এ বিলে পদ্ম যেন সাদা সাদা বক
হিন্দুধর্মের দেবী দুর্গার সন্তুষ্টির জন্য ১০৮টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করেছিলেন ‘অবতার’ শ্রীরামচন্দ্র। রামের ভক্তি পরীক্ষার জন্য একটি পদ্ম চুরি করেছিলেন দেবী। একটি পদ্ম কম পড়ায় রাম তাঁর দুটি চোখের একটি দেবীর চরণে উৎসর্গ করতে উদ্যত হয়েছিলেন। কেননা রামের চোখকে বলা হয় নীলকমল।
কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার নায়ক তাঁর প্রেয়সীর মন পাওয়ার জন্য ‘সমস্ত বিশ্ব সংসার তন্ন তন্ন করে খুঁজে’ এনেছিলেন ১০৮টি নীল পদ্ম।
সাহিত্যে নীল পদ্মের এহেন সরব উপস্থিতি থাকলেও বাস্তবে তার দেখা মেলে না। পাশাপাশি সাহিত্যে সাদা পদ্মের বিষয়ে কোনো ছন্দ বা লেখা চোখে না পড়লেও বিলুপ্তপ্রায় হলেও বাস্তবে তা দেখা যায়।
ফরিদপুরের নগরকান্দার রামনগর ইউনিয়নের কৃষ্ণারডাঙ্গি গ্রামের গজারিয়ার বিলের আকর্ষণ এই সাদা পদ্ম।
ফরিদপুর শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে গোয়ালন্দ-তাড়াইল সড়কের পূর্ব দিকে কৃষ্ণারডাঙ্গি গ্রামে রয়েছে এ গজারিয়া বিলটি। ফরিদপুরের নগরকান্দা, সদরপুর ও চরভদ্রাসনের সীমান্ত এলাকায় এর অবস্থান। নামে বিল বলা হলেও আকার তুলনামূলকভাবে ছোট হওয়ায় স্থানীয় লোকজন একে ‘গজারিয়ার কোল’ বলে থাকেন। এই বিলে আগে বড় বড় গজার মাছ পাওয়া যেত। এ কারণেই বিলের নাম ‘গজারিয়া বিল’, জানালেন ওই এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা।
পদ্ম ভারত ও ভিয়েতনামের জাতীয় ফুল। এটি বহুবর্ষজীবী গাছ। এর কাণ্ড লতানো। পাতা গোল, প্রায় ৪০ সেমি চওড়া। সরু কাঁটাযুক্ত লম্বা বোঁটার ফুলগুলো সুগন্ধিযুক্ত, পাপড়ি সাদা ও পুংকেশর হলদেটে। একটি ফুলে ১২ থেকে ১৮টি পাপড়ি থাকে। বর্ষা থেকে শরৎকালে এ ফুল বেশি ফোটে। এই ফুলের ফল দেখতে বাটির মতো, রং সবুজ। ফলের ভেতর বাদামি রঙের বীজ। পানির ওপরে পাতা ও ফুল ভাসমান অবস্থায় থাকে। মূল পানির নিচে কাদায় আবদ্ধ। সাধারণত এঁদো ডোবাতেই জন্মে ভুবনমোহিনী এই ফুল।
দূর থেকে গজারিয়া বিলের দিকে তাকালে মনে হয়, সবুজ খেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অসংখ্য সাদা সাদা বক। রাস্তা থেকে নেমে কাদা ও পানি মাড়িয়ে যতই কাছে যাওয়া যায়, ততই মনে হয় কোথায় বক, এ যে দেখছি বিরাট আকারের ফুল। পানির ওপর গোল পদ্মপাতাগুলো ভেসে আছে। এর ফাঁক দিয়ে মাতা উঁচু করে ফুটে আছে সাদা সাদা পদ্ম। কোনোটি সম্পূর্ণ ফোটা, কোনোটি আধা ফোটা, আবার কোনোটি বা শুধুই কলি।
মাঝেমধ্যে জোরে বয়ে যাচ্ছে দখিনা বাতাস। সে বাতাসে দোল খেয়ে বড় বড় গোল পদ্মপাতার এক দিক উল্টে যায়, দুলে ওঠে ফুল, আবার পাতা ও ফুলগুলো ফিরে যাচ্ছে আগের অবস্থানে বাতাস একটু দম ধরতেই। সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। ফুলের মধু খেতে ভিড় করছে নানা ধরনের কীট পতঙ্গ।
বিলের পাশে গোয়ালন্দ-তারাইল সড়কের পশ্চিম পাশে কৃষক নূরুদ্দীন খাঁর বাড়ি। তাঁর বয়স ৬২। বললেন, ‘কেউ বিলের মধ্যে এ সাদা পদ্ম লাগাইছে, না আপনা-আপনি হইছে, তা আমি জানি না। আর কত দিন ধইরা এ বিলে সাদা পদ্ম ফোটে, তা-ও আমার জানা নেই। আমি ছোটবেলা থেকেই দেখছি বিলে সাদা পদ্ম ফোটে। আমার বাবার কাছে শুনেছি, সে-ও দেখেছে তাঁর ছোটবেলা থেকেই।’
ওই গ্রামের গৃহবধূ নাসিমা বেগম বললেন, ‘প্রতিদিন এ পদ্ম ফুল দেখতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসে। হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন পূজার সময়, বিশেষত দুর্গা, লক্ষ্মী ও মনসাপূজার সময় অনেক দূর থেকে ছুটে আসেন পদ্ম ফুলের জন্য।’
সৌন্দর্যের ক্ষুধা মিটিয়েই ক্ষান্ত হয় না এ সাদা ফুল—এলাকার মানুষের নানা প্রয়োজনেও এর ব্যবহার আছে।
ওই গ্রামের বাসিন্দা রিকশাভ্যানচালক ইউনুস খান বলেন, পদ্ম ফুল থেকে যখন ফল হয়, তা দেখতে বাটির মতো, রং সবুজ। ফলের ভেতর থাকে বাদামি রঙের বীজ। এলাকার শিশু-কিশোরদের প্রিয় ওই বীজ। খেতে খুব সুস্বাদু। শিশুরা বীজের নাম দিয়েছে বাদাম। তিনি বললেন, ‘আগে এ পদ্ম পাতায় বেঁধে লবণ বিক্রি করা হতো। বিভিন্ন হাটের আগে এলাকার ব্যবসায়ীরা সংগ্রহ করতেন বড় বড় গোল গোল সবুজ রঙের পদ্মপাতা।’
কেটে ফেলা হবে এ সাদা পদ্মের ভান্ডার?
গজারিয়া বিলটি প্রায় ১০ একর জায়গা নিয়ে বিস্তৃত। ওই বিলের কিছু অংশে এ সাদা পদ্ম ফোটে। ক্রয়সূত্রে ওই জমির বর্তমান মালিক রামনগরের এস এস ব্রিক ফিল্ডের মালিক নাসির উদ্দিন আহমেদ ওরফে কামরুল। তিনি ১০ বছর আগে ওই বিল থেকে দুই একর জমি কিনেছেন। এই জমির প্রায় অর্ধেক (এক একর) জমিতে ফোটে এ সাদা পদ্ম ফুল।
নাসির উদ্দিন বললেন, তিনি এ জমি কিনেছিলেন একটি মাছের খামার করবেন বলে। তবে নানা প্রতিকূলতার কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তবে অচিরেই তিনি এই প্রকল্পটির শুরু করতে চান।
তাহলে কী হবে গজারিয়া বিলের ঐতিহ্য দুর্লভ এই সাদা পদ্মের ভবিষ্যৎ? জানতে চাইলে নাসির উদ্দিন বলেন, ‘আমার প্রকল্পের জন্য এ ফুল রক্ষা করা সম্ভব নয়, সব কেটে ফেলা হবে। আমি জানি, এ ফুল অনেক আগে থেকে এ বিলে ফুটে আসছে, এটি আমাদের দেশের ও এলাকার সম্পদ। কিন্তু এ ফুল রক্ষা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
ফরিদপুর হর্টিকালচার সেন্টারের উপপরিচালক কার্তিক চন্দ্র চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু জায়গাটি ব্যক্তিমালিকানার, সে জন্য আমি ওই জায়গা থেকে গোড়াসহ পদ্মের চারা সংগ্রহ করে নিজ উদ্যোগে সরকারি জায়গায় সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেব।’ তিনি বললেন, ‘প্রাকৃতিক ওই জায়গাতেই সাদা পদ্মগুলো এখন যেভাবে রয়েছে, সেভাবে সংরক্ষণ করা যায় কি না, সে ব্যাপারে আমি ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ও মৎস্য কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলব।’