জীবনের সবই যেন থমকে গেছে

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে সবার জীবনের বাস্তবতা। আমরা এখানে শুনছি পাঠকের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা। তাঁরা লিখছেন পরিবারের আনন্দ-বেদনাভরা গল্প। শোনাচ্ছেন এ সময়ের কোনো মানবিক সাফল্যের কাহিনি। প্রথম আলো মানুষের সঙ্গে ভাগ করে নিচ্ছে পাঠকের গল্প। দেশ বা প্রবাস থেকে আপনিও লিখুন আপনার অভিজ্ঞতার কথা। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: dp@prothomalo. com
অলংকরণ : প্রথম আলো
অলংকরণ : প্রথম আলো

করোনাভাইরাসের কারণে গৃহবন্দী হয়ে থাকার মাস পূর্ণ হতে চলল। যদিও বিভিন্ন মহল থেকে, বিশেষ করে প্রবাসী মেয়েরা মার্চের মাঝামাঝি খুব চাপ আসছিল, নিয়মিত যেন অফিস না করি। কিন্তু দেশের পরিস্থিতি তখনো তেমন হয়নি যে অফিসে যাওয়া থেকে বিরত থাকব।

মার্চের ২৩-২৪ তারিখ থেকে অফিসে যাব না বলেই সিদ্ধান্ত নিলাম। অফিস থেকে ২৩ মার্চ বলেই এলাম সবাইকে, আমি ঘর থেকেই অফিস করব (work from home)। অফিসের কর্মচারীদেরও দুটি ভাগ করে ব্যবস্থা করলাম যে একেকটি ভাগ যেন তিন দিন করে অফিস করে। দু–তিনজন যাঁরা বেশ দূর থেকে আসেন (নারায়ণগঞ্জ থেকে), তাঁদের না আসার জন্যই নির্দেশ দিলাম।


কিন্তু আমার এই ব্যবস্থা এক দিনের বেশি কার্যকর রইল না। ২৫ মার্চ সরকার ছুটি দিয়ে দিল। কী করে যে কর্মহীন ছুটি কাটাব, সে চিন্তাতেই অস্থির ছিলাম। শুক্রবার একটিমাত্র সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সাংসারিক নানান কাজ, যেমন সকালে বাজার করা, টুকিটাকি ইত্যাদি কাজ করেই জুমার নামাজের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু হতো। নামাজ পড়ে এসে খাওয়া–দাওয়া সেরে দুপুরে একটু ভাতঘুম দিয়ে দিন এভাবেই শেষ হয়ে যেত। কিন্তু এভাবে দিনের পর দিন অনিশ্চয়তার মধ্যে কীভাবে কাটাব, সেই চিন্তায় অস্থির ছিলাম।


যখন চাকরি করতাম, অবসরে যাওয়া পর্যন্ত সুদীর্ঘ কর্মজীবনে সাকল্যে এক মাস ছুটি ভোগ করেছি কি না মনে পড়ে না। তাই দু–এক দিন ছুটি হলেই চিন্তায় পড়তাম কী করব। আর এই এত দিন ঘরে বসে কী করে কাটবে, সেই চিন্তায় অস্থির লাগছে। চাকরি করতাম এক সেক্টর করপোরেশনে। অবসরের পর গিন্নি ভাবল, এবার বোধ হয় আমাকে সব সময়ই কাছে পাবেন। কিন্তু আমার তো বসে থাকা ধাতে সয় না। আমি কিছুদিন পরিচিত এক লোকের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে এবং তারপর এক বন্ধুপ্রতিম লোকের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজেকে কাজে জড়ালাম। ফলে সকাল-সন্ধ্যা আবার সেই অফিস। কিন্তু এবার করোনার কাছে হার মানতেই হলো। গিন্নিরও ষোলোকলা পূর্ণ হলো। ৪৫ বছরের বৈবাহিক জীবনে এই প্রথম আমাকে সার্বক্ষণিক কাছে পেয়ে তাঁর কী আনন্দ!


ঘরে একটা খবরের কাগজ সব সময়ই নেওয়া হতো। সময় কাটানোর জন্য আরেকটি বাড়ানো হলো। কিন্তু ভালো লাগে না। খবরের কাগজে শুধু করোনার খবর, আর কোনো খবর নেই। আর আছে ত্রাণের চালচোরদের নানা অপকীর্তির খবর। সবই বিষাদময়। তাই কীভাবে নিজেকে কর্মব্যস্ত রাখা যায়, মনে মনে তার একটা ছক কষতে লাগলাম। গৃহকর্মীদেরও অব্যাহতি দিয়ে দিয়েছেন গিন্নি। ভাবলাম, ঘরোয়া কোনো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখা যায় কি না; তাতে আমারও সময় কাটবে, আবার গিন্নিরও কিছু সাহায্য হবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বিছানাপত্র গুছিয়ে ঘরদোর ঝাঁট দিয়ে নাশতা করতে বসি। নাশতা করে এক–দুদিন পর দোকান থেকে সাংসারিক টুকিটাকি প্রয়োজনীয় জিনিস এনে রাখি। যাতে বারবার যেতে না হয়, সে জন্য যখন যেটা মনে আসে, সেটা টুকে রেখে সেই লিস্টটা নিয়ে বের হই। মাস্ক, গ্লাভস ইত্যাদি নিতে ভুলি না। বাইরে গিয়ে বেশি লোকসমাগম স্থান এড়িয়ে চলি। গৃহপরিচারিকা চলে যাওয়ায় পাঁচতলা থেকে একতলা অবধি সিঁড়ি খুবই অপরিচ্ছন্ন মনে হতো, তাই চার-পাঁচ দিন পর নিজেই ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করি। এতে করে নিজেরও শারীরিক ব্যায়াম হয়, আবার সিঁড়িটাও পরিষ্কার হয়।


একদিন বুকশেলফের সব বই নামিয়ে রোদে দিয়ে আবার পরিষ্কার করে গুছিয়ে রেখেছি। তাতে বইগুলোরও যত্ন হয়েছে, শেলফটাও পরিচ্ছন্ন রূপ পেয়েছে। আবার একদিন শোকেসের সব জিনিস নামিয়ে পরিষ্কার করেছি।


ছাদে মোটামুটি একটা ছাদবাগান আছে। কয়েক রকম ফল, ফুল ও সবজির গাছ আছে। এর তদারকির জন্য একজন মালি আছে। সপ্তাহে চার–পাঁচ দিন এসে পানি দেওয়া ও গাছের নানা যত্নআত্তি করেন। করোনাভাইরাসের কারণে তাঁকেও আসতে বারণ করে দিয়েছি আপাতত। সেই কাজও আমার ওপর পড়ল।


এসব কাজ করে দিন কীভাবে চলে যায় বোঝা যায় না। শুধু বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত গিন্নিকে সঙ্গে নিয়ে ছাদে বেড়াতে যাওয়া একটা নিত্যকার কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। খুবই আরাম লাগে বিকেলের মুক্ত হালকা বাতাসে ছাদে হেঁটে বেড়াতে! ছাদে গিয়ে দেখি আশপাশের অনেক বাড়ির ছাদে অনেক লোকজন, নারী ও পুরুষ হাওয়া খেয়ে বেড়াচ্ছে যেহেতু বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না, তাই! অনেক চেনামুখ দেখি যাঁরা কোন বাসায় থাকেন, আগে ঠিক জানতাম না! শুধু দোকান বা বাজারে কিংবা মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেই দেখা হতো, যাঁদের সঙ্গে আলাপ নেই, তবে মুখটা পরিচিত! এখন বাড়ির ছাদে দেখে বুঝি, উনি অমুক বাড়ির লোক, উনি তমুক বাড়ির! চোখাচোখি হলে একটু মুচকি হাসিও বিনিময় হয়! শহরের বাড়ির এই তো দস্তুর! পাশাপাশি থাকি, অথচ কেউ কাউকে চিনি না, কারোর সঙ্গে আলাপ নেই, শুধু জানি আমরা একই পাড়ায় থাকি!


সন্ধ্যার পর চা-নাশতা পর্ব সেরে এখন বেশ বিনোদনমূলক একটা সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। বিটিভিতে বহু আগে প্রচারিত হুমায়ূন আহমেদের লেখা দুটি অতি জনপ্রিয় ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত হচ্ছে! সেটা দেখে উপভোগ করে ঘণ্টাখানেক সময় বেশ আনন্দেই কাটছে! বিটিভিকে ধন্যবাদ জানাতেই হয়! তারপর খাওয়া–দাওয়া পর্ব সেরে ঘুম এবং পরের দিনের যাত্রা শুরু!


এই করোনাকালের কথা চিন্তা করে সব এলোমেলো হয়ে যায়। জীবনের সবই যেন থমকে গেছে! জানি না আবার আগের মতো সব সচল হবে কি না। হয়তো একসময় লকডাউন উঠে যাবে। এরপরও কয়েক মাস কেটে যাবে সবকিছু স্বাভাবিক হতে। এমনও হতে পারে, আগে যেমনটি ছিল, সবার জীবন তেমনটি আর থাকবে না।


হোক অন্য রকম, তবু স্বাভাবিক হোক। এখনকার এই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার অবসান হোক। এই অবস্থার সঙ্গে কেবল তুলনা করা যায় দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কাল অথবা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের কাল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ দেখিনি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি, প্রত্যক্ষ করেছি। তখনো ঠিক এমনিভাবে ঘরে অবরুদ্ধই থাকতে হতো। বাইরে বেরোনো দায় ছিল। গেলেই বেঁচে ফিরব কি না, তার ঠিক ছিল না। এখনো তা–ই। তখনো এক শত্রুর ভয়ে আতঙ্কে ছিলাম, এখনো এক শত্রুর ভয়ে। প্রথমটি সদৃশ্য এবং দ্বিতীয়টি অদৃশ্য। মনে তাই প্রবোধ দিই, সেই সংকটকাল যখন উতরে গেছি, এবারও পারব মহান আল্লাহর করুণায়!


ষাট কিংবা সত্তরের দশকে রাশিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়েছিল। তাতে বেশ কটি সুন্দর ছবি এসেছিল। সব কটির নাম মনে নেই। তবে একটি ছবি এই সময়ের প্রেক্ষাপটে খুব মনে পড়ছে। ‘ক্রেইনস আর ফ্লাইং’। ছবিটি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার কাহিনি নিয়ে। ছবিটির মর্মকথা ছিল, যুদ্ধের কারণে সর্বক্ষণ আকাশজুড়ে থাকত যুদ্ধবিমানগুলোর আনাগোনা; ফলে বলাকা, সারসজাতীয় পাখিগুলো সুযোগ পেত না মুক্ত আকাশে ডানা মেলে উড়ে বেড়াতে। যুদ্ধ থেমে যাওয়ায় আকাশমুক্ত হয়ে যাওয়ার পর বক সারস পাখিগুলো আবার নির্বিঘ্নে উড়তে পেরেছিল। আমারও বাড়ির অবস্থান বিমানবন্দরের খুব কাছাকাছি হওয়ায় সর্বক্ষণ বাণিজ্যিক বিমানগুলোর অবতরণ আর উড্ডয়নের কারণে কান ঝালাপালা হয়ে যেত। তখন বিরক্ত লাগলেও এখন সব দেশি-বিদেশি বিমানের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় খুবই নিস্তব্ধ লাগে। এখন মনে হয় সেটাই ভালো ছিল। কামনা করি আবার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসে সব বিমানের আনাগোনা বেড়ে যাক, যেন বলতে পারি ‘প্লেনস আর ফ্লাইং’!

*লেখক: টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, ঢাকা