাঝারি খামারিরা বড় খামারিতে পরিণত হয়েছেন।
বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে একটি আধা আনুষ্ঠানিক কাঠামো মেনে চলত। ভারতের সীমান্তে গরুগুলো জড়ো করা হতো ‘কোনো মালিক বা দাবিদার নেই’ উল্লেখ করে। বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী সেগুলো সংগ্রহ করত এবং গরু ব্যবসায়ীদের মধ্যে নিলামে তুলত। বাজারে বছরে এসব গরুর আর্ধিক মূল্য ছিল ৫০ কোটি মার্কিন ডলার।
ওই গবেষণায় আরও বলা হয়, ভারত থেকে আসা গরু বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হতো ৭৭ শতাংশ বেশি দামে। ভারতের হরিয়ানা রাজ্য ছিল গরুর মূল উৎস। সেখানে বয়স্ক গরু ৫০০ রুপি থেকে শুরু করে আকৃতি অনুসারে তিন হাজার রুপিতে বিক্রি হতো। ভারতীয় গরু ব্যবসায়ীরা গড়ে সেসব বিক্রি করত ২৩ শতাংশ বেশি দামে। ওই সব গরু বাংলাদেশে বিক্রি হতো ২০ থেকে ৪০ হাজার রুপিতে। হরিয়ানা ছাড়াও রাজস্থান, পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ ও বিহার ছিল অন্যতম উৎস। এখন সেসব রাজ্যে গরু বিক্রি ও জবাই নিষিদ্ধ।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, গরু আসা নিষিদ্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার দেশে গবাদিপশুর বাজার বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে বিবেচনা করতে শুরু করে। এক বছরের মধ্যে গবাদিপশু উন্নয়নে প্রকল্প নেয়। খামারি তৈরিতে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়া ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেয়। এই সময়ে বিপুলসংখ্যক বেসরকারি উদ্যোক্তা তৈরি হয়। এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এখন বড় ব্যবসায়ীরাও বিনিয়োগ করছেন এ খাতে। তিনি বলেন, ‘ভারতীয় গরু বন্ধ হওয়ায় দেশে গরুর বাজার নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল, তা এখন নেই। আগে সারা বছরে গরুর চাহিদা ও জোগানের ঘাটতি ছিল। এখন ঘাটতি থেকে আমরা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর কাছাকাছি যেতে পেরেছি।’
এ বিষয়ে বিডিএফএর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ইমরান হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৪ সালে ভারত থেকে গরু আসা নিষিদ্ধ হলেও তা সঙ্গে সঙ্গে বাস্তবায়িত হয়নি। ওই বছরও ৯০ লাখের মতো গরু এসেছে। ক্রমান্বয়ে তা কমতে কমতে কয়েক হাজারে এসে ঠেকেছে। ভারতীয় গরু আসা বন্ধ হওয়া বাংলাদেশের জন্য শাপে বর হয়েছে। ২০১৪ সালে দেশে খামারির সংখ্যা ছিল ৫০–৬০ হাজার। এখন তা বেড়ে সাড়ে তিন লাখ হয়েছে (যাদের অন্তত ১০টি গরু আছে)।
এদিকে গরুর দাম না কমার কারণ সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ভারতীয় গরু শুধু চাষের জন্য উৎপাদিত হয়। ফলে তাদের গরু পালনে খরচ অনেক কম। বাংলাদেশে গরু পালা হয় বাণিজ্যিকভাবে। গো–খাবার আমদানি করতে হয়। ফলে পরিচর্যা ব্যয় অনেক বেশি হয় এবং মাংসের দাম বেশি পড়ে। এখন প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬০০ টাকা বিক্রি হয়।
ইমরান হোসেন বলেন, ‘অন্যান্য দেশে গরুকে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় তৈরি বিকল্প খাদ্য দেওয়া হয়। এর দাম কম। আমাদের এখনো গতানুগতিক পদ্ধতিতে ভুষি খাওয়ানো হয়। এতে দাম বেশি পড়ে। এ ছাড়া দেশে গরু পালনের ৮৫ শতাংশ এখনো প্রান্তিক চাষিদের হাতে। এ খাতকে শিল্প আকারে বড় বড় খামারে রূপ দেওয়া হলে গরুর দাম কমে আসবে। এর জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
রাজধানীর কল্যাণপুরের ১১ নম্বর রোডের বাসিন্দা আমির মোহাম্মদ খান এবার গাবতলী থেকে ৮৮ হাজার টাকা দিয়ে মাঝারি আকৃতির একটি গরু কিনেছেন। তাঁর মতে, দাম অনেক বেশি। বাজেটের মধ্যে থাকা যায় না।
৬০ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য:
গত বছরের মতো এবারও করোনা কোরবানির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এরপরও গবাদিপশু আশানুরূপ বিক্রির আশা করছেন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (খামার) জিনাত সুলতানা। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘সরকারের নানামুখী উদ্যোগে দেশ গবাদিপশুতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এ খাত লাভজনক হওয়ায় শিক্ষিত তরুণেরাও এতে এখন যুক্ত হচ্ছেন। এবার ১ কোটি ১৯ লাখ গবাদিপশু কোরবানির জন্য প্রস্তত করা হয়েছে। এ পরিমাণ বিক্রি হলে ৬০ হাজার কোটি টাকা বিক্রির আশা করতে পারি।’ তিনি জানান, ২০১৭ সালে ৪২ হাজার ৬৫ কোটি, ২০১৮ সালে ৫২ হাজার ২০০ কোটি, ২০১৯ সালে ৫৭ হাজার ৮৯৮ কোটি এবং ২০২০ সালে ৫১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকার গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে।
বগুড়া ভান্ডার অ্যাগ্রো ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা তৌহিদ পারভেজ বিপ্লব প্রথম আলোকে বলেন, কোরবানি সামনে রেখে তিনি গত তিন মাসে ২৪০টি গরু বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে ২০০টি বিক্রি করেছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। সবচেয়ে কম দামে ৫৪ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন ১৪৫ কেজি ওজনের গরু। আর সবচেয়ে বেশি দামে হলিস্টিন ফ্রিজিয়ান জাতের ১১ শ কেজি ওজনের গরু বিক্রি করেছেন ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায়।