এবারও অনুসন্ধান কমিটি দিয়ে গঠন হচ্ছে ইসি

সংবিধানে বলা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে আইন করেনি।

নির্বাচন কমিশন ভবন
ফাইল ছবি

কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (ইসি) মেয়াদ আছে আর সাড়ে পাঁচ মাস। আগামী বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে নতুন নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব নিতে হবে। তবে কোন প্রক্রিয়ায় এই কমিশন গঠন করা হবে, কমিশনারদের যোগ্যতা কী হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড নেই। সংবিধানে বলা থাকলেও এখন পর্যন্ত কোনো সরকারই নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে আইন করেনি।

সাংবিধানিকভাবে নির্বাচন কমিশন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কমিশনের গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সংবিধানের ১১৮ অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অনধিক চারজন নির্বাচন কমিশনারকে লইয়া বাংলাদেশের একটি নির্বাচন কমিশন থাকিবে এবং উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন।’

স্বাধীনতার পর ৫০ বছরেও কোনো সরকার এ–সংক্রান্ত আইন করেনি। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে তখন এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন এ–সংক্রান্ত আইনের একটি খসড়া তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আইনটি হয়নি।

সরকার ও ইসির একাধিক সূত্র বলছে, এ ধরনের আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগও এখন পর্যন্ত নেই। সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশনের মতো এবারও অনুসন্ধান কমিটি (সার্চ কমিটি) গঠন করা হতে পারে। এই কমিটির প্রস্তাবিত নাম থেকে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন রাষ্ট্রপতি। অবশ্য এই প্রক্রিয়ায় গঠিত দুটি কমিশন নিয়েই রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক বিতর্ক আছে।

সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু এ দুই কমিশন নিয়ে অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।
বদিউল আলম মজুমদার, সম্পাদক, সুজন
বদিউল আলম মজুমদার
ফাইল ছবি।

আইন না থাকায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি ইসি গঠন করে থাকেন। তবে ২০১২ ও ২০১৭ সালে সর্বশেষ দুটি কমিশন গঠন করা হয়েছিল অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির গঠন করা একটি অনুসন্ধান কমিটি সিইসি ও অন্য নির্বাচন কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনের জন্য বেশ কিছু নাম প্রস্তাব করেন। নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন গঠনের আগে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করেছিলেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। সেখানে দলগুলো পাঁচটি করে নাম প্রস্তাব করেছিল। ওই নামগুলো বিবেচনায় নিয়ে অনুসন্ধান কমিটি মোট ১০ জনের নাম রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেছিল। সেখান থেকে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পাঁচ সদস্যের বর্তমান কমিশন গঠন করেন।

জাতীয় সংসদের কাজে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যেটা আছে, সেটা কি আইনের কম?’

আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধান রাষ্ট্রপতিকে নির্বাচন কমিশন গঠনের দায়িত্ব দিয়েছে। যে কারণে রাষ্ট্রপতি সবার ঐকমত্যে একটি ব্যবস্থা চালু করেছেন। তাঁর জানামতে, এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দলের অবস্থান নেই। তিনি বলেন, সংবিধানে যেহেতু বলা আছে, তাই এ বিষয়ে একটি আইন করার ব্যাপারে তাঁরা যে চিন্তাভাবনা করছেন না, তা নয়। কিন্তু এখন যেটা আছে, সেখানে আইনের কমতি নেই। এবার কোন পদ্ধতিতে ইসি গঠন করা হবে, তা মহামান্য রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার।

নির্বাচন কমিশন গঠন রাষ্ট্রপতির এখতিয়ার হলেও সংবিধানের ৪৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করতে হয়। আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র বলছে, এবারও গত দুটি কমিশনের মতো সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হতে পারে। তবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গতবারের মতো এবারও সব দলের সঙ্গে রাষ্ট্রপতির সংলাপ হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর ২০১৭ সালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন করে প্রশংসিত হয়েছিল। কিন্তু এরপর প্রায় সব স্থানীয় নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ব্যাপকভাবে বিতর্কিত হয়।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে গুরুতর অসদাচরণ, অনিয়মসহ ৯টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে তা তদন্তের জন্য সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের দাবি জানিয়ে গত ১৪ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দেন দেশের ৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক। এরপর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তাঁরা দ্বিতীয় দফায় আরেকটি চিঠি রাষ্ট্রপতিকে দেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে কোনো উত্তর তাঁরা পাননি।

যে ৪২ নাগরিক রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন, তাঁদের একজন সুশাসনের জন্য নাগরিক—সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংবিধানে বলা থাকলেও ৫০ বছরেও কমিশন গঠনে একটি আইন হয়নি, এটা দুঃখজনক। সর্বশেষ দুটি নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে সার্চ কমিটির মাধ্যমে। কিন্তু এ দুই কমিশন নিয়ে অভিজ্ঞতা মোটেই ভালো নয়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এখন আর অ্যাডহক (অস্থায়ী) ভিত্তিতে নয়, একটি আইন করা খুবই জরুরি। সেখানে নির্বাচন কমিশনার হওয়ার যোগ্যতা–অযোগ্যতা কী হবে, তা উল্লেখ থাকবে। একই সঙ্গে ইসি গঠনে স্বচ্ছতার বিষয়টিও থাকবে। তিনি বলেন, এখনো আইন করার মতো সময় হাতে আছে। শামসুল হুদা কমিশন একটি খসড়া করেছিল। সেটাকে পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে আইন করা যায়।