
প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে মায়াভরা এক বুক ছায়া নিয়ে বৃক্ষ যখন প্রাণ জুড়িয়ে দেয়, তখন মনে হয় তারও প্রাণ আছে। তাই সে প্রাণে পরশ বোলাতে জানে। বন্ধুর মতো তার সঙ্গে সময় কাটানো যায়, কথা বলা যায়। তার কাছে ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। কোনো অপঘাতে একজন চেনা মানুষের মৃত্যু হলে বুকের মধ্যে যে রকম নেই-নেই বলে হাহাকার করে ওঠে, তার বেলায়ও একইরকম হয়। তখন কে বৃক্ষ, আর কে মানুষ কিছুতেই আলাদা করা যায় না। কিছুতেই মনে হয় না—সে নির্বাক, সে অনড়।
মানুষের সঙ্গে মানুষের বিরোধ মানুষকে আগে কাঁদিয়েছে, এখনো কাঁদাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও কাঁদাবে। তবু চোখ মুছে মানুষ মানুষকেই বুকে টেনে নয়। বৃক্ষ কোনো দিন মানুষের সঙ্গে বিরোধে জড়ায়নি । প্রতি মুহূর্তে মানুষের নির্গত কার্বন-বিষ পান করে যায় বৃক্ষ। আর মানুষের হৃৎপিণ্ড সচল রাখতে অক্সিজেন ছেড়ে দেয় বাতাসে। এ ছাড়া ফুল, ফল, ছায়া পত্রপল্লব—সবই শাখা বাড়িয়ে মেলে ধরে মানুষের জন্য। বন্ধু হিসেবে গাছ সর্বোত্তম। এ জন্য পিতা বা অভিভাবকের পরম নিরাপদ আশ্রয় বোঝাতে সবাই মাথার ওপর ‘বটবৃক্ষের’ কথা বলে থাকে।
আমাদের সংস্কৃতি এই অকৃত্রিম আত্মীয়তাকে ধারণ করে। বটবৃক্ষের ছায়া যেমনরে আমার বন্ধুর মায়া তেমন রে...অথবা যে মাধবী তলে দাঁড়িয়ে প্রথম বলেছিলে ভালোবাসি...। এভাবে বৃক্ষের শুশ্রূষা কখন আমাদের রক্ত থেকে হৃদয়ে ছড়িয়ে গেছে—আমরা জানি না। বাতাসের ভেতরে থেকে বাতাসের অস্তিত্ব ভুলে থাকার মতো। অথচ প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক ও মানবিক ঝড় পরম বন্ধুপ্রতিম এই প্রতিবেশীর বেড়ে ওঠা ও টিকে থাকার জন্য হুমকি হয়ে উঠছে।
চলতে-ফিরতে হরহামেশাই চোখে পড়ে গাছের সঙ্গে নির্মমভাবে পেরেক ঠুকে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে ‘চিকন স্বাস্থ্য মোটা করিয়া থাকি.../স্বর্ণপদক জয়ী কলিকাতা হারবাল.../তুফান ঘটক.../ কাজী অফিস/ বাসায় গিয়ে পড়াইতে চাই/ টিউটোরিয়াল হোম/ এখানে ধোলাই পাওয়া যায়/ এখানে ইট-বালি-পাথর পাওয়া যায় ইত্যাদি বিজ্ঞাপন। বন্ধুর বুকে পেরেক ঠোকার এমন নির্মম সংস্কৃতি বোধ করি পৃথিবীর অন্যত্র কমই রয়েছে। শুনেছি, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে একবার এক ভদ্রলোক এরকম পেরেক ঠোকার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছিলেন। বৃক্ষের পত্রপল্লবের প্রাণজ সাড়া দিব্য চোখে দেখার ও কী রকম অসাড় অনুভূতিহীন হলে আমরা তার গায়ে নির্দয়ভাবে পেরেক ঠুকতে পারি—দুদণ্ড ভেবে দেখার আমাদের কারও অবসর নেই।
এই জীবনে মানুষের মতো কত বৃক্ষের সঙ্গে পরিচয় ছিল! মানুষের চেহারার মতোই তাদের ডালপালাও যেন হাত ইশারায় ডাকে। একবার বসে ভাবলে মন উদাস হয়ে যায়। পরিচিত বেশির ভাগ বৃক্ষই আর নেই। এসব জায়গায় এখন গিয়ে দাঁড়ালে বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠে। মুহূর্তেই চিরচেনা জায়গাটা অচেনা লাগে। সেখানে যেন দাঁড়ানো যায় না। ভালো লাগে না।
আবার কোনো মুমূর্ষু মানুষ দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী হয়ে পড়ে থাকলে একসময় সবাই বলাবলি করে, মানুষটি মরে গেলেই বেঁচে যায়। সম্প্রতি অতি প্রিয় একটি গাছের কাছে গিয়ে আমার একই অনুভূতি হয়। ছোটবেলায় দেখতাম আমাদের গ্রামের মানুষ মাথায় বোঝা নিয়ে হেঁটে আড়ানির হাটে (রাজশাহীর আড়ানি রেলস্টেশনের পাশে) যেতেন। বেশির ভাগ মানুষই খালি পায়ে হেঁটে যেতেন। মাটির রাস্তা। ধুলো জমে থাকত। গ্রীষ্মের সময় তেতে উঠত ধুলো। তপ্ত ধুলার ভেতরে পা ডুবে যেত। অপর দিকে মাথায় বোঝা। গলা শুকিয়ে আসত। একটানে কেউ হাটে এসে পৌঁছাতে পারতেন না। রাস্তার মাঝামাঝি ছিল একটা কড়ইগাছ। রাস্তাজুড়ে বিস্তৃত ছিল তার ঘন ছায়া। সবারই একটা অলিখিত স্টেশন ছিল কড়ইতলা। সব হাটুরেই বোঝা নামিয়ে বসতেন কড়ইতলায়। এই গাছতলায় না থেমে যাওয়ার কথা কেউ কল্পনাই করতে পারতেন না। সেখানে ছোট্ট একটি দোকান ছিল। তখন রাস্তার ধারে এখনকার মতো নলকূপ ছিল না। দোকানি পাতকুয়ার পানি এনে মাটির পাত্রে ভরে রাখতেন। গাছের ছায়া আর পাতকুয়ার এক গ্লাস পানি তাঁদের প্রাণ জুড়িয়ে দিত।
আজ সময়ের পরিবর্তনে এই গাছের প্রয়োজন ফুরিয়েছে। এখন পাকা রাস্তা হয়েছে। রাস্তায় বিভিন্ন যানবাহন চলছে। মালামালসহ হাটুরেরা দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছেন। কড়ইতলার দিকে ফিরে তাকানোর মতো ফুরসত তাঁদের নেই। বছর খানেক আগে গাছটির ডালপালা মরতে শুরু করে। প্রয়োজন ফুরিয়েছে—দেখে কাউকেই গাছটির যত্ন নিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি। না বনবিভাগ, না কোনো ব্যক্তি। এখন এই গাছটির কোনো ডালেই আর কোনো সবুজ পাতা নেই। বাকল উঠে কাঠ বেরিয়ে গেছে। গাছটির দিকে তাকানোর উপায় নেই। আমরা হয়তো এ রকম বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসছি। জার্মানিসহ বাইরের অনেক দেশে হসপিজ আন্দোলন রয়েছে। সেখানে ওই সংগঠনের লোকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে সঙ্গ দেয়। একটি বিদেশি বইতে পড়েছিলাম, প্রাণের দাবিতে পৃথিবীতে সবাই সমান। এই গাছটির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আর তা মনে হয় না। তখন নিজের প্রাণটা নিয়েই সংশয় জাগে।