এ বছরে শিক্ষায় যত ঘটনা

পরীক্ষা নিয়ে বেশি আলোচনা। ঘাটতি পূরণে কার্যকর নজর কম। বাড়তি ক্লাসের সুযোগ থাকলেও মাধ্যমিকে উল্টো আগেভাগে পরীক্ষা নিয়ে শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ।

ফাইল ছবি

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে শিক্ষার ক্ষতি নিয়েই ২০২১ সালের শুরুটা হয়েছিল। এর মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলতে পারে, এমন আভাসও ছিল। কিন্তু সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে না আসায় শিক্ষার্থীদের ঘরবন্দীই থাকতে হয়। দীর্ঘ দেড় বছর পর সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বন্ধ দুয়ার খোলে। কিন্তু তা–ও স্বল্প পরিসরে। এখন করোনার নতুন ধরন ‘অমিক্রন’–এর শঙ্কা নিয়ে বছর শেষ হচ্ছে। তাই নতুন বছরের শুরুতেও শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হচ্ছে না।

ইতিমধ্যে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছেন, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতি মার্চ পর্যন্ত দেখা হবে। এর মধ্যে সংক্রমণ না বাড়লে তারপর শিক্ষা কার্যক্রম স্বাভাবিক হতে পারে।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে ঠিকমতো শ্রেণি কার্যক্রম না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের শিখন দক্ষতায় ঘাটতি রয়ে গেছে। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের মূল দৃষ্টি ছিল দ্রুত পরীক্ষা নিয়ে বা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের কীভাবে ওপরের শ্রেণিতে ওঠানো যায়, তা নিয়ে। শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পূরণে জোর কম ছিল। তবে ভবিষ্যতে দেশের শিক্ষায় আমূল পরিবর্তনের ঘোষণা এসেছে এ বছর। গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ রূপরেখার বিষয়ে সম্মতি দেন, যা বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসবে।

  • পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসির ফল প্রকাশে সবাই পাস

  • এ বছরের পিইসি ও জেএসসি বাতিল

  • বছর শেষে ভিন্নভাবে এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষা

  • ২৯ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা

  • ঢাকার বাইরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা

  • দেড় বছর বন্ধের পর খুলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বন্ধ দুয়ার

  • মূল্যায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন এনে শিক্ষাক্রমের রূপরেখা অনুমোদন

  • এ বছর শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়

করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি শুরু হয়। এতে প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এতে বড় ক্ষতির মুখে পড়ে এসব শিক্ষার্থী।

এ বছরের শিক্ষা কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ক্ষতি পোষাতে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনা নিতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ক্ষতি পোষাতে আগের বছর (মার্চ ও এপ্রিল, ২০২০) থেকে অনলাইন, টিভি, রেডিওতে ক্লাস নেওয়া, অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সচল রাখাসহ কয়েকটি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও তা পর্যাপ্ত ছিল না। আর ডিজিটাল মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রমের সুবিধা সব শিক্ষার্থী সমানভাবে পায়নি। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা যাতে সংক্রমিত না হয়, সেই চেষ্টাও ছিল। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের করোনার টিকা দেওয়া শুরু হয়েছে। যদিও এ টিকাদানের হার সন্তোষজনক নয়।

শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করোনার সংক্রমণের কারণে স্বাস্থ্য খাতে যে মহামারি চলছে, সেটি সবাই জানে। কিন্তু শিক্ষায় মহামারি নীরবে হচ্ছে। শিক্ষার ক্ষতিগুলো বহুমাত্রিক। দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে থাকায় অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয় হলো, স্বল্প পরিসরের ক্লাস চললেও বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। ফলে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধির আশঙ্কাও বাড়ছে। অনেক ছাত্রী বাল্যবিবাহের শিকারও হয়েছে। উচ্চশিক্ষায় সেশনজট বেড়েছে। ফলে কর্মজীবনে প্রবেশে পিছিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।

শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ছিল দীর্ঘ বন্ধে শিক্ষার্থীদের যে শিখন ঘাটতি হয়েছে, তা পূরণের জন্য চলমান শিক্ষাবর্ষ কিছুদিন বাড়ানো। কিন্তু সেটা হয়নি, উল্টো মাধ্যমিকের বার্ষিক পরীক্ষা এগিয়ে এনে নভেম্বরে শেষ করে এখন শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ এই পরীক্ষা সব সময় হতো ডিসেম্বরে।

পরীক্ষা ছাড়াই ফল

২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর কথা ছিল ওই বছরের এপ্রিলে। কিন্তু করোনার সংক্রমণে দীর্ঘ বন্ধে এ পরীক্ষা আর নেওয়া যাননি। এরপর সিদ্ধান্ত হয়, পরীক্ষা ছাড়াই আগের জেএসসি ও এসএসসি এবং সমমানের পরীক্ষার গড় ফলের ভিত্তিতে মূল্যায়ন করা হবে। সেই সিদ্ধান্তের আলোকে এ বছরের জানুয়ারিতে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসির ফল প্রকাশ করা হয়। তাতে নয়টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীন প্রায় সাড়ে ১১ লাখ পরীক্ষার্থীর সবাই পাস করেন। এ ছাড়া আগের বছরের মতো এ বছরও পঞ্চম শ্রেণির প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষা হয়নি। শর্ত সাপেক্ষে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বিভিন্ন বর্ষে পরীক্ষা ছাড়াই ওপরের শ্রেণিতে ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়।

বছরের শুরুতে পরীক্ষা ছাড়াই এইচএসসির ফল প্রকাশ হলেও বছরের শেষে এসে ভিন্নভাবে এইচএসসি পরীক্ষা হচ্ছে। তার আগে নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় এসএসসি পরীক্ষা।

ভর্তি পরীক্ষায় ভিন্নতা

সাত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পর এ বছর প্রথমবারের মতো দেশের সাধারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মিলিয়ে ২০টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং তিনটি প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করছে। যদিও কিছু কিছু অভিযোগ ছিল এ পরীক্ষা নিয়ে। শিক্ষাবিদেরা বলছেন, যেসব ভুলত্রুটি ছিল, সেগুলো দূর করে ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও সুন্দর করলে এর সুবিধা আরও বাড়বে। অন্যদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এই প্রথম ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরেও ভর্তি পরীক্ষা নিয়েছে।

শুধু উচ্চশিক্ষায় নয়, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ভর্তির পদ্ধতিতেও বড় পরিবর্তন এসেছে। এবার কেন্দ্রীয়ভাবে ডিজিটাল লটারির মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়ে প্রথম থেকে নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

করোনাকালে শিক্ষার সার্বিক বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলেও পড়াশোনা ঠিকমতো শুরু করা যায়নি। পরীক্ষা নিয়েই বেশি ব্যস্ত ছিল শিক্ষা প্রশাসন। ক্ষতি পূরণে আরও পরিকল্পিত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। শিক্ষাবর্ষ কিছুদিন বাড়িয়ে তিন বছরের পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন করে ক্ষতি পোষানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।