এন্ডোমেট্রিওসিস নিয়ে আতঙ্কিত নয়, সচেতন হোন

‘এন্ডোমেট্রিওসিস থামাও’ স্লোগান নিয়ে শুরু হয়েছে এন্ডোমেট্রিওসিস সচেতনতা মাস, মার্চ ২০২২। এ উপলক্ষে এন্ডোমেট্রিওসিস এডিনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ ও নুভিস্তা ফার্মা ২৮ ফেব্রুয়ারি অনলাইনে আয়োজন করে স্বাস্থ্যবিষয়ক আলোচনা অনুষ্ঠান, যা প্রথম আলোর ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচারিত হয়।

অধ্যাপক ডা. টি এ চৌধুরী

উপদেষ্টা, এন্ডোমেট্রিওসিস অ্যান্ড এডিনোমায়োসিস সোসাইটি অব বাংলাদেশ

আমাদের ধারণা ছিল মধ্যবয়সী নারীদের অথবা যাদের দীর্ঘদিন বাচ্চা হয় না, তাদের এন্ডোমেট্রিওসিস হয়। আসলে এটি কিশোরী বয়স থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সে হতে পারে। এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্য যে ব্যথা হয়, তা আসলে যায় না। ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ব্যথা তীব্র হলে মেয়েরা স্কুল কামাই করে। কাজকর্ম থেকে বিরতি নেয়। পেটে স্যাঁক নেয়। অনেক ক্ষেত্রে পেটের চামড়া পুড়িয়ে ফেলে। শুরুতেই এটির সঠিক ডায়াগনসিস হলে কষ্ট কম হয়। সে জন্য মেয়েদের সবাইকে সচেতন করতে হবে। তার জন্য প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল অথবা কলেজের মেয়েদেরকে সচেতন করতে হবে। শিক্ষকদের সহযোগিতা নিয়ে তাঁদের সঙ্গে বসতে পারি। কোথায় চিকিৎসা পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে, তা জানাতে হবে। বোঝাতে হবে এন্ডোমেট্রিওসিস এমন একটি রোগ, যা সচেতনতার মাধ্যমে প্রতিরোধ করা সম্ভব।

জাতীয় অধ্যাপক ডা. শাহলা খাতুন

উপদেষ্টা, এন্ডোমেট্রিওসিস অ্যান্ড

এডি সোসাইটি অব বাংলাদেশ

এন্ডোমেট্রিওসিস আসলে এমন একটি রোগ, যা কিনা নীরব ঘাতক ব্যাধি। এটি হলে বোঝা যায় না। এর উপসর্গগুলো একবারেই ব্যতিক্রম। যে সম্পর্কে আমরা এখনো পুরোপুরি জানি না। অনেকের ক্ষেত্রে এটি বংশগত হতে পারে। অনেক সময় এ রোগ হলে মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হতো না। কারণ, ধারণা করা হতো সে মা হতে পারবে না। প্রচলিত এই ধরনের ভুল ধ্যানধারণার কারণে মেয়েটির শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্ট হতো বেশি।

চিকিৎসার মাধ্যমে আমরা এই রোগ কমিয়ে রাখতে পারি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আক্রান্তদের সন্তান হয়, তবে ৩০ শতাংশের ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হতে পারে। এই রোগ শতভাগ নিরাময় হয় না ঠিকই, তবে তা চিকিৎসা দিয়ে কমিয়ে রাখা যায়। এ রোগ থেকে রক্ষা পেতে হেলথ ওয়ার্কারদের শিক্ষিত করতে হবে, চিকিৎসকদের সচেতন হতে হবে। মেয়েদের শিক্ষিত করতে হবে। পরিবারকে সচেতন করতে হবে।

অধ্যাপক ডা. সামিনা চৌধুরী

সভাপতি, ইএসবি

এন্ডোমেট্রিওসিস একটি বিশেষ স্ত্রীরোগ। আগে এ রোগ ছিল ১০ জনে ১ জন, এখন সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৫ জনে ১ জন। এর থেকে কোনো দেশই মুক্ত নয়। বাংলাদেশে যেমন আছে, তেমনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আছে। এ রোগ শরীরের যেকোনো জায়গায় হতে পারে। কাজেই এ রোগ সম্পর্কে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। মাসিকের সময় মেয়েদের তলপেটে ব্যথা হয়। সামান্য ব্যথা হাওয়া স্বাভাবিক, তবে তীব্র হলে চিন্তার কারণ। বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি ১২ লাখ নারীর এই এন্ডোমেট্রিওসিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। কিশোরী বয়স থেকে শুরু করে যেকোনো বয়সে এটি হতে পারে। অবশ্যই এই রোগ মাসিকের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। জরায়ুর ভেতর একটি স্তর আছে, যেটাকে আমরা এন্ডোমেট্রিওসিস বলি। রোগটি মাসের পর মাস বাড়তেই থাকে। কাজেই এটাকে থামাতেই হবে। সে ক্ষেত্রে আমাদের সচেতন হতে হবে।

অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি বেগম

জাতীয় উপদেষ্টা, ইএসবি

এন্ডোমেট্রিওসিস কোনো আনকমন রোগ নয়। এটি স্বাভাবিক রোগ। এই রোগ কাদের হচ্ছে এবং কেন হচ্ছে? সে বিষয়ে আমাদের জানা দরকার। আমরা দেখি আমাদের সমাজে কিশোর বয়সী মেয়েদের থেকে যেকোনো বয়সী নারীদের এ রোগ হতে পারে।

পরিবারে মা অথবা অন্য কারও থাকলে হতে পারে। অন্য কোনো কারণেও হতে পারে। আসলে এ রোগের সঠিক কারণ আমরা এখনো জানি না। মেয়েদের সমস্যার কথা আমাদের শুনতে হবে। সঠিক সময়ে রোগ খুঁজে পেলে আমরা তা চিকিৎসার মাধ্যমে কমিয়ে রাখতে পারব। এ বিষয়ে লিফলেট তৈরি করে অথবা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করে ছাত্রীদের সচেতন করতে পারলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম

সহসভাপতি, ইএসবি

‘কন্যা তুমি মুখ খোলো’। আমরা আমাদের সমাজে দেখি যখন একজন কিশোরীর প্রথম প্রচণ্ড পেট ব্যথা হয়, মাসিক শুরু হয়, তখন তার মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সে কাউকে কিছু বলতে পারে না। তাই আমি বলব, কন্যা তুমি মুখ খোলো।

জন্মের পর সাত দিনের মধ্যে মেয়েশিশুর জরায়ুতে কোনো সমস্যা হলে তা ডাক্তার দেখিয়ে পরামর্শ নিতে হবে। তৃণমূল পর্যায়ে মেয়েরা যেন কোনো ভুল চিকিৎসা না পায়, সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। সার্জিক্যাল চিকিৎসা দেওয়ার আগে রোগীকে আমাদের মেডিকেল চিকিৎসা দিতে হবে।

অধ্যাপক ডা. লায়লা আর্জুমান্দ বানু

জাতীয় উপদেষ্টা, ইএসবি

প্রথমেই আমাদের রোগ নির্ণয় করতে হবে। এন্ডোমেট্রিওসিস ডায়াগনেসিস করতে হলে আমাদের ল্যাপারোস্কপি করতে হবে। ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, রোগটা কোন পর্যায়ে আছে? কীভাবে আছে? অনেক সময় দেখি, আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ঠিকমতো কাজ হচ্ছে না, মেডিকেল চিকিৎসায় কাজ হচ্ছে না, তখন আমরা বাটারি-সার্জারি করি। ইলেকট্রিক বার্ন করে পুড়িয়ে দিই। অনেক সময় তলপেটে যে অ্যানাটমিক রিলেশন থাকে, তা ছাড়িয়ে দিলেই রোগী অনেক ভালো হয়ে যায়। অনেক ছোট সিস্ট আমরা ওষুধ দিয়ে সারিয়ে তুলি, তবে সিস্ট বড় হয়ে গেলে সার্জারি করে থাকি। রোগটা যেহেতু দ্রুত ছড়িয়ে যায়, তাই আমাদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে সার্জারি করে ফেললে ভালো। পেট কেটে করলে দাগ থেকে যায়, তবে ল্যাপারোস্কপি করলে দাগ থাকে না বললেই চলে।

অধ্যাপক ডা. সালেহা বেগম চৌধুরী

মহাসচিব, ইএসবি

এন্ডোমেট্রিওসিস মানেই হচ্ছে ব্যথাসহ জীবন। মাসিকের আগে ব্যথা, মাসিকের পরে ব্যথা, কোমর ব্যথা, সহবাসে ব্যথা, সব ক্ষেত্রে ব্যথা নিয়েই জীবন। আমাদের চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য থাকে, এই ব্যথাকে উপশম করা। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল চিকিৎসার একটা গুরুত্ব আছে। প্রথমত ব্যথানাশক ওষুধ দিতে পারি। সাধারণ চিকিৎসায় কাজ না হলে হরমোনাল চিকিৎসা দেওয়া হয়। সম্প্রতি যেটা দেওয়া হচ্ছে, তা হচ্ছে ডায়নোজেস্ট। কন্টিনিওয়াস থেরাপির মাধ্যমে ব্যথা কমিয়ে রাখা হয়। এ রোগের ওষুধগুলো বেশ দামি। এ ক্ষেত্রে আমরা ছয় মাসের ওষুধ দিয়ে থাকি। সবশেষে বলব, যেখানে ওষুধ কাজ করে না, সেখানে আমরা সার্জিক্যাল চিকিৎসা দিয়ে থাকি।

অধ্যাপক ডা. পারভীন ফাতেমা

সহসভাপতি, ইএসবি

আমরা অনেকেই মনে করি এন্ডোমেট্রিওসিস প্রধানত প্রাপ্তবয়স্কদের হয়। আসলে তা নয়। এখন ১২ বছরের কিশোরীদেরও অনেকের এই রোগ হচ্ছে। যে পরিবেশে আমরা বসবাস করি, সেটাই আমাদের পরিবেশ। বাতাস, পানি, মাটি—এসবই আমাদের পরিবেশের অংশ। এগুলো যদি বিশুদ্ধ না হয়, তাহলে কিন্তু আমরা অসুস্থ হয়ে যাব। তাই পরিবেশের সঙ্গে এন্ডোমেট্রিওসিসের একটা সম্পর্ক আছে। যাদের বাসা রোডের পাশে, সেখানে কিন্তু দূষিত বাতাস বেশি। সে কারণে দেখা যায়, তাদের এন্ডোমেট্রিওসিস বেশি হয়। ডাইঅক্সিন যখন পানিতে, মাটিতে মিশে যায়, তখন সেখানে উৎপাদিত খাবার খেলেও কিন্তু এন্ডোমেট্রিওসিস হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তাই জৈব উপায়ে উৎপাদিত খাবারগুলো আমাদের খেতে হবে।

অধ্যাপক ডা. গুলশান আরা

এডিটর, ইএসবি

আমরা দেখে থাকি, যাদের এন্ডোমেট্রিওসিস আছে, কিন্তু অনেক সময় তাদের কোনো সমস্যা ছাড়াই স্বাভাবিক প্রেগন্যান্সি হতে পারে। আবার কেউ সন্তান প্রসবও করে। কখনো আবার মিসক্যারেজ হতে পারে। অনেক সময় দেখা যায়, যে মায়ের এন্ডোমেট্রিওসিস আছে, তাদের প্রিটার্ম ডেলিভারির হার বেশি। এন্ডোমেট্রিওসিস থাকা মায়েদের প্রিএকলামশিয়ার ঝুঁকি থাকে। এ ক্ষেত্রে ডেলিভারি যে স্বাভাবিক হবে না, তা নয়, তবে সিজার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অনেক সময় সিজারের পর পেলভিক পেইন বাড়তে পারে। এ ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই সিগনেফিকেন্টলি ইনফার্টিলিটি বেড়ে যায়।

অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান

সাংগঠনিক সম্পাদক, ইএসবি

এন্ডোমেট্রিওসিস প্রতিরোধ করতে হলে ভিটামিন যুক্ত খাবার খেতে হবে। যে খাবারগুলোতে ভিটামিন, এ বি সি আছে, সেগুলো খেলে কিছুটা রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রতিদিন সবুজ শাকসবজি খেতে হবে। প্রতিদিন মাঝারি সাইজের একটা করে কাঁচা ফল খেতে হবে। তা ছাড়া খেজুরজাতীয় শুকনো ফল খাওয়া যায় পরিমাণমতো। সামুদ্রিক মাছ খেলে ভালো। লাল মাংস খেতে আমরা বারণ করি। বাদাম, পনির খেতে পারলে ভালো। এগুলোতে ভিটামিন ওমেগা-৩ আছে, ডি আছে। ব্রাউন রাইস উপকারী। দই খাওয়া যেতে পারে। তবে টিনে বা কৌটায় যেসব খাদ্য পাওয়া যায়, সেগুলো খেতে আমরা বারণ করব। পানি বেশি করে খাওয়া উচিত। প্রতিদিন শারীরিক ব্যায়াম করা দরকার।

অধ্যাপক ডা. রাশিদা বেগম
সহসাধারণ সম্পাদক, ইএএসবি

যেসব নারীর এন্ডোমেট্রিওসিসের জন্য ইনফার্টিলিটি, তাদের খুব সতর্ক হতে হবে যাতে দ্রুততম সময়ে তাদের চিকিৎসা শেষ করা যায়। অর্থাৎ তাদের অল্প সময়েই সন্তানের পর্ব শেষ করা। তাই প্রয়োজন হতে পারে সার্জারির, প্রয়োজন হতে পারে টেস্টটিউব চিকিৎসার।

যখন রোগটি একটু জটিল পর্যায়ে যায়, তখন দ্রুত টেস্টটিউব চিকিৎসাই শ্রেয়। এই রোগের ফলে ক্রমান্বয়ে প্রজননের সম্ভাবনা কমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ফলে যাঁদের এখনই বাচ্চা নেওয়ার মতো উপায় নেই বা পরিকল্পনা নেই তারা প্রয়োজনে ওভাম বা এম্ব্রায়ো ফ্রিজিং করে রাখতে পারেন ভবিষ্যতের জন্য। ব্যবহার করা যাবে।

সহযোগী অধ্যাপক ডা. শারমিন আব্বাসি
সায়েন্টিফিক সেক্রেটারি, ইএসবি ও সঞ্চালক

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৯০ মিলিয়ন নারী এই এন্ডোমেট্রিওসিসের সমস্যায় ভুগছেন। মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা নিয়ে মূলত তাঁরা আসেন। কিশোরী থেকে মেনোপোজ যেকোনো বয়সের, গ্রাম থেকে শহর—যেকোনো নারী এই সমস্যায় ভুগতে পারেন। অজ্ঞতা, কুসংস্কার, সামাজিক ভয়, সচেতনতার অভাব আর অতিরিক্ত চিকিৎসা ব্যয়ের কারণে দিনে দিনে এই রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। অনেকেই ডায়াগনোসিস করতে দেরি করছেন ৭-৮ বছর। এরই মধ্যে সমস্যাটি চকলেট সিস্ট বা বন্ধ্যত্বের মতো জটিলতার দিকে যাচ্ছে। তাই মাসিকের সময় তলপেটে তীব্র ব্যথা হলে আর দেরি নয়, আজই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সবাই মিলে এন্ডোমেট্রিওসিস প্রতিরোধে এবং দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্হা করতে হবে।

গ্রন্থনা: সাইদুল হাসান